বিপ্রদাস

কহিলেন, বেইমশাই, নমস্কার। ছেলেমেয়ের ভাগ্য যে হঠাৎ আপনার পায়ের ধূলো পড়ল।

ভদ্রলোক প্রতি-নমস্কার করিয়া কহিলেন, নানা কারণে সময় পাইনে বেন্‌ঠাকরুন, কিন্তু না বলে কয়ে এমন হঠাৎ এসে পড়ার দোষ মার্জনা করবেন। এবারে যখন আসব যথাসময়ে একটা খবর দিয়েই আসব।

দয়াময়ী এ-সব কথার উত্তর দিলেন না, শুধু বলিলেন, পূজো-আহ্নিক এখনো সারা হয়নি বেইমশাই, আবার দেখা হবে। বৌমা, এদের ওপরে নিয়ে যাও, খাওয়া-দাওয়ার যেন কষ্ট না হয়। বিপিন এলে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দিয়ো। এই বলিয়া তিনি আর কোন দিকে না চাহিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। বাহ্যতঃ, প্রচলিত সৌজন্যের বিশেষ কিছু যে ত্রুটি হইল তাহা নয়, কিন্তু ভিতরের দিক দিয়া সকলেরই মনে হইল জ্যোৎস্নার মাঝামাঝি একখণ্ড কালো মেঘ নির্মল আকাশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভাসিয়া গেল।

পরিচ্ছেদ – পাঁচ

বন্দনা স্নানাদি সারিয়া বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, পিতা ইতিপূর্বেই প্রস্তুত হইয়া লইয়াছেন। একখানা জমকালোগোছের আরামকেদারায় বসিয়া চোখে চশমা দিয়া সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করিয়াছেন। পাশের ছোট্ট টেবিলের উপর একরাশ খবরের কাগজ এবং কাছে দাঁড়াইয়া দ্বিজদাস সেইগুলির তারিখ মিলাইয়া গুছাইয়া দিতেছে। ট্রেনের মধ্যে ও কাজের ভিড়ে কয়েকদিনের কাগজ দেখিবার তাঁহার সুযোগ হয় নাই। কন্যাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া চোখ তুলিয়া কহিলেন, মা, আমরা দুটোর গাড়িতেই কলকাতা যাব স্থির করলাম। দিদির বাড়িতে দিন-কতক যদি তোমার থাকবার ইচ্ছে হয় ত ফেরবার পথে তোমাকে পোঁছে দিয়ে আমি সোজা বোম্বাই চলে যাব। কি বল?

কলকাতায় তোমার ক’দিন দেরি হবে বাবা?

পাঁচ-সাত দিন—দিন-আষ্টেক,—তার বেশী নয়।

কিন্তু তার পরে আমাকে বোম্বায়ে নিয়ে যাবে কে?

সে ব্যবস্থা একটা অনায়াসে হতে পারবে। এই বলিয়া তিনি একটু ভাবিয়া কহিলেন, তা বেশ, ইচ্ছে হয় এই ক’টা দিন তুমি সতীর কাছে থাক, ফেরবার পথে আমিই সঙ্গে করে নিয়ে যাব, কেমন?

বন্দনা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা মেজদিকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।

দ্বিজদাস কহিল, বৌদি রান্নাঘরে ঢুকেছেন, হয়ত দেরি হবে। হাতের বাণ্ডিলটা দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনাকে কি দেব?

খবরের কাগজ? ও আমি পড়িনে।

কাগজ পড়েন না?

না। ও আমার ধৈর্য থাকে না। সন্ধ্যাবেলা বাবার মুখে গল্প শুনি তাতেই আমার ক্ষিধে মিটে।

আশ্চর্য! আমি ভেবেছিলাম আপনি নিশ্চয়ই খুব বেশী পড়েন।

বন্দনা বলিল, আমার সম্বন্ধে কিছুই না জেনে অমন ভাবেন কেন? ভারী অন্যায়।

দ্বিজু অপ্রতিভ হইয়া উঠিতেছিল, বন্দনা হাসিয়া কহিল, আপনারা কে কতটা দেশোদ্ধার করলেন, এবং ইংরেজ তাতে রেগে গিয়ে কতখানি চোখ রাঙ্গালে তার কিছুতেই আমার কৌতূহল নেই। আছে বাবার। ঐ দেখুন না, একেবারে খবরের তলায় তলিয়ে গেছেন,—বাহ্যজ্ঞান নেই।

সাহেবের কানে বোধ করি শুধু মেয়ের ‘বাবা’ কথাটাই প্রবেশ করিয়াছিল, কিন্তু চোখ তুলিবার সময় পাইলেন না, বলিলেন, একটু সবুর কর—বলচি—ঠিক এই জবাবটাই আমি খুঁজছিলাম।

মেয়ে মুচকিয়া হাসিয়া ঘাড় নাড়িল, কহিল, তুমি খুঁজে খুঁজে সারাদিন পড় বাবা, আমার একটুও তাড়াতাড়ি নেই। দ্বিজদাসকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, মেজদির মুখে শুনেচি আপনার মস্ত লাইব্রেরি আছে, বরঞ্চ সেইখানে চলুন, দেখি গে আপনার কত বই জমেছে।

চলুন।

লাইব্রেরি ঘরটা তেতলায়। মস্ত চওড়া সিঁড়ি, উঠিতে উঠিতে দ্বিজদাস কহিল, লাইব্রেরি বেশ বড়ই বটে, কিন্তু আমার নয়, দাদার। আমি শুধু কোথায় কি বই বেরুলো সন্ধান নিই এবং হুকুম মত কিনে এনে দিই।

কিন্তু পড়েন ত আপনি?

সে কিছুই নয়। পড়েন যাঁর লাইব্রেরি তিনি স্বয়ং। আশ্চর্য শক্তি এবং তেমনি অদ্ভুত মেধা তাঁর।

কে? দাদা!

হ্যাঁ। ইউনিভারসিটির ছাপছোপ বিশেষ-কিছু তাঁর গায়ে লাগেনি সত্যি, কিন্তু মনে হয় এত বড় বিরাট পাণ্ডিত্য এদেশে কম লোকেরই আছে। হয়ত নেই। আপনার ভগিনীপতি তিনি, কখন দেখেন নি তাঁকে?

না। কিরকম দেখতে?

ঠিক আমার উলটো। যেমন দিন আর রাত। আমি কালো, তাঁর বর্ণ সোনার মত। গায়ের জোর তাঁর এ অঞ্চলে বিখ্যাত। লাঠি, তলোয়ার, বন্দুকে এদিকে তাঁর জোড়া নেই। একা মা ছাড়া তাঁর মুখের পানে চেয়ে কথা কইতেও কেউ সাহস করে না।

বন্দনা হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার মেজদিও না?

দ্বিজদাস বলিল, না, আপনার মেজদিও না।

ভয়ানক বদরাগী বুঝি?

না, তাও না। ইংরেজীতে যে অ্যারিস্টোক্র্যাট বলে একটা কথা আছে, আমার দাদা বোধ করি কোন জন্মে তাদেরই রাজা ছিলেন। অন্ততঃ আমার ধারণা তাই। বদরাগী কি না জিজ্ঞেসা করছিলেন? কোনরকম রাগারাগি করবার তাঁর অবকাশই হয় না।

বন্দনা কহিল, দাদার ওপর আপনার ভয়ানক ভক্তি? না?

দ্বিজদাস চুপ করিয়া রহিল। খানিক পরে বলিল, এ কথার জবাব যদি কখনো সম্ভব হয় আপনাকে আর একদিন দেব।

বন্দনা সবিস্ময়ে কহিল, তার মানে?

দ্বিজদাস ঈষৎ হাসিয়া বলিল, মানে যদি এখনই বলি, আর একদিন জবাব দেবার প্রয়োজনই হবে না। আজ থাক।

মস্ত লাইব্রেরি। যেমন মূল্যবান আলমারি টেবিল চেয়ার প্রভৃতি আসবাব, তেমনি সুশৃঙ্খলায় পরিপাটি করিয়া সাজান। পল্লীগ্রামে এত বড় একটা বিরাট কাণ্ড দেখিয়া বন্দনা আশ্চর্য হইয়া গেল। বোম্বাই শহরে এ বস্তুর অভাব নাই, সে তুলনায় এ হয়ত তেমন কিছু নয়, কিন্তু পল্লীগ্রামে বাস করিয়া কোন একজনের নিছক নিজের জন্য এত অধিক সঞ্চয় সত্যই বিস্ময়ের ব্যাপার। জিজ্ঞাসা করিল, বাস্তবিক এত বই দাদা পড়েন নাকি?

দ্বিজদাস বলিল, পড়েন এবং পড়েছেন। আলমারি বন্ধ নয়, কোন একটা বই খুলে দেখুন না, তাঁর পড়ার চিহ্ন হয়ত চোখে পড়বে।

এত সময় পান কখন? দিন-রাত শুধু এই-ই করেন নাকি?

দ্বিজু ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। অন্ততঃ আমি ত জানিনে। তা ছাড়া আমাদের বিষয়-সম্পত্তি ভীষণ কিছু একটা না হলেও নিতান্ত কমও নয়। তার কোথায় কি আছে এবং হচ্চে সমস্ত দাদার চোখের ওপর। কেবল আজ বলে নয়, বাবা বেঁচে থাকতেও এই ব্যবস্থাই বরাবর আছে। সময় পাবার রহস্য আমিও ঠিক খুঁজে পাইনে, আপনার মত আমার বিস্ময়ও কম নয়, তবে শুধু এই ভাবি যে জগতে মাঝে মাঝে দু-একজন জন্মায় তারা সাধারণ মানুষের হিসাবের বাইরে। দাদা সেই জাতীয় জীব। আমাদের মত হয়ত এঁদের কষ্ট করে পড়তেও হয় না, ছাপার অক্ষর চোখের মধ্যে দিয়ে আপনিই গিয়ে মগজে ছাপ মেরে দেয়। কিন্তু দাদার কথা এখন থাক। আপনি তাঁকে এখনো চোখে দেখেন নি, আমার মুখে একতরফা আলোচনা অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে।

0 Shares