বিপ্রদাস

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা বলিতে লাগিল, হয়ত এই আমার স্বভাব, হয়ত এ আমার বয়সের স্বধর্ম, অন্তর শূন্য থাকতে চায় না, হাতড়ে বেড়ায় চারিদিকে। কিংবা, এমনিই হয়ত সকল মেয়েরই প্রকৃতি, ভালোবাসার পাত্র যে কে সমস্ত জীবনে খুঁজেই পায় না। এই বলিয়া স্থির হইয়া মনে মনে কি যেন ভাবিতে লাগিল, তার পরেই বলিয়া উঠিল,—কিংবা হয়ত খুঁজে পাবার জিনিস নয় মুখুয্যেমশাই—ওটা মরীচিকা।

বিপ্রদাস তেমনিই মৌন হইয়া রহিল। বন্দনার যেন মনের আগল খুলিয়া গেছে, বলিতে লাগিল, এই সুধীরের সঙ্গেই এক বছর পূর্বে আমার বিবাহ স্থির হয়ে গিয়েছিল, শুধু তার মায়ের অসুখ বলেই হতে পারেনি। কাল ঘরে ফিরে এসে ভাবছিলুম বিয়ে যদি সেদিন হয়ে যেতো, আজ কি মন আমার এমনি করেই তাকে ঠেলে ফেলে দিতো? মনকে শাসনে রাখতুম কি দিয়ে? ধর্মবুদ্ধি দিয়ে? সংস্কার দিয়ে? কিন্তু অবাধ্য মন শাসন মানতে যদি না চাইতো কি হতো তখন? যাদের মধ্যে এই কটা দিন কাটিয়ে এলুম ঠিক কি তাদের মতন? এমনি ষড়যন্ত্র আর লুকোচুরিতে মন পরিপূর্ণ করে শুকনো হাসি মুখে টেনে টেনে লোক ভুলিয়ে বেড়াতুম? এমনি পরস্পরের নিন্দে করে, হিংসে করে, শত্রুতা করে? কিন্তু আপনি কথা কইচেন না কেন মুখুয্যেমশাই?

বিপ্রদাস বলিল, তোমার মনের মধ্যে যে ঝড় বইচে তার ভয়ানক বেগের সঙ্গে আমি চলতে পারবো কেন বন্দনা, কাজেই চুপ করে আছি।

বন্দনা বলিল, না সে হবে না, এমন করে এড়িয়ে যেতে আপনাকে আমি দেবো না। জবাব দিন।

কিন্তু শান্ত না হলে জবাব দিয়ে লাভ কি? তোমার আজকের অবস্থা যে স্বাভাবিক নয় এ কথা তুমি বুঝতে পারবে কেন?

কেন পারবো না মুখুয্যেমশাই, বুদ্ধি ত আমার যায়নি।

যায়নি কিন্তু ঘুলিয়ে আছে। এখন থাক। সন্ধ্যের পরে সমস্ত কাজকর্ম সেরে আমার কাছে এসে যখন স্থির হয়ে বসবে তখন বলবো। পারি তখনি এর জবাব দেবো।

তবে সেই ভালো, এখন আমারও যে সময় নেই—এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া গেল। বস্তুতঃ, তাহার কাজের অবধি নাই। সকালে ছুটি লইয়া অন্নদা কালীঘাটে গেছে, সে কাজগুলাও আজ তাহারই কাঁধে পড়িয়াছে। কত চাকর-বাকর, কত ছেলে এখানে থাকিয়া স্কুল-কলেজে পড়ে,—তাহাদের কত রকমের প্রয়োজন। কাজের ভিড়ে তাহার মনেও পড়িল না সে সারারাত্রি ঘুমায় নাই, সে আজ ভারী ক্লান্ত।

সন্ধ্যার পরে বিপ্রদাসের রাত্রির খাওয়া সাঙ্গ হইল, নীচের সমস্ত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করিয়া বন্দনা তাহার শয্যার কাছে আসিয়া একটা চৌকি টানিয়া বসিল, বলিল, মুখুয্যেমশাই, একটা কথার সত্যি জবাব দেবেন?

বিপ্রদাস বলিল, সচরাচর তাই ত দিয়ে থাকি। প্রশ্নটা কি?

বন্দনা বলিল, মেজদিদিকে আপনি কি সত্যিই ভালবাসেন? ছেলেবেলায় আপনাদের বিয়ে হয়েছে—সে কতদিনের কথা—কখনো কি এর অন্যথা ঘটেনি?

বিপ্রদাস অবাক হইয়া গেল। এমন কথা যে কাহারও মনে আসিতে পারে সে কল্পনাও করে নাই। কিন্তু আপনাকে সামলাইয়া লইয়া সহাস্যে কহিল, তোমার মেজদিদিকেই বরঞ্চ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করো।

বন্দনা বলিল, তিনি জানবেন কি করে? আপনার আসল মনের কথা ত শুনেচি কেউ জানতে পারে না। না বলতে চান বলবেন না, আমি এরকম করে বুঝে নেবো, কিন্তু বললে সত্যি কথাই আপনাকে বলতে হবে।

সত্যি কথাই বলবো, কিন্তু আমাকে কি তোমার সন্দেহ হয়?

হয়। আপনি অনেক বড় মানুষ, কিন্তু তবুও মানুষ। মনে হয় কোথায় যেন আপনি ভারী একলা, সেখানে আপনার কেউ সঙ্গী নেই। এ কথা কি সত্যি নয়?

বিপ্রদাস এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল না, বলিল, স্ত্রীকে ভালবাসা যে আমার ধর্ম বন্দনা।

বন্দনা বলিল, ধর্ম যতদূর প্রসারিত ততদূর আপনি খাঁটি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কি সংসারে কিছু নেই?

দেখতে ত পাইনে বন্দনা।

বন্দনা বলিল, আমি দেখতে পাই মুখুয্যেমশাই। বলবো সে কথা?

বিপ্রদাসের মুখ সহসা যেন পাণ্ডুর হইয়া উঠিল,—বলিষ্ঠ গৌরবর্ণ মুখে যেন রক্তের লেশ নাই, দুই হাত সম্মুখে বাড়াইয়া বলিল, না, একটি কথাও নয় বন্দনা। আজ তোমার ঘরে যাও,—কাল হোক, পরশু হোক,—আবার যখন প্রকৃতিস্থ হয়ে আলোচনার বুদ্ধি ফিরে পাবে তখন এর জবাব দেবো। কিংবা হয়তো আপনিই তখন বুঝবে, ঐ যারা তোমার মাসীর বাড়িতে বুদ্ধিকে তোমার আচ্ছন্ন করেছে তারাই সব নয়। ধর্ম যাদের কাছে অত্যাজ্য তারাও আছে, জগতে তারাও বাস করে। না না, আর তর্ক নয়,—তুমি যাও।

বন্দনা বুঝিল, এ আদেশ অবহেলার নয়। এই হয়ত সেই বস্তু যাহাকে বাড়িসুদ্ধ সকলে ভয় করে। বন্দনা নিঃশব্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

পরিচ্ছেদ – উনিশ

পরদিন বিকালের দিকে বন্দনা আসিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, আবার চললুম মাসীমার বাড়িতে। এবার আর ঘণ্টা-কয়েকের জন্যে নয়, এবার যতদিন না মাসী আমাকে বোম্বায়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে ততদিন।

অর্থাৎ?

অর্থাৎ আরজেন্ট টেলিগ্রামে এসেছে বাবার হুকুম। কালই সকালবেলা মাসী গাড়ি পাঠাবেন আমাকে নিতে।

বিপ্রদাস কহিল, অর্থাৎ বোঝা গেল তোমার মাসীর প্রতিশোধ নেবার অধ্যবসায় এবং বুদ্ধি আছে। এ বোধ হয় তাঁরই প্রিপেড টেলিগ্রামের জবাব। কৈ দেখি কাগজটা?

না, সে আপনাকে দেখাতে পারবো না।

শুনিয়া বিপ্রদাস ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপর ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ভগবান যে কারো দর্প রাখেন না এ তারই নমুনা। এতদিন ধারণা ছিল আমাকে জড়ানো যায় না, কিন্তু দেখচি যায়। অন্ততঃ, তেমন লোকও আছে। তোমার মাসীর মাথায় এ ফন্দিও খেলেছে। দাও না পড়ে দেখি অভিযোগটা কতখানি গুরুতর, বলিয়া সে হাত বাড়াইল।

এবার বন্দনা কাগজখানা তাঁহার হাতে দিল। রায়সাহেবের সুদীর্ঘ টেলিগ্রাম,—সমস্তটা আগাগোড়া পড়িয়া সেটা ফিরাইয়া দিয়া বিপ্রদাস বলিল, মোটের ওপর তোমার বাবা অসঙ্গ ত কিছুই লেখেন নি। নিঃস্বার্থ পরোপকারের বিপদ আছে, অসুস্থ আত্মীয়কে সেবা করতে আসাটাও সংসারে সহজ কাজ নয়।

0 Shares