বিপ্রদাস

মাসী স্নেহের কণ্ঠে উৎসাহ দিয়া কহিলেন, লজ্জা করো না মা, বল তোমার বাবাকে কি তোমার ইচ্ছে।

বন্দনার মুখ পলকের জন্য রাঙ্গা হইয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণে সুস্পষ্ট স্বরে বলিল, আমার ইচ্ছেকে আমি বিসর্জন দিয়েছি মাসীমা। সে খোঁজ করার দরকার নেই।

সাহেব সভয়ে কহিলেন, এর মানে?

বন্দনা বলিল, মানে ঠিক তোমাদের আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না বাবা। কিন্তু তাই বলে ভেবো না যেন আমি বাধা দিচ্চি। একটু থামিয়া কহিল, আমার সতীদিদির বিয়ে হয়েছিল তাঁর ন’বছর বয়সে। বাপ-মা যাঁর হাতে তাঁকে সমর্পণ করলেন মেজদি তাঁকেই নিলেন, নিজের বুদ্ধিতে বেছে নেননি। তবু, ভাগ্যে যাঁকে পেলেন সে স্বামী জগতে দুর্লভ। আমি সেই ভাগ্যকেই বিশ্বাস করবো বাবা। বিপ্রদাসবাবু সাধুপুরুষ, আসবার আগে আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যেখানে আমার কল্যাণ ভগবান সেখানেই আমাকে দেবেন। তাঁর সেই কথা কখনো মিথ্যে হবে না। তুমি আমাকে যা আদেশ করবে আমি তাই পালন করবো। মনের মধ্যে কোন সংশয়, কোন ভয় রাখবো না।

সাহেব বিস্ময়ে স্থির হইয়া তাহার প্রতি চাহিয়া রহিলেন, মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না।

মাসী বলিলেন, বিয়ের সময় তোমার মেজদি ছিলেন বালিকা, তাই তার মতামতের প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু তুমি তা নও, বড় হয়েছো, নিজের ভাল-মন্দের দায়িত্ব তোমার নিজের। এমন চোখ বুজে ভাগ্যের খেলা ত তোমার সাজে না বন্দনা।

সাজে কিনা জানিনে মাসীমা, কিন্তু তাঁর মতো তেমনি করেই ভাগ্যকে আমি প্রসন্নমনে মেনে নেবো।

কিন্তু এমন উদাসীনের মতো কথা বললে তোমার বাবা মনস্থির করবেন কি করে?

যেমন করে ওঁর দাদা করেছিলেন সতীদিদির সম্বন্ধে, যেমন করে ওঁর সকল পূর্বপুরুষরাই দিয়েছিলেন তাঁদের ছেলে-মেয়ের বিবাহ, আমার সম্বন্ধেও বাবা তেমনি করেই মনঃস্থির করুন।

তুমি নিজে কিছুই দেখবে না, কিছুই ভাববে না?

ভাবা-ভাবি, দেখা-দেখি অনেক দেখলুম মাসীমা। আর না। এখন নির্ভর করবো বাবার আশীর্বাদে আর সেই ভাগ্যের পরে যার শেষ কেউ আজও দেখতে পায়নি।

মাসী হতাশ হইয়া একটুখানি তিক্তকণ্ঠে বলিলেন, ভাগ্যকে আমরাও মানি, কিন্তু তোমার সমাজ, শিক্ষা, সংস্কার সব ডুবিয়ে দিয়ে মুখুয্যেদের এই ক’দিনের সংস্রব যে তোমাকে এতখানি আচ্ছন্ন করবে তা ভাবিনি। তোমার কথা শুনলে মনে হয় না যে তুমি আমাদের সেই বন্দনা। যেন একেবারে আমাদের থেকে পর হয়ে গেছো।

বন্দনা বলিল, না মাসীমা, আমি পর হয়ে যাইনি। তাঁদের আপনার করতে আমার কাউকে পর করতে হবে না এ কথা নিশ্চয় জেনে এসেছি। আমাকে নিয়ে তোমরা কোন শঙ্কা করো না।

মাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহলে অশোককে আসতে একটা টেলিগ্রাম করে দিই?

দাও। আমার কোন আপত্তি নেই। এই বলিয়া বন্দনা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

মিস্টার রে, আপনার নাম করেই তবে টেলিগ্রামটা পাঠাই—বলিয়া মাসী মুখ তুলিয়া সবিস্ময়ে দেখিলেন সাহেবের দুই চোখ অকস্মাৎ বাষ্পাকুল হইয়া উঠিয়াছে। ইহার কারণ খুঁজিয়া পাইলেন না এবং সাহেব ধীরে ধীরে যখন বলিলেন, টেলিগ্রাম আজ থাক মিসেস ঘোষাল, তখনও হেতু বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, থাকবে কেন মিস্টার রে, বন্দনা ত সম্মতি দিয়ে গেল।

না না, আজ থাক, বলিয়া তিনি নির্বাক হইয়া রহিলেন। এই নীরবতা এবং ঐ অশ্রুজল মাসীকে ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করিল। একজন প্রবীণ পদস্থ লোকের এইরূপ সেন্টিমেন্টালিটি তাঁহার অসহ্য। কিন্তু জিদ করিতেও সাহস করিলেন না। মিনিট-দুই চুপ করিয়া থাকিয়া সাহেব বলিলেন, ওর বাপের ভাবনা আমি ভেবেচি, কিন্তু ওর মা নেই, তাঁর ভাবনাও আমাকেই ভাবতে হবে মিসেস ঘোষাল। একটু সময় চাই।

মাসী মনে মনে বলিলেন, আর একটা স্টুপিড সেন্টিমেন্টালিটি। সাহেব অনুমান করিলেন কিনা জানি না, কিন্তু এবার জোর করিয়া একটু ম্লান হাসিয়া বলিলেন, মুশকিল হয়েছে ওর কথা আমরা কেউ ভালো বুঝতে পারিনে। শুধু আজ নয়, বাঙলা থেকে আসা পর্যন্তই মনে হয় ঠিক যেন ওকে বুঝতে পারিনে। ও সম্মতি দিলে বটে, কিন্তু সে-ও, না ওর নতুন রিলিজন ভেবেই পেলুম না।

নতুন রিলিজন? মানে?

মানে আমিও জানিনে। কিন্তু বেশ দেখতে পাই বাঙলা থেকে ও কি যেন একটা সঙ্গে করে এনেছে, সে রাত্রি-দিন থাকে ওকে ঘিরে। ওর খাওয়া গেছে বদলে, কথা গেছে বদলে, ওর চলা-ফেরা পর্যন্ত মনে হয় যেন আগেকার মতো নেই। ভোরবেলায় স্নান করে আমার ঘরে গিয়ে পায়ের ধুলো মাথায় নেয়। বলি, বুড়ী, আগে ত তুই এ-সব করতিস নে?

তখন জানতুম না বাবা। এখন তোমার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে দিন আরম্ভ করি, বেশ বুঝতে পারি সে আমাকে সমস্ত দিন সমস্ত কাজে রক্ষে করে চলে। বলিতে বলিতে তাঁহার চক্ষু পুনরায় অশ্রুসজল হইয়া উঠিল।

মাসী মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, এ-সব নতুন ধাঁচা শিখে এসেছে ও মুখুয্যেদের বাড়িতে। জানেন ত তাঁরা কি রকম গোঁড়া। কিন্তু একে রিলিজন বলে না, বলে কুসংস্কার। ও পূজোটুজো করে নাকি?

সাহেব বলিলেন, জানিনে করে কিনা। হয়ত করে না। কুসংস্কার বলে আমারও মনে হয়েছে, নিষেধ করতেও গেছি, কিন্তু বুড়ী আগেকার মতো আর ত তর্ক করে না, শুধু চুপ করে চেয়ে থাকে। আমারও মুখ যায় বন্ধ হয়ে—কিছুই বলতে পারিনে।

মাসী বলিলেন, এ আপনার দুর্বলতা। কিন্তু নিশ্চিত জানবেন একে রিলিজন বলে না, বলে শুধু সুপারস্টিশন। একে প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায়! অপরাধ!

সাহেব দ্বিধাভরে আস্তে আস্তে বলিলেন, তাই হবে বোধ হয়। রিলিজন কথাটা মুখেই বলি, কখনো নিজেও চর্চা করিনি, এর নেচার কি তা—ও জানিনে, শুধু মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি মেয়েটাকে এমন আগাগোড়া বদলে দিলে কিসে? সে হাসি নেই, আনন্দের চঞ্চলতা নেই, বর্ষাদিনের ফুটন্ত ফুলের মতো পাপড়িগুলি যেন জলে ভিজে। কখনো ডেকে বলি, বুড়ী, আমাকে লুকোস নে মা, তোর ভেতরে ভেতরে কোন অসুখ করেনি ত? অমনি হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, না বাবা, আমি ভালো আছি, আমার কোন অসুখ নেই। হাসিমুখে ঘরের কাজে চলে যায়, আমার কিন্তু বুকের পাঁজর ভেঙ্গে পড়তে চায় মিসেস ঘোসাল। ঐ একটি মেয়ে, মা নেই, নিজের হাতে মানুষ করে এতবড়টি করেছি,—সর্বস্ব দিয়েও যদি আমার সেই বন্দনাকে আবার তেমনি ফিরে পাই—

0 Shares