বিপ্রদাস

বন্দনা মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এ কথা আর কেউ জানে?

কেউ না। শুধু আমি জানি লুকিয়ে শুনেছিলাম বলে।

বন্দনা বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া অস্ফুটে কহিল, সত্যই আপনার দাদা অসাধারণ মানুষ।

দ্বিজদাস শান্তভাবে শুধু বলিল, হাঁ। কিন্তু এখন আমি নীচে যাই, আমার অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। আপনি বসে বসে বই পড়ুন যতক্ষণ না ডাক পড়ে।

বন্দনা হাসিয়া কহিল, এখন বই পড়বার রুচি নেই, চলুন আমিও যাই। অন্ততঃ আট-দশদিন ত এখানে আছি, – বই পড়বার অনেক সময় পাব।

দ্বিজদাস চলিতে উদ্যত হইয়াছিল, থমকিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার বাবার সঙ্গে আজ কলকাতা যাবেন না?

না। তাঁর ফেরবার পথে বোম্বায়ে চলে যাব।

দ্বিজদাস কহিল, বরঞ্চ আমি বলি তাঁর ফেরবার পথেই আপনি কিছুদিন এখানে থেকে যাবেন।

বন্দনা কহিল, প্রথমে সেই ইচ্ছেই ছিল, কিন্তু এখন দেখচি তাতে ঢের অসুবিধে। আমাকে পৌঁছে দেবার কেউ নেই। কিন্তু আপনি যদি রাজী হন, আপনার পরামর্শই শুনি।

কিন্তু আমি ত তখন থাকব না। এই সোমবারে মাকে নিয়ে কৈলাস তীর্থে যাত্রা করব।

বন্দনার দুই চক্ষু আনন্দে ও উৎসাহে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল—কৈলাস? কৈলাসে যাবেন? শুনেচি সে নাকি এক পরমাশ্চর্য বস্তু। সঙ্গে আপনাদের আর কে কে যাবেন?

ঠিক জানিনে, বোধ হয় আরও কেউ কেউ যাবেন।

আমাকে সঙ্গে নেবেন?

দ্বিজদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা ক্ষুণ্ণ অভিমানের কণ্ঠে জোর করিয়া হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, আর এই জন্যেই বুঝি ঠিক সেই সময়ে আমাকে এখানে এসে থাকবার সুপরামর্শ দিচ্চেন?

দ্বিজদাস তাঁহার মুখের পানে চোখ তুলিয়া শান্তভাবে কহিল, সত্যিই এই জন্যে পরামর্শ দিয়েছি। বৌদি এত কথা লিখেচেন, কেবল এই খবরটিই দেননি যে আমাদের এটা কতবড় গোঁড়া হিন্দুর বাড়ি? এর আচার-বিচারের কঠোরতার কোন আভাস চিঠিতে পাননি?

বন্দনা মাথা নাড়িয়া কহিল, না।

না? আশ্চর্য! একটুখানি থামিয়া দ্বিজদাস বলিল, একা আমি ছাড়া আপনার ছোঁয়া জল পর্যন্ত খাবার লোক এ বাড়িতে কেউ নেই।

কিন্তু দাদা?

না।

মেজদি?

না, তিনিও না। আমরা চলে গেলে তবুও হয়ত দুদিন এখানে থাকতে পারেন, কিন্তু মা থাকতে একটা দিনও আপনার এ বাড়িতে থাকা চলে না।

বন্দনার মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল—সত্যি বলচেন?

সত্যিই বলচি।

ঠিক এমনি সময়ে নীচের সিঁড়ি হইতে সতীর ডাক শোনা গেল,—ঠাকুরপো! বন্দনা! তোমরা দুটিতে করচ কি?

যাচ্চি বৌদি,—সাড়া দিয়া দ্বিজদাস দ্রুতপদে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইল, বন্দনা পাংশুমুখে চাপাকণ্ঠে শুধু কহিল, এত কথা আমি কিছুই জানতুম না। ধন্যবাদ।

পরিচ্ছেদ – ছয়

বন্দনা নীচে আসিয়া দেখিল পিতা হৃষ্টচিত্তে আহারে বসিয়াছেন। সেই বসিবার ঘরের মধ্যেই একখানি ছোট টেবিলের উপর রূপার থালায় করিয়া খাবার দেওয়া হইয়াছে। একজন দীর্ঘাকৃতি অতিশয় সুশ্রী ব্যক্তি অদূরে দাঁড়াইয়া আছেন,—তাঁহার দেহের শক্তিমান গঠন ও অত্যন্ত ফরসা রং দেখিয়াই বন্দনা চিনিল যে ইনিই বিপ্রদাস। সতী সঙ্গেই আসিতেছিল, কিন্তু সে প্রবেশ করিল না, দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া প্রণাম করিতে ইঙ্গিত করিয়া জানাইল যে, হাঁ ইনিই।

বাঙালীর মেয়েকে ইহা শিখাইবার কথা নহে এবং ইতিপূর্বে মাকে যেমন সে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়াছিল, বড়ভগিনীপতিকেও তাহাই করিত কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন তাহার সমস্ত মন বিদ্রোহ করিয়া উঠিল। ইঁহার অনন্যসাধারণ বিদ্যা ও বুদ্ধির বিবরণ দ্বিজদাসের মুখে না শুনিলে হয়ত এই প্রচলিত শিষ্টাচার লঙ্ঘন করিবার কথা তাহার মনেও উঠিত না, কিন্তু এই পরিচয়ই তাহাকে কঠিন করিয়া তুলিল। দিদির মর্যাদা রক্ষা করিয়া সে হাত তুলিয়া একটা নমস্কার করিল বটে, কিন্তু তাহার উপেক্ষাটাই তাহাতে স্পষ্টতর হইয়া উঠিল, কথা কহিল সে পিতার সঙ্গেই, বলিল, তুমি একলা খেতে বসেচ, আমাকে ডেকে পাঠাও নি কেন?

সাহেব মুখ তুলিয়া চাহিলেন, বলিলেন, আমার যে গাড়ির সময় হ’লো মা, কিন্তু তোমার ত তাড়াতাড়ি নেই। বলিলেন,—আমি চলে গেলে তোমরা ধীরে-সুস্থে খাওয়া-দাওয়া করতে পারবে।

সতী আড়াল হইতে ঘাড় নাড়িয়া ইহার অনুমোদন করিল। বন্দনা তাহাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, মেজদি এতগুলো দামী রূপোর বাসন নষ্ট করলে কেন, বাবাকে এনামেল কিংবা চিনেমাটির বাসনে খেতে দিলেই ত হত?

সাহেবের চিবানো বন্ধ হইল। অত্যন্ত সরল-প্রকৃতির মানুষ তিনি, কন্যার কথার তাৎপর্য কিছুই বুঝিলেন না, ব্যস্ত এবং লজ্জিত হইয়া উঠিলেন—যেন দোষটা তাঁহার নিজেরই—তাইত, তাইত—এ আমি লক্ষ্য করিনি,—সতী কোথা গেলে—আমাকে ডিসে খেতে দিলেই হত—এঃ—

বিপ্রদাসের মুখ ক্রোধে কঠোর ও গম্ভীর হইয়া উঠিল। এতাবৎ এত বড় অপমান করিতে তাহাকে কেহ সাহস করে নাই, এই নবাগত কুটুম্ব মেয়েটি তাহাকে যেমন করিল। বাসন নষ্ট হইবার দুশ্চিন্তা একটা ছলনা মাত্র। আসলে ইহা তাহাদের আচারনিষ্ঠ পরিবারের প্রতি নির্লজ্জ ব্যঙ্গ, এবং খুব সম্ভব তাহাকেই উদ্দেশ করিয়া এ দুরভিসন্ধি কে তাহার মাথায় আনিয়া দিল বিপ্রদাস ভাবিয়া পাইল না, কিন্তু যেই দিক, এই ভাল-মানুষ বৃদ্ধ ব্যক্তিটিকে উপলক্ষ সৃষ্টি করার কদর্যতায় তাহার বিরক্তির অবধি রহিল না। কিন্তু সে ভাব দমন করিয়া জোর করিয়া একটুখানি হাসিয়া কহিল, তোমার দিদির কাছে শোনোনি যে, এ গোঁড়া হিন্দুর বাড়ি? এখানে এনামেল বল, চিনেমাটিই বল কিছুই ঢোকবার জো নেই—শোনোনি?

বন্দনা কহিল, কিন্তু দামী পাত্রগুলো ত নষ্ট হয়ে গেল?

সাহেব ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু শুনেচি ঘি মাখিয়ে একটুখানি পুড়িয়ে নিলেই—

বিপ্রদাস এ কথায় কান দিল না, যেমন বলিতেছিল তেমনি বন্দনাকেই লক্ষ্য করিয়া কহিল, এ বাড়িতে রূপোর বাসনের অভাব নেই, কিন্তু বিশেষ কোন কাজে লাগে না। তোমার বাবা সম্বন্ধে আমার গুরুজন, এ বাড়িতে অত্যন্ত সম্মানিত অতিথি, রূপোর বাসনের যত দামই হোক, তাঁর মর্যাদার কাছে একেবারেই তুচ্ছ,—তোমাদের আসার উপলক্ষে কতকগুলো যদি নষ্ট হয়েই যায়,—যাক না। এই বলিয়া একটু মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, তোমার দিদির মত তোমারও যদি কোন গোঁড়াদের বাড়িতে বিয়ে হয়, তোমার বাবা এলে তাঁকে মাটির সরাতে খেতে দিয়ো, ফেলা গেলে কারও গায়ে লাগবে না। কি বল বন্দনা?

0 Shares