বিপ্রদাস

ইস, তাই বৈ কি! বাবার জন্যে আমি সোনার পাত্র গড়িয়ে রেখে দেব।

বিপ্রদাস হাসিমুখে উত্তর দিল, সে তুমি পারবে না। যে পারে সে বাপের সম্বন্ধে অমন কথা মুখে আনতেও পারে না। এমন কি অপরকে অপমান করার জন্যেও না। তোমার বাবাকে তুমি যত ভালবাস, আর একজন তার কাকাকে বোধ করি তার চেয়েও বেশী ভালবাসে।

শুনিয়া সাহেবের মনের উপর হইতে যে একটা ভার নামিয়া গেল তাই নয়, সমস্ত অন্তর খুশীতে ভরিয়া গেল। বলিলেন, তোমার এই কথাটা বাবা ভারী সত্যি। দাদা যখন হঠাৎ মারা গেলেন তখন সতী খুবই ছোট, বিদেশে চাকুরি নিয়ে থাকি, সর্বদা বাড়ি আসা ঘটে না, আর এলেও সমাজের শাসনে একলাটি থাকতে হয়, কিন্তু সতী ফাঁক পেলেই আমার কাছে ছুটে আসত,—

বন্দনা তাড়াতাড়ি বাধা দিল,—ও-সব কথা থাক না বাবা—

না না, আমার যে সমস্তই মনে আছে,—মিথ্যে ত নয়। একদিন আমার সঙ্গে একপাতে খেতেই বসে গেল—তার মা ত এই দেখে—

আঃ, বাবা, তুমি যে কি বল তার ঠিকানা নেই। কবে আবার মেজদি তোমার সঙ্গে,—তোমার কিচ্ছু মনে নেই।

সাহেব মুখ তুলিয়া প্রতিবাদ করিলেন,—বাঃ মনে আছে বৈ কি। আর পাছে এই নিয়ে একটা গোলমাল হয়, তাই তোমার মা সেদিন কিরকম ভয়ে ভয়ে—

বন্দনা বলিল, বাবা, আজ তুমি নিশ্চয় গাড়ি ফেল করবে। ক’টা বেজেচে জান?

সাহেব ব্যস্ত হইয়া পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিলেন, সময় দেখিয়া নিরুদ্বেগের নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তুই এমন ভয় লাগিয়ে দিস যে চমকে উঠতে হয়। এখনো ঢের দেরি—অনায়াসে গাড়ি ধরা যাবে।

বিপ্রদাস সহাস্যে সায় দিয়া বলিল, হাঁ গাড়ির এখনো ঢের দেরি। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে আহার করুন, আমি নিজে স্টেশনে গিয়ে আপনাকে তুলে দিয়ে আসব। এই বলিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

দ্বারের আড়াল হইতে সতী নিকটে আসিয়া দাঁড়াইতেই বন্দনা অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, মেজদি, বাবা কি কাণ্ড করলেন শুনেচ?

সতী মাথা নাড়িয়া বলিল, হাঁ।

বন্দনা বলিল, তোমার শাশুড়ীর কানে গেলে হয়ত তোমাকে দুঃখ পেতে হবে। না মেজদি?

সতী কহিল, হয় হবে। এখন থাক, কাকা শুনতে পাবেন।

কিন্তু তোমার স্বামী—তিনিও যে নিজের কানেই সমস্ত শুনে গেলেন, এ অপরাধের মার্জনা বোধকরি তাঁর কাছেও নেই?

সতী হাসিল, কহিল, অপরাধ যদি সত্যিই হয়ে থাকে আমিই বা মার্জনা চাইব কেন? সে বিচার আমি তাঁর পরেই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আছি। যদি থাক, নিজের চোখেই দেখতে পাবে। কাকা, তোমাকে আর কি এনে দেব বল?

সাহেব মুখ তুলিয়া কহিলেন, যথেষ্ট যথেষ্ট—আমার খাওয়া হয়ে গেছে মা, আর কিছুই চাইনে। এই বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

ক্রমশঃ স্টেশনে যাত্রা করিবার সময় হইয়া আসিল; নীচে গাড়িবারান্দায় মোটর অপেক্ষা করিতেছে, বিছানা ব্যাগ প্রভৃতি আর একখানা গাড়িতে চাপানো হইয়াছে, সাহেব নিকটে দাঁড়াইয়া বিপ্রদাসের সহিত কথা কহিতেছেন, এমনি সময়ে বন্দনা কাপড় পরিয়া প্রস্তুত হইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। কহিল, বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব।

পিতা বিস্মিত হইলেন—এই রোদে স্টেশনে গিয়ে লাভ কি মা?

বন্দনা বলিল, শুধু স্টেশনে নয়, কলকাতায় যাব। যখন বোম্বায়ে যাবে, আমি তোমার সঙ্গেই চলে যাব।

বিপ্রদাস অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, সে কি কথা! তুমি দিন-কতক থাকবে বলেই ত জানি।

বন্দনা উত্তরে শুধু কহিল, না।

কিন্তু তোমার ত এখনো খাওয়া হয়নি?

না, দরকার নেই। কলকাতায় পৌঁছে খাব।

তুমি চলে যাচ্ছ তোমার মেজদি শুনেছেন?

বন্দনা কহিল, ঠিক জানিনে, আমি চলে গেলেই শুনতে পাবেন।

বিপ্রদাস বলিলেন, তুমি না খেয়ে অমন করে চলে গেলে সে ভারী কষ্ট পাবে।

বন্দনা মুখ তুলিয়া বলিল, কষ্ট কিসের? আমাকে ত তিনি নেমন্তন্ন করে আনেন নি যে না খেয়ে চলে গেলে তাঁর আয়োজন নষ্ট হবে। তিনি নির্বোধ নন, বুঝবেন। এই বলিয়া সে আর কথা না বাড়াইয়া দ্রুতপদে গাড়িতে গিয়া বসিল।

সাহেব মনে মনে বুঝিলেন কি একটা হইয়াছে। না হইলে হঠাৎ অকারণে কোন-কিছু করিয়া ফেলিবার মেয়ে সে নয়। শুধু বলিলেন, আমিও জানতাম ও দিন-কয়েক সতীর কাছেই থাকবে। কিন্তু একবার যখন গাড়িতে গিয়ে উঠেচে তখন আর নামবে না।

বিপ্রদাস জবাব দিলেন না, নিঃশব্দে তাঁহার পিছনে পিছনে গিয়া মোটরে উঠিলেন।

গাড়ি ছাড়িয়া দিল। অকস্মাৎ উপরের দিকে চাহিতেই বন্দনা দেখিতে পাইল তেতলার লাইব্রেরি-ঘরের খোলা-জানালার গরাদে ধরিয়া দ্বিজদাস চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। চোখাচোখি হইতেই সে হাত তুলিয়া নমস্কার করিল।

পরিচ্ছেদ – সাত

স্টেশনে পৌঁছিয়া খবর পাওয়া গেল, কোথায় কি একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনের আজ বহু বিলম্ব,—বোধ করি বা একঘণ্টারও বেশী লেট হইবে। পরিচিত স্টেশনমাস্টারটিও হঠাৎ পীড়িত হওয়ায় একজন মাদ্রাজী রিলিভিং হ্যান্ড কাল হইতে কাজ করিতেছিল, সে সঠিক সংবাদ কিছু দিতে পারিল না, শুধু অনুমান করিল যে, দেরি একঘণ্টাও হইতে পারে, দু-ঘণ্টাও হইতে পারে। বিপ্রদাস সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, কলকাতায় পৌঁছতে রাত্রি হয়ে যাবে, আজ কি না গেলেই চলে না?

কেন চলবে না? আমার ত—

বন্দনা বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না বাবা, সে হয় না। একবার বেরিয়ে এসে আর ফিরে যাওয়া চলে না।

বিপ্রদাস অনুনয়ের সুরে কহিল, কেন চলবে না বন্দনা? বিশেষতঃ তুমি না খেয়ে এসেচ, সারাদিন কি উপোস করেই কাটাবে?

বন্দনা মাথা নাড়িয়া বলিল, আমার ক্ষিদে নেই। ফিরে গেলেও আমি খেতে পারব না।

সাহেব মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইলেন, কহিলেন, এদের শিক্ষাদীক্ষাই আলাদা। একবার জিদ ধরলে আর টলান যায় না।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল, আর অনুরোধ করিল না।

স্টেশনটি বড় না হইলেও একটি ছোটগোছের ওয়েটিং রুম ছিল। সেখানে গিয়া দেখা গেল, একজন ছোকরা বয়সের বাঙালী-সাহেব ও তাঁহার স্ত্রী ঘরখানি পূর্বাহ্ণেই দখলে আনিয়াছেন। সাহেব সম্ভবতঃ ব্যারিস্টার কিংবা ডাক্তার কিংবা বিলাতী পাশকরা প্রফেসারও হইতে পারেন। এ অঞ্চলে কোথায় আসিয়াছিলেন, সে একটা রহস্য। আরামকেদারার দুই হাতলে পদদ্বয় দীর্ঘপ্রসারিত করিয়া অর্ধসুপ্ত। আকস্মিক জনসমাগমে মাত্র চক্ষুরুন্মীলন করিলেন—ভদ্রতা-প্রকাশের উদ্যম ইহার অধিক অগ্রসর হইল না। কিন্তু মহিলাটি চেয়ার ছাড়িয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। হয়ত মেমসাহেব হইয়া উঠিতে তখনও পারেন নাই, কিন্তু উঁচু গোড়ালির জুতা ও পোশাক-পরিচ্ছদের ঘটা দেখিয়া মনে হয়, এ-বিষয়ে চেষ্টার ত্রুটি হইতেছে না।

0 Shares