বিপ্রদাস

নিরুদ্ধ নিশ্বাসে বিপ্রদাস কথাগুলি শুনিতেছিল, জিজ্ঞাসা শেষ করিয়া বন্দনা মুখ তুলিতেই সে চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, পেয়েচো বৈ কি বন্দনা, তুমি অনেকখানিই পেয়েছ। নইলে তোমার হাতে আমি খেতুম কি করে? তোমার রাত্রিদিনের সেবা নিতে পারতুম আমি কিসের জোরে? কিন্তু তাই বলে কি গ্লানির মধ্যে, অধর্মের মধ্যে নিজে নেমে দাঁড়াবো, তোমাকে টেনে নামাবো? যারা আমার পানে চেয়ে চিরদিন বিশ্বাসে মাথা উঁচু করে আছে, সমস্ত ভেঙ্গে চুরে তাদের হেঁট করে দেবো? এই কি তুমি বলো?

বন্দনা দৃপ্তস্বরে কহিল, তাহলে আপনিও স্বীকার করুন আজ ছাড়তে যা পারেন না সে শুধু এই দম্ভটাকে। বলুন সত্য করে ওদের কাছে এই বড় হয়ে থাকার মোহকেই আপনি বড় বলে জেনেছেন। নইলে কিসের গ্লানি মুখুয্যেমশাই,—কাকে মানতে যাবো আমরা অধর্ম বলে? মানুষের মনগড়া একটা ব্যবস্থা—মানুষেই যাকে বার বার মেনেছে, বার বার ভেঙ্গেছে—তাকেই? আপনি পারলেও আমি এ পারবো না।

বিপ্রদাস গম্ভীর হইয়া বলিল, তুমি না পারলেও আমি পারবো, আর তাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে। ইংরেজি বই অনেক পড়েচো বন্দনা, মাসীর বাড়িতে আলোচনাও অনেক শুনেচো, সে-সব ভুলতে সময় লাগবে দেখচি।

বন্দনা কহিল, আপনি, আমাকে তামাশা করচেন, আমি কিন্তু একটুও তামাশা করিনি মুখুয্যেমশাই, যা বলেচি সমস্তই সত্যি বলেচি।

তা বুঝেচি। কিন্তু এ পাগলামি মাথায় এনে দিলে কে?

আপনি।

বলো কি? এ অধর্ম-বুদ্ধি দিলুম তোমাকে অবশেষে নিজে আমিই?

হাঁ, আপনিই দিয়েচেন। হয়তো না জেনে কিন্তু আপনি ছাড়া আর কেউ নয়।

এইবার বিপ্রদাস নির্বাক-বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল। বন্দনা বলিতে লাগিল, যাকে অধর্ম বলে নিন্দে করলেন তাকে ত আমি মানিনে,—আমি জানি, ধর্ম বলে স্বীকার করেছেন যা একমনে সে শুধু আপনার সংস্কার। অত্যন্ত দৃঢ় সংস্কার, তবু সে তার বড়ো নয়।

বিপ্রদাস মাথা নাড়িয়া স্বীকার করিল, বলিল, হয়তো এ কথা তোমার সত্যি বন্দনা, এ আমার সংস্কার,—সুদৃঢ় সংস্কার, কিন্তু মানুষের ধর্ম যখন এই সংস্কারের রূপ ধরে বন্দনা, তখনি সে হয় যথার্থ, তখনি হয় সে সহজ। জীবনের কর্তব্যে আর তখন ঠোকাঠুকি বাধে না, তাকে মানতে গিয়ে নিজের সঙ্গে লড়াই করে মরতে হয় না। তখন বুদ্ধি হয়ে আসে শান্ত, অবাধ জলস্রোতের মতো সে সহজে বয়ে যায়। বুঝি একেই বলেছিলুম সেদিন এ হলো বিপ্রদাসের অত্যাজ্য ধর্ম—এর আর পরিবর্তন নেই।

কোনদিনই কি এর পরিবর্তন নেই মুখুয্যেমশাই?

তাইত আজও জানি বন্দনা। আজও ভাবতে পারিনে এ-জীবনে এর পরিবর্তন আছে।

এতক্ষণে বন্দনার দুই চোখ বাষ্পাকুল হইয়া উঠিল, বিপ্রদাস সযত্নে তাহার হাতখানি টানিয়া লইয়া বলিল, কিন্তু পরিবর্তনেরই বা দরকার কিসের? ভালো তোমাকে বেসেচি,—রইলো তোমার সে ভালোবাসা আমার মনের মধ্যে,—এখন থেকে সে দেবে আমাকে দুঃখে সান্ত্বনা, দুর্বলতায় বল, ভার যখন আর একাকী বইতে পারবো না তখন দেবো তোমাকে ডাক। সে-ও রইলো আজ থেকে তোমার জন্যে তোলা। আসবে ত তখন?

বন্দনা বাঁ হাত দিয়া চোখ মুছিয়া বলিল, আসবো যদি আসার শক্তি থাকে,—পথ যদি থাকে তখনও খোলা, নইলে পারবো না ত আসতে মুখুয্যেমশাই।

কথাটা শুনিয়া বিপ্রদাস যেন চমকিয়া গেল, বলিল, বটেই ত! বটেই ত! আসার পথ থাকে যদি খোলা,—চিরদিনের তরে যদি বন্ধ হয়ে সে না যায়। তখন এসো কিন্তু। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থেকো না।

বন্দনা চোখের জল আবার মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, আমার একটি ভিক্ষে রইলো মুখুয্যেমশাই, আমার কথা যেন কাউকে বলবেন না।

না, বলবো না। বলার লোক যে আমার নেই সে ত তুমি নিজেই জানতে পেরেচো।

হাঁ পেরেচি।

দুইজনে কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল।

বিপ্রদাস কহিল, এই বিপুল সংসারে আমি যে এতখানি একা এ কথা তুমি কি করে বুঝেছিলে বন্দনা?

বন্দনা বলিল, কি জানি কি করে বুঝেছিলুম। আপনাদের বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এলুম, আপনি এলেন সঙ্গে। গাড়িতে সেই মাতাল সাহেবগুলোর কথা মনে পড়ে? ব্যাপারটা বিশেষ কিছু নয়—তবু মনে হলো যাদের আমরা চারপাশে দেখি তাদের দলের আপনি নয়,—একাকী কোন ভার কাঁধে নিতেই আপনার বাধে না। এই কথাই বলেছিলেন সেদিন দ্বিজুবাবু,—মিলিয়ে দেখলুম কারও কাছে কিছুই আপনি প্রত্যাশা করেন না। রাত্রে বিছানায় শুয়ে কেবলি আপনাকে মনে পড়ে—কিছুতে ঘুমোতে পারলুম না। শেষরাত্রে উঠে দেখি নীচে পূজোর ঘরে আলো জ্বলছে, আপনি বসেছেন ধ্যানে। একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে ভোর হয়ে এলো, পাছে চাকররা কেউ দেখতে পায়, ভয়ে ভয়ে পালিয়ে এলুম আমার ঘরে। আপনার সে মূর্তি আর ভুলতে পারলুম না মুখুয্যেমশাই, আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই।

বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, দেখেছিলে নাকি আমাকে পূজো করতে?

বন্দনা বলিল, পূজো করতে ত আপনার মাকেও দেখেচি, কিন্তু সে ও নয়। সে আলাদা। আপনি কিসের ধ্যান করেন মুখুয্যেমশাই?

বিপ্রদাস পুনরায় হাসিয়া বলিল, সে জেনে তোমার কি হবে? তুমি ত তা করবে না!

না করবো না। তবু জানতে ইচ্ছে করে।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা কহিতে লাগিল, আমার সেইদিনই প্রথম মনে হয় সকলের মধ্যে থেকেও আপনি আলাদা, আপনি একা। যেখানে উঠলে আপনার সঙ্গী হওয়া যায় সে উঁচুতে ওরা কেউ উঠতে পারে না। আর একটা কথা জিজ্ঞেসা করবো মুখুয্যেমশাই? বলবেন?

কি কথা বন্দনা?

মেয়েদের ভালোবাসায় বোধ হয় আর আপনার প্রয়োজন নেই—না?

এ প্রশ্নর মানে?

মানে জানিনে, এমনি জিজ্ঞেসা করচি। এ বোধ হয় আর আপনি কামনা করেন না,—আপনার কাছে একেবারে তুচ্ছ হয়ে গেছে।—সত্যি কিনা বলুন।

বিপ্রদাস উত্তর দিল না, শুধু হাসিমুখে চাহিয়া রহিল।

নীচের প্রাঙ্গণে সহসা গাড়ির শব্দ শোনা গেল, আর পাওয়া গেল দ্বিজদাসের কণ্ঠস্বর। এবং, পরক্ষণেই দ্বারের কাছে আসিয়া অন্নদা ডাকিয়া বলিল, দ্বিজু এলো বিপিন।

0 Shares