বিপ্রদাস

পরদিন সকালে দেখা হইলে বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, বোনের বিয়ে নির্বিঘ্নে সমাধা হলো?

হাঁ হলো—বিঘ্ন কিছু ঘটেনি।

নিজের জিদই বজায় রইলো, মাসীর অনুরোধ রাখলে না? কত রাত্রে ফিরলে?

রাত্রি তখন তিনটে। মাসীর কথা রাখা চলল না। রাত্রেই ফিরতে হলো। একটুখানি থামিয়া বোধ হয় বন্দনা ভাবিয়া লইল বলা উচিত কিনা, তার পরেই সে বলিতে লাগিল, মাত্র কয়েক ঘণ্টা ছিলুম কিন্তু কাজ করে এসেচি অনেক। এক বছরে যা করতে পারিনি মিনিট পাঁচ-ছয়েই তা হয়ে গেল। সুধীরের সঙ্গে শেষ করে এলুম।

বিপ্রদাস আশ্চর্য হইয়া বলিল, বলো কি!

হ্যাঁ, তাই। কিন্তু ওকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে আসিনি। আজ সকালে যে মেয়েটিকে দেখেছিলেন তার নাম হেম। হেমনলিনী রায়। ওর জিম্মাতেই সুধীরকে দিয়ে এলুম। আবার আমার সেই বোম্বায়ের কলের কথাই মনে পড়ে, তার মতো ওদের ওখানেও ভালবাসার টানা-পোড়েনে দেখতে দেখতে মানুষের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে! আবার ভাঙ্গেও তেমনি।

বিপ্রদাস তেমনি বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল—ব্যাপারটা হলো কি? সুধীরের সঙ্গে হঠাৎ শেষ করে আসার মানে?

বন্দনা কহিল, শেষ করার মানে শেষ করা। কিন্তু তাই বলে ওখানে হঠাৎ বলেও কিছু নেই। ওদের তাল অসম্ভব দ্রুত বলেই বাইরে থেকে ‘হঠাৎ’ বলে ভ্রম হয়, কিন্তু আসলে তা নয়। সুধীর আমাকে ডেকে বললে আমার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। বললুম, কি অন্যায় হয়েছে সুধীর? সে বললে, কাউকে না বলে—অর্থাৎ তাকে না জানিয়ে—অকস্মাৎ এ বাড়িতে চলে আসা আমার খুব গর্হিত কাজ হয়েছে। বিশেষতঃ, সেখানে বিপ্রদাসবাবু ছাড়া আর কেউ নেই যখন। বললুম, সেখানে অন্নদাদিদি আছে। সুধীর বললে, কিন্তু সে দাসী ছাড়া আর কিছু নয়। আমি বললুম, ও বাড়িতে তাঁকে দিদি বলে সবাই ডাকে। শুনে সেই হেম মেয়েটি মুখ টিপে একটু হেসে বললে, পাড়াগাঁয়ে ও-রকম ডাকার রীতি আছে শুনেচি, তাতে দাসী-চাকরের অহঙ্কার বাড়ে, আর কিছু বাড়ে না। তারা নিজেরাও বড় হয়ে ওঠে না।

সুধীর বললে, এঁদের কাছে তুমি বলেচো যে এখানে থাকতে পারবে না, রাত্রেই ফিরে যাবে; কিন্তু সে-বাড়িতে তোমার একলা থাকাটা আমরা কেউ পছন্দ করিনে। তোমার বাবা শুনলেই বা কি বলবেন? বললুম, বাবা কি বলবেন সে ভাবনা তোমার নয়, আমার। কিন্তু আরও যাঁরা পছন্দ করেন না তাঁদের মধ্যে কি তুমি নিজেও আছ? হেম বললে, নিশ্চয়ই আছেন! সকলকে ছাড়া ত উনি নয়। এই মেয়েটার গায়েপড়া মন্তব্যর উত্তর দিতে ইচ্ছে হল না, তাই সুধীরকে বললুম, তোমার এ কথার জবাবে আমিও বলতে পারতুম যে অনর্থক ছুটি নিয়ে তোমার কলকাতায় থাকাটা আমিও পছন্দ করিনে, কিন্তু সে কথা আমি বলব না। তুমি যে নোংরা ইঙ্গিত করলে তা ইতর-সমাজেই চলে, কিন্তু তোমাদের বড়-দলেও সে যে সমান সচল এ আমি জানতুম না, কিন্তু আর আমার সময় নেই, গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমি চললুম। সেই মেয়েটা বলে উঠল, যা অশোভন, যা অনুচিত তার আলোচনা ছোট-বড় সকল দলেই চলে জানবেন। বললুম, আপনার যত খুশি আলোচনা চালান আপত্তি নেই। আমি উঠলুম। সুধীর হঠাৎ কেমন ধারা যেন হয়ে গেল,—মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল,—নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, তোমার মাসীমাকেও জানিয়ে যাবে না? বললুম, তাঁকে জানানোই আছে বিয়ে হয়ে গেলেই আমি চলে যাবো যত রাতই হোক। সুধীর বললে, কাল তোমার সঙ্গে কি একবার দেখা হতে পারবে? বললুম, না। সে বললে, পরশু? বললুম, পরশুও না।

তার পরের দিন?

না, তার পরের দিনও নয়।

কবে তোমার সময় হবে?

সময় আমার হবে না।

কিন্তু আমার যে একটা বিশেষ জরুরী কথা আলোচনা করবার আছে?

তোমার হয়ত আছে কিন্তু আমার নেই। এই বলে উঠে পড়লুম।

সুধীর আমাকে যে চেনে না, তা নয়, সঙ্গে এগিয়ে আসতে সাহস করলে না, সেইখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি গাড়িতে এসে বসলুম।

বিপ্রদাস ঈষৎ হাসিয়া কহিল, এর মানে কি শেষ করে দেওয়া বন্দনা? একটুখানি কলহ। সন্দেহ যদি থাকে দেখা হলে তোমার মেজদিকে জিজ্ঞেসা করে নিও।

বন্দনা হাসিল না, গম্ভীর হইয়া বলিল, কাউকে জিজ্ঞেসা করার প্রয়োজন নেই মুখুয্যেমশাই, আমি জানি আমাদের শেষ হয়ে গেছে, এ আর ফিরবে না।

তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া বিপ্রদাস হতবুদ্ধি হইয়া রহিল,—বলো কি বন্দনা, এত বড় জিনিস কি কখনও এত অল্পেই শেষ হতে পারে? সুধীরের আঘাতটাই একবার ভেবে দেখো দিকি।

বন্দনা বলিল, ভেবে দেখেছি মুখুয্যেমশাই। এ আঘাত সামলাতে সুধীরের বেশী দিন লাগবে না, আমি জানি ঐ হেম মেয়েটি তাকে পথ দেখিয়ে দেবে। কিন্তু আমি নিজের কথা ভাবছিলুম। শুধু যে গাড়িতে বসেই ভেবেছি তা নয়, কাল বিছানায় শুয়ে সমস্ত রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। অস্বস্তি বোধ করেচি সত্যি, কিন্তু কষ্ট আমি পাইনি।

কষ্ট পাবে রাগ পড়ে গেলে। তখন এই সুধীরের জন্যেই আবার পথ চেয়ে থাকবে, এই বলিয়া বিপ্রদাস হাসিল।

এ হাসিতেও বন্দনা যোগ দিল না, শান্তভাবে বলিল, রাগ আমার নেই। কেবল এই অনুতাপ হয় যে, চলে আসার সময়ে যদি কঠিন কথা আমার মুখ দিয়ে বার না হতো। দেখিয়ে এলুম যেন দোষ তাঁর,—জানিয়ে এলুম যেন মর্মাহত হয়ে আমি বিদায় নিলুম। কিন্তু তা ত সত্যি নয়,—এই মিথ্যে আচরণের জন্যেই শুধু লজ্জা বোধ করি মুখুয্যেমশাই, আর কিছুর জন্যে নয়। তাহার কথার শেষের দিকে চোখ যেন সজল হইয়া আসিল।

বিপ্রদাসের মনের বিস্ময় বহুগুণে বাড়িয়া গেল, এ যে ছলনা নয় এতক্ষণে সে বুঝিল। বলিল, সুধীরকে তুমি কি সত্যিই আর ভালবাসো না?

না।

একদিন ত বাসতে? এত সহজে এ ভালবাসা গেল কি করে?

এত সহজে গেল বলেই এত সহজে এর উত্তর পেলুম। নইলে আপনার কাছে মিথ্যে বলতে হত। এই বলিয়া সে কিছুক্ষণ নীরবে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আপনি জানতে চাইলেন কোন দিন সুধীরকে ভালোবেসেছিলুম কি না! সেদিন ভাবতুম সত্যিই ভালোবাসি। কিন্তু তার পরেই আর একজন পড়লো চোখে—সুধীর গেল মিলিয়ে। এখন দেখি সেও গেছে মিলিয়ে। শুনে হয়ত আপনার ঘৃণা হবে, মনে হবে এমন তরল মন ত দেখিনি। আমি জানি মেয়েদের এ লজ্জার কথা,—কোন মেয়েই এ স্বীকার করতে চায় না—এ যেন তাদের চরিত্রকেই কলুষিত করে দেয়। হয়ত আমিও কারো কাছে মানতে পারতুম না, কিন্তু কেন জানিনে, আপনার কাছে কোন কথা বলতেই আমার লজ্জা করে না।

0 Shares