বিপ্রদাস

বন্দনা বলিল, এ আমাদের পারিবারিক কথা। বাইরের লোকের সঙ্গে এ আলোচনা চলে না।

দ্বিজদাস বলিল, আলোচনা ত নয়, শুধু একটা খবর।

বন্দনা তিক্তকণ্ঠে কহিল, আপনার সঙ্গে এমন কোন আত্মীয়-সম্বন্ধ নেই যাতে এ প্রশ্ন আপনি করতে পারেন। দ্বিজুবাবু, আপনি শিক্ষিত লোক, এ কৌতূহল আপনার লজ্জাকর। শুনিয়া দ্বিজদাস সত্যই লজ্জা পাইল, তাহার মুখ ম্লান হইয়া গেল। বলিল, আমার ভুল হয়েছে বন্দনা। স্বভাবতঃ আমি কৌতূহলী নই, পরের কথা জানবার লোভ আমার খুব কম। কিন্তু কি করে জানিনে আমার মনে হতো যে-কথা সংসারে কাউকে বলতে পারিনে আপনাকে পারি। যে বিপদে কাউকে ডাকা চলে না, আপনাকে চলে। আপনি—

তাহার কথার মাঝখানেই বন্দনা হাসিয়া বলিল, কিন্তু এই যে বললেন দাদার আলোচনা বাইরের লোকের সঙ্গে করতে আপনি চান না। আমি ত পর, একেবারে বাইরের লোক।

দ্বিজদাস কহিল, তাই যদি হয়, তবু আপনিই বা কেন তাঁর সম্বন্ধে আমাকে অশ্রদ্ধার খোঁটা দিলেন? জানেন না কি হচ্চে আমার? দীপালোকে স্পষ্ট দেখা গেল তাহার চোখের কোণ-দু’টা অশ্রুবাষ্পে ছলছল করিয়া আসিয়াছে।

মৈত্রেয়ী ঘরে ঢুকিল। বলিল, দ্বিজুবাবু, আপনি কখন বাড়ি এলেন আমরা ত কেউ জানতে পারিনি?

দ্বিজদাস ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল, জানবার খুব দরকার হয়েছিল নাকি?

মৈত্রেয়ী কহিল, বেশ কথা। আপনি কাল খাননি, আজ খাননি,—এ আর কেউ না জানুক আমি জানি। চলুন মার ঘরে।

কিন্তু মার দরজা ত বন্ধ।

মৈত্রেয়ী বলিল, বন্ধই ছিল, কিন্তু আমি ছাড়িনি। মাথা খোঁড়াখুঁড়ি করে দোর খুলিয়েছি, তাঁকে স্নান করিয়েছি, আহ্নিক করিয়েছি, জোর করে দুটো ফল মুখে গুঁজে দিয়ে খাইয়ে তবে ছেড়েচি। বলছিলেন, দ্বিজু না খেলে খাবেন না। বললাম, সে হবে না মা, আপনার এ আদেশ আমি মানতে পারবো না। কিন্তু তখন থেকে সবাই আমরা আপনার পথ চেয়ে আছি। চলুন, আপনার খাবার রেখে এসেছি মার ঘরে।

দ্বিজদাস অবাক হইয়া রহিল। ইহার এত কথা সে পূর্বে শোনে নাই। বলিল, চলুন।

মৈত্রেয়ী বন্দনাকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, আপনিও আসুন। মা আপনাকে ডাকছেন। এই বলিয়া সে দ্বিজদাসকে একপ্রকার গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া গেল। সকলের পিছনে গেল বন্দনা।

নিজের ঘরের মধ্যে দয়াময়ী ছিলেন বিছানায় শুইয়া। অনুজ্জ্বল দীপালোকে তাঁহার শোকাচ্ছন্ন মুখের প্রতি চাহিলে ক্লেশ বোধ হয়। পরিস্ফীত দুই চক্ষু আরক্ত, সদ্যস্নাত আর্দ্র কেশগুলি আলুথালু বিপর্যস্ত। শিয়রে বসিয়া কল্যাণী হাত বুলাইয়া দিতেছিল, অন্য দিকে একটা চেয়ারে শশধর, দূরে আর একটা চেয়ারে বসিয়া অক্ষয়বাবু। দ্বিজদাস ঘরে ঢুকিতেই দয়াময়ী মুখ ফিরিয়া শুইলেন, এবং পরক্ষণেই একটা অস্ফুট ক্রন্দনের অবরুদ্ধ আক্ষেপে তাঁহার সর্বদেহ কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল। বন্দনা নীরবে ধীরে ধীরে গিয়া তাঁহার পায়ের কাছে বসিল, এতবড় ব্যথার দৃশ্য বোধ করি সে কখনো কল্পনা করিতেও পারিত না। বহুক্ষণ পর্যন্ত সকলেই নির্বাক, এই স্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া প্রথমে কথা কহিল শশধর! বলিল, কাল থেকে শুনচি না খেয়েই আছো,—যা হোক দু’টো মুখে দাও।

দ্বিজদাস বলিল, হাঁ।

মেঝের উপর ঠাঁই করিয়া মৈত্রেয়ী সযত্নে খাবার গুছাইয়া দিতেছিল, সেইদিকে চাহিয়া শশধর পুনশ্চ কহিল, তোমার ফিরতে এত দেরি হল যে! তাঁরা গেলেন ত সেই আড়াইটার গাড়িতে?

হাঁ।

শশধর একটুখানি হাসির ভান করিয়া বলিল, অথচ, কলকাতার বাড়িটা ত শুনেচি তোমার।

দ্বিজদাস কহিল, আমার বাড়িতে দাদার প্রবেশ নিষেধ নাকি?

শশধর কহিল, তা বলিনি। বরঞ্চ তিনিই যেন এই ভাবটা দেখিয়ে গেলেন। এ বাড়ি ছেড়েও ত তাঁর যাবার দরকার ছিল না, একটা মিটমাট করে নিলেই ত পারতেন।

দ্বিজদাস বলিল, মিটমাটের পথ যদি খোলা ছিল আপনি করে নিলেন না কেন?

আমি করে নেবো? শশধর অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, এ কিরকম প্রস্তাব? আমাকে অপমান করলেন তিনি আর মিটমাট করবো আমি? মন্দ যুক্তি নয়! এই বলিয়া সে টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। হাসি থামিলে দ্বিজদাস বলিল, যুক্তি মন্দ দিইনি শশধরবাবু। মেয়েরা কথায় বলে পর্বতের আড়ালে থাকা। দাদা ছিলেন সেই পর্বত, আপনি ছিলেন তাঁর আড়ালে। এখন মুখোমুখি দাঁড়ালুম আমি আর আপনি। মান-অপমানের পালা সাঙ্গ হয়ে ত যায়নি,—মাত্র শুরু হলো।

তার মানে?

মানে এই যে, আমি আপনার বাল্যবন্ধু বিপ্রদাস নই,—আমি দ্বিজদাস।

শশধরের মুখের হাসি ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হইল, ভয়ানক গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তোমার কথার অর্থ কি বেশ খুলে বল দিকি?

দাদার বন্ধু বলিয়া শশধর ‘তুমি’ বলিয়া ডাকিলেও দ্বিজদাস তাহাকে ‘আপনি’ বলিয়াই সম্বোধন করিত, বলিল, আপনার এ কথা মানি যে অর্থ আজ স্পষ্ট হওয়াই ভালো। আমার দাদা সেই জাতের মানুষ যারা সত্যরক্ষার জন্যে সর্বস্বান্ত হয়, আশ্রিতের জন্যে গায়ের মাংস কেটে দেয়, ওদের আদর্শ বলে কি এক অদ্ভুত বস্তু আছে যার জন্যে পারে না এমন কাজ নেই,— ওরা একধরনের পাগল,—তাই এই দুর্দশা। কিন্তু আমি নিতান্ত সাধারণ মানুষ, আপনার সঙ্গে বেশী প্রভেদ নেই। ঠিক আপনার মতই আমার হিংসে আছে, ঘৃণা আছে, প্রতিশোধ নেবার শয়তানি বুদ্ধি আছে, সুতরাং দাদাকে ঠকিয়ে থাকলে আপনাকেও ঠকাবো, তাঁর নাম জাল করে থাকলে স্বচ্ছন্দে আপনাকে জেলে পাঠাবো,—অন্ততঃ চেষ্টার ত্রুটি হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না দু পক্ষই একদিন পথের ভিখিরি হয়ে দাঁড়াই। বিজ্ঞজনের মুখে শুনি এমনিই নাকি এর পরিণতি। তাই হোক।

শশধর উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, মা, শুনচেন আপনার দ্বিজুর কথা? ওর যা মুখে আসে বলতে ওকে বারণ করে দিন।

দ্বিজদাস বলিল, মাকে নালিশ জানিয়ে লাভ নেই শশধরবাবু। উনি জানেন আমি বিপিন নই,—মাতৃবাক্য দ্বিজুর বেদবাক্য নয়। দ্বিজু তাল ঠুকে স্পর্ধার অভিনয় করে না এ কথা মা বোঝেন।

0 Shares