বিরাজবৌ

আজ একবার ওই সরস্বতীর দিকে চাহিয়া দেখ, ভয় করিবে। বৈশাখের সেই শীর্ণকায়া মৃদুপ্রবাহিণী শ্রাবণের শেষ দিনে কি খরবেগে দুই কূল ভাসাইয়া চলিয়াছে। যে কালো পাথরখণ্ডটার উপর একদিন বসন্ত-প্রভাতে দুইটি ভাইবোনকে অসীম স্নেহসুখে এক হইয়া বসিতে থাকিতে দেখিয়াছিলাম, সেই কালো পাথরটার উপর বিরাজ আজিকার আঁধার রাত্রে কি হৃদয় লইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে আসিয়া দাঁড়াইল। নীচে গভীর জলরাশি সুদৃঢ় প্রাচীর-ভিত্তিতে ধাক্কা খাইয়া আবর্ত রচিয়া চলিয়াছে, সেইদিকে একবার ঝুঁকিয়া দেখিয়া সম্মুখে চাহিয়া রহিল। তাহার পায়ের নীচে কালো পাথর, মাথার উপর মেঘাচ্ছন্ন কালো আকাশ, সুমুখে কালো জল, চারিদিকে গভীর কৃষ্ণ স্তব্ধ বনানী— আর বুকের ভিতর জাগিতেছে তাদের চেয়ে কালো আত্মহত্যাপ্রবৃত্তি। সে সেইখানে বসিয়া পড়িয়া নিজের আঁচল দিয়া দৃঢ় করিয়া জড়াইয়া নিজের হাত-পা বাঁধিতে লাগিল।

পরিচ্ছেদ – বার

প্রত্যূষের আকাশ ঘন মেঘাচ্ছন্ন, টিপিটিপি জল পড়িতেছিল। নীলাম্বর খোলা দরজার চৌকাঠে মাথা রাখিয়া কোন এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। সহসা তাহার সুপ্তকর্ণে শব্দ আসিল, হাঁ গা, বিরাজবৌমা!

নীলাম্বর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। হয়ত, শ্যাম নাম শুনিয়া এমনই কোন এক বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন প্রভাতে শ্রীরাধা এমনই ব্যাকুল হইয়া উঠিয়া বসিতেন। সে চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরে আসিয়া দেখিল, উঠানে তুলসী ডাকিতেছে। কাল সমস্ত রাত্রি বনে বনে প্রতি বৃক্ষতলে খুঁজিয়া কাঁদিয়া ঘন্টা-খানেক পূর্বে শ্রান্ত ও ভীত হইয়া ফিরিয়া আসিয়া দোরগোড়ায় বসিয়াছিল, তার পর কখন ভুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।

তুলসী জিজ্ঞাসা করিল, মা কোথায় বাবু?

নীলাম্বর হতবুব্ধির মত চাহিয়া থাকিয়া বলিল, তুই তবে কাকে ডাকছিলি?

তুলসী বলিল, বৌমাকেই ত ডাকচি বাবু! কাল এক প্রহর রেতে কোত্থাও কিছু নেই, এই আঁধারে মা গিয়ে আমাদের বাড়ি মোটা চাল চেয়ে আনলে, তাই সকালে দোর খোলা পেয়ে জানতে এলুম, সে চেলে কি কাজ হ’ল?

নীলাম্বর মনে মনে সমস্ত বুঝিল, কিন্তু কোন কথা কহিল না।

তুলসী বলিল, এত ভোরে তবে খিড়কি খুললে কে? তবে বুঝি বৌমা ঘাটে গেছেন, বলিয়া চলিয়া গেল।

নদীর ধারে ধারে প্রতি গর্ত, প্রতি বাঁক, প্রতি ঝোপ-ঝাড় অনুসন্ধান করিতে করিতে সমস্ত দিন অভুক্ত অস্নাত নীলাম্বর সহসা একস্থানে থামিয়া পড়িয়া বলিল, এ কি পাগলামি আমার মাথায় চাপিয়াছে! আমি যে সারাদিন খাই নাই, এখনও কি একথা তাহার মনে পড়িতে বাকী আছে? এর পরেও সে কি কোথাও কোন কারণে একমুহূর্ত থাকিতে পারে? তবে একি অদ্ভুত কাণ্ড সকাল হইতে করিয়া ফিরিতেছি! এ-সব চোখের সামনে এমনই সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিল যে, তাহার সমস্ত দুশ্চিন্তা একেবারে ধুইয়া মুছিয়া গেল, সে কাদা ঠেলিয়া, মাঠ ভাঙ্গিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘরের দিকে ছুটিল। বেলা যখন যায়-যায়, পশ্চিমাকাশে সূর্যদেব ক্ষণকালের জন্য মেঘের ফাঁকে রক্তমুখ বাহির করিয়াছেন, সে তখন বাড়ি ঢুকিয়া সোজা রান্নাঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। মেঝের উপর তখনও আসন পাতা, তখনও গতরাত্রির বাড়া ভাত শুকাইয়া পড়িয়া আছে—আরশোলা ইঁদুরে ছিটাছিটি করিতেছে—কেহ মুক্ত করে নাই। সে ভোরের আঁধারে ঠাহর করে নাই; এখন ভাতের চেহারা দেখিয়াই বুঝিল, ইহাই তুলসীর মোটা চাল, ইহাই অভুক্ত স্বামীর জন্য বিরাজ জ্বরে কাঁপিতে কাঁপিতে অন্ধকারে লুকাইয়া ভিক্ষা করিয়া আনিয়াছিল, ইহারই জন্য সে মার খাইয়াছে, অশ্রাব্য কটু কথা শুনিয়া লজ্জায় ধিক্কারে বর্ষার দুরন্ত রাতে গৃহত্যাগ করিয়াছে।

নীলাম্বর সেইখানে বসিয়া পড়িয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া মেয়েমানুষের মত গভীর আর্তনাদ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সে যখন এখনও ফিরিয়া আসে নাই, তখন আর আসিবার কথা ভাবিতে পারিল না। সে স্ত্রীকে চিনিত। সে যে কত অভিমানী, প্রাণ গেলেও সে যে পরের ঘরে আশ্রয় লইতে গিয়া এই কলঙ্ক প্রকাশ করিতে চাহিবে না, তাহা নিঃসংশয়ে বুঝিতেছিল বলিয়াই তাহার বুকের ভিতর এত সত্বর এমন হাহাকার উঠিল। তারপর উপুড় হইয়া পড়িয়া দুই বাহু সন্মুখে প্রসারিত করিয়া দিয়া অবিশ্রাম আবৃত্তি করিতে লাগিল, এ আমি সইতে পারব না বিরাজ, তুই আয়।

সন্ধ্যা হইল, এ বাড়িতে কেহ দীপ জ্বালিল না; রাত্রি হইল, রান্নাঘরে কেহ রাঁধিতে প্রবেশ করিল না; কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহার চোখ-মুখ ফুলিয়া গেল, কেহ মুছাইয়া দিল না। দুদিনের উপবাসীকে কেহ খাইতে ডাকিল না। বাহিরে চাপিয়া বৃষ্টি আসিল, ঘনান্ধকার বিদীর্ণ করিয়া বিদ্যুতের শিখা তাহার মুদ্রিত চক্ষুর ভিতর পর্যন্ত উদ্ভাসিত করিয়া দুর্যোগের বার্তা জানাইয়া যাইতে লাগিল; তথাপি সে উঠিয়া বসিল না, চোখ মেলিল না, একভাবে মুখ গুঁজিয়া গোঁ গোঁ করিতে লাগিল।

যখন তার ঘুম ভাঙ্গিল তখন সকাল। বাহিরের দিকে একটা অস্পষ্ট কোলাহল শুনিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখিল, দরজায় একটা গো-শকট দাঁড়াইয়া আছে, ব্যস্ত হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইতেই ছোটবৌ ঘোমটা টানিয়া দিয়া নামিয়া পড়িল। অগ্রজের প্রতি একটা বক্র কটাক্ষ করিয়া পীতাম্বর ওধারে সরিয়া গেল। ছোটবৌ কাছে আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেই নীলাম্বর অস্ফুটস্বরে কি-একটা আশীর্বাদ উচ্চারণ করিতে গিয়া হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। বিস্মিত ছোটবৌ হেঁট মাথা তুলিতে সে দ্রুতপদে কোন্‌ দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।

ছোটবৌ জীবনে আজ প্রথম স্বামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিয়া বাঁকিয়া দাঁড়াইল। অশ্রুভারাক্রান্ত রক্তাক্ত চোখ দুটি তুলিয়া বলিল, তুমি কি পাথর দিয়ে তৈরি? দুঃখ-কষ্টে দিদি আত্মঘাতী হলেন, তবুও আমরা পর হয়ে থাকব? তুমি থাকতে পার থাক গে, আমি আজ থেকে ও-বাড়ির সব কাজ করব।

পীতাম্বর চমকাইয়া উঠিল—সে কি কথা!

মোহিনী তুলসীর কাছে যতটুকু শুনিয়াছিল এবং নিজে যাহা অনুমান করিয়াছিল, কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্ত কহিল।

0 Shares