বিরাজবৌ

বাড়ি ফিরিয়া দেখিল নীলাম্বর আসিয়াছে। স্বামীকে সে তিন দিন দেখে নাই, চোখ পড়িবামাত্রই দেহের প্রতি রক্তবিন্দুটি পর্যন্ত উদ্দাম হইয়া উঠিয়া একটা দুনির্বার আকর্ষণ প্রচন্ড গতিতে ক্রমাগত ঐদিকে টানতে লাগিল, কিন্তু, এখন আর তাহাকে এক-পা টলাইতে পারিল না।

তীব্র তড়িৎ-সংস্পর্শে ধাতু যেমন শক্তিময় হইয়া উঠে, স্বামীকে কাছে পাইয়া চক্ষের নিমেষে সে তেমনই শক্তিময়ী হইয়া উঠিয়াছিল। সমস্ত আকর্ষণের বিরুদ্ধে সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

নীলাম্বর একটিবার-মাত্র মুখ তুলিয়াই ঘাড় হেঁট করিয়াছিল—সেই দৃষ্টিতেই বিরাজ দেখিয়াছিল, তাঁহার দুই চোখ জবার মত ঘোর রক্তবর্ণ—মড়া পোড়াইতে গিয়ে তাহারা যে এই তিন দিন অবিশ্রাম গাঁজা খাইয়াছে, সে কথা তাহার অগোচরে রহিল না। মিনিট পাঁচছয় এইভাবে থাকিয়া কাছে সরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, খাওয়া হয়নি?

নীলাম্বর বলিল, না।

বিরাজ আর কোন প্রশ্ন না করিয়া রান্নাঘরে যাইতেছিল, নীলাম্বর সহসা ডাকিয়া বলিল, শোন, এত রাত্তিরে একা কোথায় গিয়েছিলে?

বিরাজ দাঁড়াইয়া পাড়িয়া একমুহুর্ত ইতস্ততঃ করিয়া বলিল,—ঘাটে।

নীলাম্বর অবিশ্বাসের স্বরে বলিল, না, ঘাটে তুমি যাও নি।

তবে যমের বাড়ি গিয়েছিলুম, বলিয়া বিরাজ রান্নাঘরে চলিয়া গেল। ঘন্টা-খানেক পরে ভাত বাড়িয়া যখন সে ডাকিতে আসিল, নীলাম্বর তখন চোখ বুজিয়া ঝিমাইতেছিল। অত্যধিক গাঁজার মহিমায় তাহার মাথা তখন উত্তপ্ত এবং বুদ্ধি আচ্ছন্ন হইয়াছিল। সে সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া পূর্ব প্রশ্নের অনুবৃত্তি-স্বরূপে কহিল, কোথা গিয়েছিলে?

বিরাজ নিজের উদ্যত জিহ্বাকে সজোরে দংশন করিয়া নিবৃত্ত করিয়া শান্তভাবে বলিল, আজ খেয়ে শোও, সে কথা কাল শুনো।

নীলাম্বর মাথা নাড়িয়া বলিল, না, আজই শুনব। কোথায় ছিলে বল?

তাহার জিদের ভঙ্গী দেখিয়া এত দুঃখেও বিরাজ হাসিল, বলিল, যদি না বলি?

বলতেই হবে, বল।

আমি তা কিছুতেই বলব না। আগে খেয়ে শোও তখন শুনতে পাবে।

নীলাম্বর এ হাসিটুকু লক্ষ্য করিল না, দুই চোখ বিস্ফারিত করিয়া মুখ তুলিল—সে চোখে আর আচ্ছন্ন ভাব নাই, হিংসা ও ঘৃণা ফুটিয়া বাহির হইতেছে। ভীষণকন্ঠে বলিল, না কিছুতেই না; কোনমতেই না, না শুনে তোমার ছোঁয়া জল পর্যন্ত খাব না।

বিরাজ চমকাইয়া উঠিল, বুঝি কালসর্প দংশন করিলেও মানুষ এমন করিয়া চমকায় না। সে টলিতে টলিতে দ্বারের কাছে পিছাইয়া গিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িয়া বলিল, কি বললে? আমার ছোঁয়া জল পর্যন্ত খাবে না?

না, কোন মতেই না।

কেন?

নীলাম্বর চেঁচাইয়া উঠিয়া বলিল, আবার জিজ্ঞেস কচ্চ কেন?

বিরাজ নিঃশব্দে স্থিরদৃষ্টিতে স্বামীর মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে ধীরে ধীরে বলিল, বুঝেচি! আর জিজ্ঞেস করব না।

আমিও কোন মতে বলব না, কেননা কাল যখন তোমার হুঁশ হবে তখন নিজেই বুঝবে—এখন তুমি তোমাতেই নেই।

নেশাখোর সব সহিতে পারে, পারে না শুধু তাহার বুদ্ধিভ্রষ্টতার উল্লেখ সহিতে। ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইয়া বলিতে লাগিল, গাঁজা খেয়েছি এই বলছিস ত? গাঁজা আজ আমি নূতন খাইনি যে, জ্ঞান হারিয়েচি। বরং জ্ঞান হারিয়েচিস তুই, তুই আর তোতে নেই।

বিরাজ তেমনি মুখের পানে চাহিয়া রহিল।

নীলাম্বর বলিল, কার চোখে ধূলো দিতে চাস বিরাজ? আমার? আমি অতি মূর্খ, তাই সেদিন পীতাম্বরের কোন কথা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু সে ছোটভাই, যথার্থ ভায়ের কাজই করেছিল। নইলে কেন তুই বলতে পারিস নে কোথা ছিলি? কেন মিছে কথা বললি—তুই ঘাটে ছিলি?

বিরাজের দুই চোখ এখন পাগলের চক্ষুর মত ধকধক করিতে লাগিল, তথাপি সে কন্ঠস্বর সংযত করিয়া জবাব দিল, মিছে কথা বলছিলুম , এ কথা শুনলে তুমি লজ্জা পাবে, দুঃখ পাবে, হয়তো তোমার খাওয়া হবে না তাই,—কিন্তু সে ভয় মিছে—তোমার লজ্জা-শরমও নেই, তুমি আর মানুষও নেই। কিন্তু, তুমি মিছে কথা বলনি? একটা পশুরও এত বড় ছল করতে লজ্জা হ’ত, কিন্তু তোমার হ’ল না। সাধুপুরুষ! রোগা স্ত্রীকে ঘরে একা ফেলে কোন্ শিষ্যের বাড়িতে তিন দিন ধরে গাঁজার ওপর গাঁজা খাচ্ছিলে বল!

নীলাম্বর আর সহিতে পারিল না। বলচি, বলিয়া হাতের কাছের শূন্য পানের ডিবাটা বিরাজের মাথা লক্ষ্য করিয়া সজোরে নিক্ষেপ করিল। বদ্ধ-ডিবা তার কপালে লাগিয়া ঝনঝন করিয়া খুলিয়া নীচে পড়িল। দেখিতে দেখিতে তাহার চোখের কোণ বাহিয়া, ঠোঁটের প্রান্ত বাহিয়া রক্তে মুখ ভাসিয়া উঠিল।

বিরাজ বাঁ হাতে কপাল টিপিয়া ধরিয়া চেঁচাইয়া উঠিল—আমাকে মারলে!

নীলাম্বরের ঠোঁট মুখ কাঁপিতে লাগিল, বলিল, না, মারিনি। কিন্তু দূর হ সুমুখ থেকে—ও মুখ আর দেখাস নে—অলক্ষ্মী , দূর হয়ে যা!

বিরাজ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, যাচ্চি। এক-পা গিয়া হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কিন্তু সহ্য হবে ত? কাল যখন মনে পড়বে, জ্বরের উপর আমাকে মেরেচ—তাড়িয়ে দিয়েচ, আমি তিন দিন খাইনি, তবু এই অন্ধকারে তোমার জন্যে ভিক্ষা করে এনেচি—সইতে পারবে ত? এই অলক্ষ্মীকে ছেড়ে থাকতে পারবে ত?

রক্ত দেখিয়া নীলাম্বরের নেশা ছুটিয়া গিয়াছিল—সে মূঢ়ের মত চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল।

বিরাজ আঁচল দিয়া মুছিয়া বলিল, এই এক বছর যাই-যাই করচি, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যেতে পারিনি। চেয়ে দেখ, দেহে আমার কিছু নেই, চোখে ভাল দেখতে পাইনে, এক পা চলতে পারিনে—আমি যেতুম না, কিন্তু স্বামী হয়ে যে অপবাদ আমাকে দিলে, আর আমি তোমার মুখ দেখাব না। তোমার পায়ের নীচে মরবার লোভ আমার সবচেয়ে বড় লোভ,—সেই লোভটাই আমি কোনমতে ছাড়তে পারছিলুম না—আজ ছাড়লুম, —বলিয়া কপাল মুছিতে মুছিতে খিড়কির খোলা দোর দিয়া আর একবার অন্ধকারে বাগানের মধ্যে মিলাইয়া গেল।

নীলাম্বর কথা কহিতে চাহিল, কিন্তু জিভ নাড়িতে পারিল না। ছুটিয়া পিছনে যাইতে চাহিল, কিন্তু উঠিতে পারিল না। কোন্‌ মায়ামন্ত্রে তাহাকে অচল পাথরে রূপান্তরিত করিয়া দিয়া বিরাজ অদৃশ্য হইয়া গেল।

0 Shares