বিপ্রদাস

সতী স্থির থাকিতে পারিল না, ব্যাকুল হইয়া নিবেদন করিল, আমরা কেউ শুনতে চাইনে, কিন্তু ঠাকুরজামাই কল্যাণীকে নিয়ে এক্ষুনি চলে যেতে চাচ্চেন, এই এক-বাড়ি লোকের মধ্যে ভেবে দেখো সে কত বড় কেলেঙ্কারী,—ওঁকে বলো তোমার হঠাৎ অন্যায় হয়ে গেছে,—বলো ওঁদের থাকতে।

বিপ্রদাস স্ত্রীর মুখের প্রতি একমুহূর্ত দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, হঠাৎ অন্যায় আমার হয় না সতী।

হয়, হয়, হঠাৎ একটা অন্যায় সকলেরই হয়। বল না ওঁদের থাকতে।

বিপ্রদাস মাথা নাড়িয়া কহিল, না, অন্যায় আমার হয়নি।

স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথনের মাঝে দয়াময়ী স্তব্ধ হইয়া ছিলেন, সহসা কে যেন তাঁহাকে নাড়া দিয়া সচেতন করিয়া দিল, তীব্রকণ্ঠে কহিলেন, ন্যায়-অন্যায়ের ঝগড়া থাক। মেয়ে-জামাই আমার চিরকালের মত পর হয়ে যাবে এ আমি সইবো না। শশধরের কাছে তুমি ক্ষমা চাও বিপিন।

সে হয় না মা, সে অসম্ভব।

সম্ভব-অসম্ভব আমি জানিনে। ক্ষমা তোমাকে চাইতেই হবে।

বিপ্রদাস নিরুত্তরে স্থির হইয়া রহিল। দয়াময়ী মনে মনে বুঝিলেন এ অসম্ভবকে আর সম্ভব করা যাইবে না,—ক্রোধের সীমা রহিল না, বলিলেন, বাড়ি তোমার একার নয় বিপিন। কাউকে তাড়াবার অধিকার কর্তা তোমাকে দিয়ে যাননি, ওরা এ বাড়িতে থাকবে।

বিপ্রদাস কহিল, দেখো মা, আমাকে ডেকে না পাঠিয়ে যদি তুমি এ আদেশ দিতে আমি চুপ করেই থাকতাম, কিন্তু এখন আর পারিনে। শশধর থাকলে এ বাড়ি ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে। আর ফেরাতে পারবে না। কোন্‌টা চাও, বল?

জীবনে এমন ভয়ানক প্রশ্নের উত্তর দিতে কোনদিন কেহ তাঁহাকে ডাকে নাই, এতবড় দুর্ভেদ্য সমস্যার সম্মুখীন হইতেও কেহ বলে নাই।

একদিকে মেয়ে-জামাই, আর একদিকে দাঁড়াইয়া তাঁহার বিপিন। যে শিশুকে বুকে করিয়া মানুষ করিয়াছেন, যে সকল আত্মীয়ের বড় আত্মীয়, দুঃখের সান্ত্বনা, বিপদের আশ্রয়—যে ছেলে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। এ অমর্যাদা তাহাকে মৃত্যু দিবে কিন্তু সঙ্কল্পচ্যুত করিবে না। বুঝিলেন সর্বনাশের অতলস্পর্শ গহ্বর তাঁর পায়ের নীচে, এ ভুলের প্রতিবিধান নাই, প্রত্যাবর্তনের পথ নাই—পরিণাম ইহার দৈবের মতই অমোঘ, নির্মম ও অনন্যগতি। তথাপি নিজেকে শাসন করিতে পারিলেন না, অদম্য ক্রোধ ও অভিমানের বাত্যায় তাঁহাকে সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া দিল, কটুকণ্ঠে বলিলেন, এ তোমার অন্যায় জিদ বিপিন। তোমার জন্যে মেয়ে-জামাইকে জন্মের মত পর করে দেব এ হয় না বাছা। তোমার যা ইচ্ছে কর গে। শশধর, এস তোমরা আমার সঙ্গে—ওর কথায় কান দেবার দরকার নেই। বাড়ি ওর একার নয়। এই বলিয়া তিনি কল্যাণী ও শশধরকে সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেলেন। তাঁহাদের পিছনে পিছনে গেল মৈত্রেয়ী, যেন ইঁহাদেরই সে আপন লোক।

মনে হইয়াছিল সতী বুঝি এইবার ভাঙ্গিয়া পড়িবে। কিন্তু তাহার অচঞ্চল দৃঢ়তায় বন্দনা ও বিপ্রদাস উভয়েই বিস্মিত হইল। তাহার চোখে জল নাই কিন্তু মুখ অতিশয় পাণ্ডুর, বলিল, ঠাকুরমশাই কি করেচেন আমরা জানিনে, কিন্তু অকারণে তুমিও যে এতবড় কাণ্ড করোনি, তা নিশ্চয় জানি। ভেবো না, মনে মনে তোমাকে আমি এতটুকু দোষও কোন দিন দেব।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। সতী জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি আজই চলে যাবে?

না, কাল যাবো।

আর আসবে না এ বাড়িতে?

মনে ত হয় না।

আমি? বাসু?

যেতে তোমাদেরও হবে। কাল না পার অন্য কোন দিন।

না, অন্য দিন নয়, আমরাও কালই যাবো। এই বলিয়া সতী বন্দনাকে জিজ্ঞাসা করিল, তুই কি করবি বন্দনা, কালই যাবি?

বন্দনা বলিল, না। আমি ত ঝগড়া করিনি মেজদি, যে দল পাকিয়ে কালই যেতে হবে।

সতী বলিল, ঝগড়া আমিও করিনি বন্দনা, উনিও না। কিন্তু যেখানে ওঁর জায়গা হয় না সেখানে আমারও না। একটা দিনও না। তোর বিয়ে হলে এ কথা বুঝতিস।

বন্দনা বলিল, বিয়ে না হয়েও বুঝি মেজদি, স্বামীর জায়গা না হলে স্ত্রীরও হয় না। কিন্তু ভুল ত হয়,—না বুঝে তাকেই স্বীকার করা স্ত্রীর কর্তব্য, তোমার এ কথা আমি মানব না।

শাশুড়ীর প্রতি সতীর অভিমানের সীমা ছিল না, বলিল, স্বামী থাকলে মানতিস। বলিয়াই অশ্রু চাপিতে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

বন্দনা কহিল, এ কি করলেন মুখুয্যেমশাই?

না করে উপায় ছিল না বন্দনা।

কিন্তু মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ এ যে ভাবতে পারা যায় না।

বিপ্রদাস বলিল, যায় না সত্যি, কিন্তু নতুন প্রশ্ন এসে যখন পথ আগলায় তখন নতুন সমাধানের কথা ভাবতেই হয়। এড়িয়ে চলবার ফাঁক থাকে না। তোমার মেজদি আমার সঙ্গে যাবেই—বাধা দেওয়া বৃথা। কিন্তু তুমি? আরও দু-চার দিন কি থাকবে মনে করেছো?

বন্দনা বলিল, কতদিন থাকতে হবে আমি জানিনে। কিন্তু নতুন প্রশ্ন আপনার যতই আসুক আমি কিন্তু সেই পুরনো পথেই তার উত্তর খুঁজে ফিরবো—যে পথ প্রথম দিনটিতে আমার চোখে পড়েছিল, যেদিন হঠাৎ এসে এ বাড়িতে দাঁড়িয়েছিলুম,—যার তুলনা কোথাও দেখিনি, যা আমার মনের ধারা দিয়েছে চিরকালের মত বদলে।

বিপ্রদাস ইহার উত্তর দিল না, শুধু ওষ্ঠপ্রান্তে তাহার একটুখানি ম্লান হাসির আভাস দেখা দিল। সে হাসি যেমন বেদনার তেমনি নিরাশার। কহিল, আমি বাইরে চললুম বন্দনা, আবার দেখা হবে।

অশ্রুবাষ্পে বন্দনার চোখ ভরিয়া উঠিয়াছে; বলিল, দেখা যদি হয় তখন শুধু দূর থেকে আপনাকে প্রণাম করবো। কঠোর আপনার প্রকৃতি, কঠিন মন,—না আছে স্নেহ, না আছে ক্ষমা। তখন বলতে যদি না পারি, সুযোগ যদি না হয় এখুনি বলে রাখি মুখুয্যেমশাই, যাদের নিয়ে চলে আমাদের ঘরকন্না, হাসিকান্না, মান-অভিমান তাদের নিয়েই যেন চলতে পারি, তাদেরই যেন আপনার বলে এ জীবনে ভাবতে শিখি। আলেয়ার আলোর পিছনে আর যেন না পথ হারাই। একটু থামিয়া বলিল, দূরে থেকে যখনি আপনাকে মনে পড়বে তখনি একান্তমনে এই মন্ত্র জপ করবো—তিনি নির্মল, তিনি নিষ্পাপ, তিনি মহৎ। মনের পাষাণফলকে তাঁর লেশমাত্র দাগ পড়ে না। জগতে তিনি একক, কারো আপন তিনি নয়,—সংসারে কেউ তাঁর আপন হতে পারে না। এই বলিয়া দু’চোখে আঁচল চাপিয়া সে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

0 Shares