বিরাজবৌ

লাগুক—বল কি হয়েচে?

বিরাজ শুষ্কভাবে একটুখানি হাসিয়া বলিল, কৈ, কিছুই ত হয়নি, বেশ আছি।

নীলাম্বর অবিশ্বাস করিয়া বলিল, না, কিছুতেই তুমি বেশ নেই। না হলে, কখন তুমি সেই কত বৎসরের পুরনো কথা তুলে আমার মনে কষ্ট দিতে না—বিশেষ যার জন্যে কতদিন, কত মাপ চেয়েচি।

আচ্ছা, আর কোন দিন বলব না,—বলিয়া নিজেকে মুক্ত করিয়া ঈষৎ সরিয়া বসিল।

নীলাম্বর তাহার কথার অর্থ বুঝিল, কিন্তু আর কিছু বলিল না। তার পর মিনিট দুই-তিন চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া উঠিয়া গেল।

রাত্রে প্রদীপের আলোকে বসিয়া বিরাজ চিঠি লিখিতেছিল। নীলাম্বর খাটের উপর শুইয়া নিঃশব্দে তাহাই দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে সহসা বলিয়া উঠিল এ জন্মে তোমার ত কোন দোষ-অপরাধ শত্রুতেও দিতে পারে না, কিন্তু তোমার পূর্বজন্মের পাপ ছিল, না হলে কিছুতেই এমন হ’ত না।

বিরাজ মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হ’ত না?

নীলাম্বর কহিল, তোমার সমস্ত দেহ-মন ভগবান রাজরানীর উপযুক্ত করে গড়ে ছিলেন, কিন্তু—

কিন্তু কি?

নীলাম্বর চুপ করিয়া রহিল।

বিরাজ একমুহুর্ত উত্তরের আশায় থাকিয়া রুক্ষস্বরে বলিল, এ খবর কখন তোমাকে ভগবান দিয়ে গেলেন?

নীলাম্বর কহিল, চোখ-কান থাকলে ভগবান সকলকেই খবর দেন।

বিরাজ ‘হুঁ’ বলিয়া চিঠি লিখিতে লাগিল।

নীলাম্বর ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, তখন বলছিলে, আমি কোন কথা তোমার শুনিনে, হয়ত তাই সত্যি, কিন্তু তা কি শুধু একলা আমারই দোষ?

বিরাজ আবার মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, বেশ ত, আমার দোষটাই দেখিয়ে দাও?

নীলাম্বর বলিল, তোমার দোষ দেখাতে পারব না; কিন্তু আজ একটা সত্যি কথা বলব। তুমি নিজের সঙ্গে অপরের তুলনা করেই দেখ। কিন্তু এটা ত একবার ভেবে দেখ না, তোমার মত ক’টা মেয়েমানুষ এমন নির্গুণ মূর্খের হাতে পড়ে? এইটেই তোমার পূর্বজন্মের পাপ, নইলে তোমার ত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করবার কথা নয়।

বিরাজ নি:শব্দে চিঠি লিখিতে লাগিল। বোধ করি সে মনে করিল ইহার জবাব দিবে না; কিন্তু থাকিতে পারিল না। মুখ ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি মনে কর, এই সব কথা শুনে আমি খুশী হই?

কি সব কথা?

বিরাজ বলিল, এই যেমন রাজরানী হতে পারতুম—শুধু তোমার হাতে পড়েই এমন হয়েছি, এই সব; মনে কর, এ শুনলে আমার আহ্লাদ হয়, না যে বলে তার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে?

নীলাম্বর দেখিল, বিরাজ অত্যন্ত রাগিয়া গিয়াছে। ব্যাপারটা এইরূপ হইয়া দাঁড়াইবে সে আশা করে নাই, তাই মনে মনে সঙ্কুচিত এবং কুন্ঠিত হইয়া পড়িল; কিন্তু কি বলিয়া প্রসন্ন করিবে, সহসা তাহাও ভাবিয়া পাইল না।

বিরাজ বলিল, রূপ, রূপ, রূপ। শুনে শুনে কান আমার ভোঁতা হয়ে গেল। আর যারা বলে, তাদের না হয় এইটেই সব চেয়ে বেশী চোখে পড়ে, কিন্তু তুমি স্বামী, এতটুকু বয়স থেকে তোমাকে ধরে এত বড় হয়েচি, তুমিও কি এর বেশী আমায় আর কিছু দেখ না? এইটেই কি আমার সবচেয়ে বড় বস্তু? তুমি কি বলে এ কথা মুখে আন? আমি কি রূপের ব্যবসা করি, না, এই দিয়ে তোমাকে ভুলিয়ে রাখতে চাই?

নীলাম্বর অত্যন্ত ভয় পাইয়া থতমত খাইয়া বলিতে গেল, না না—

বিরাজ কথার মাঝেই বলিয়া উঠিল, ঠিক তাই, সেই জন্যেই একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলুম, আমি কালো-কুচ্ছিত হলে ভালবাসতে কিনা! মনে পড়ে?

নীলাম্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, পড়ে, কিন্তু তুমিই ত তখন বলেছিলে—

বিরাজ বলিল, হাঁ বলেছিলুম, আমি কালো-কুচ্ছিত হলেও ভালবাসতে, কেননা, আমাকে বিয়ে করেচ। গেরস্তর মেয়ে, গেরস্তর বউ, আমাকে এ-সব কথা শোনাতে তোমার লজ্জা করে না? এর পূর্বেও আমাকে তুমি এ কথা বলেচ।—বলিতে বলিতে তাহার ক্রোধে অভিমান চোখে জল আসিয়া পড়িল, এবং সে জল প্রদীপের আলোকে চকচক করিয়া উঠিল। নীলাম্বর দেখিতে পাইয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল।

বিরাজ নিজেই একদিন বলিয়া দিয়াছিল, তিনি হাত ধরিলে আর তাহার রাগ থাকে না।

নীলাম্বর সেই কথা হঠাৎ স্মরণ করিয়া উঠিয়া আসিয়া তাহার ডান হাতখানি নিজের দুই হাতের মধ্যে লইয়া পার্শ্বে উপবেশন করিয়া চুপ করিয়া রহিল।

বিরাজ বাঁ হাত দিয়া নিজের চোখের জল মুছিয়া ফেলিল।

সেই রাত্রে বহুক্ষণ পর্যন্ত উভয়েই নিঃশব্দে জাগিয়া ছিল। এক সময়ে নীলাম্বর সহসা স্ত্রীর দিকে মুখ ফিরাইয়া মৃদুকন্ঠে বলিল, আজ কেন অত রাগ, বিরাজ?

বিরাজ জবাব দিল, কেন তুমি ও-সব কথা বললে?

নীলাম্বর বলিল, আমি ত মন্দ কথা বলিনি!

বিরাজ অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল, অধীরভাবে বলিল, তবু বলবে মন্দ কথা নয়? খুব মন্দ কথা। অত্যন্ত মন্দ কথা। ওই জন্যেই সুন্দরীকে—

সে আর বলিল না, চুপ করিয়া গেল।

নীলাম্বর ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, শুধু এই দোষে তাকে তাড়িয়ে দিলে?

বিরাজ ‘হুঁ’ বলিয়া চুপ করিল।

নীলাম্বর আর প্রশ্ন করিল না।

তখন বিরাজ নিজেই বলিল, দেখ, জেরা ক’রো না—আমি কচি খুকি নই—ভালমন্দ বুঝি। তাড়াবার মত দোষ করেছে বলেই তাড়িয়েচি। কেন, কি বৃত্তান্ত, এত কথা তুমি পুরুষমানুষ নাই শুনলে!

না, আর অত শুনতে চাইনে, বলিয়া নীলাম্বর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে পাশ ফিরিয়া শুইল।

পৃথগন্ন হইবার দুই-চারি দিন পরেই ছোটভাই পীতাম্বর বাটীর মাঝখানে দরমা ও ছেঁচা বাঁশের বেড়া দিয়া নিজের অংশ আলাদা করিয়া লইয়াছিল। দক্ষিণ দিকে দরজা ফুটাইয়া এবং তাহারই সম্মুখে একটি ছোট বৈঠকখানা-ঘর করিয়া সে সর্বরকমে নিজের বাড়িটিকে বেশ মানানসই ঝরঝরে করিয়া লইয়া মহা আরামে জীবন-যাপন করিতেছিল। কোনদিনই প্রায় সে দাদার সহিত বড় একটা কথাবার্তা বলিত না। এখন সমস্ত একেবারে ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল। এদিকে বিরাজকে প্রায় সমস্তদিন একলাটি কাটাইতে হইত। সুন্দরী যাওয়ার পর হইতে শুধু যে সমস্ত কাজকর্ম তাহাকেই করিতে হইত তাহা নহে; যে-সব কাজ পূর্বে দাসীতে করিত, সেইগুলো লোকলজ্জাবশতঃ লোকচক্ষুর অন্তরালেই তাহাকে সমাধা করিয়া লইবার জন্য অনেক রাত্রি পর্যন্ত জাগিয়া থাকিতে হইত। এমনই একদিন কাজ করিতেছিল, অকস্মাৎ ও-বাড়ি হইতে বেড়ার ফাঁক দিয়া অতি মৃদুকন্ঠে ডাক আসিল, দিদি!

0 Shares