বিরাজবৌ

পীতাম্বর সহজে বিশ্বাস করিবার লোক নয়। কহিল, তাঁর দেহ ভেসে উঠবে ত!

ছোটবৌ চোখ মুছিয়া বলিল, না উঠতেও পারে। স্রোতে ভেসে গেছেন, সতী-লক্ষ্মীর দেহ মা গঙ্গা হয়ত বুকে তুলে নিয়েচেন। তা ছাড়া কে বা সন্ধান করচে , কে বা খুঁজে বেড়িয়েচে বল?

পীতাম্বর প্রথমটা বিশ্বাস করিল না, শেষটা করিল; বলিল, আচ্ছা, আমি খোঁজ করাচ্চি। একটু ভাবিয়া বলিল, বৌঠান মামার বাড়ি চলে যায়নি ত?

মোহিনী মাথা নাড়িয়া বলিল, কখ্‌খনো না। দিদি বড় অভিমানী, তিনি কোথাও যাননি, নদীতেই প্রাণ দিয়েচেন।

আচ্ছা, তাও দেখচি, বলিয়া পীতাম্বর শুষ্কমুখে বাহিরে চলিয়া গেল। বৌঠানের জন্য আজ হঠাৎ তাহার প্রাণটা খারাপ হইয়া গেল। লোকজন নিযুক্ত করিয়া একজন প্রজাকে বিরাজের মামার বাড়ি পাঠাইয়া জীবনে আজ প্রথম পুণ্যের কাজ করিল। স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিল, যদুকে দিয়ে উঠানের বেড়াটা ভাঙ্গিয়ে দাও, আর যা পার কর। দাদার মুখের পানে চাইতে পারা যায় না, – বলিয়া গুড় মুখে দিয়া একটু জল খাইয়া দপ্তর বগলে করিয়া কাজে চলিয়া গেল। চাঁর-পাঁচ দিন কামাই হওয়ায় তাহার অনেক ক্ষতি হইয়াছিল।

কাজ করিতে করিতে ছোটবৌ ক্রমাগত চোখ মুছিতে মুছিতে ভাবিতেছিল , ইনি যে মুখের পানে চাহিতে পারেন নাই, সে মুখ না জানি কি হইয়া গিয়াছে!

নীলাম্বর চন্ডীমণ্ডপের মাঝখানে চোখ বুজিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল। সুমুখের দেয়ালে টাঙ্গান রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির পট। এই পটখানি নাকি জাগ্রত। যখন রেলগাড়ি হয় নাই, তখন তাহাদের পিতামহ পায়ে হাঁটিয়া এখানি বৃন্দাবন হইতে আনিয়াছিলেন। তিনি পরম বৈষ্ণব ছিলেন, তাঁহার সহিত পটখানি মানুষের গলায় কথা কহিত, এ ইতিহাস নীলাম্বর তাহার জননীর কাছে বহুবার শুনিয়াছিল।

ঠাকুর-দেবতা জিনিসটা তাহার কাছে ঝাপসা ব্যাপার ছিল না। তেমন করিয়া ডাকার মত ডাকিতে পারিলে এঁরা যে সুমুখে আসেন, কথা ক’ন, এ-সমস্ত তাঁহার কাছে প্র্যতক্ষ সত্য ছিল। তাই ইতিপূর্বে গোপনে গোপনে এই পটখানিকে কথা কহাইবার কত প্রয়াস সে যে করিয়াছে, তাহার অবধি নাই, কিন্তু সফল হয় নাই। অথচ এই নিষ্ফলতার হেতু সে নিজের অক্ষমতার উপরেই দিয়া আসিয়াছে; এমন সংশয় কোনদিন মনে উঠে নাই, পট সত্যই কথা কহে কি না! লেখাপড়া সে শিখে নাই। বর্ণপরিচয় হইয়াছিল, তারপর বিরাজের কাছে রামায়ণ-মহাভারত পড়িতে এবং এক-আধটু চিঠিপত্র লিখিতে শিখিয়াছিল—শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থের কোন ধার ধারিত না, তাই ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় ধারণা তাহার নিতান্তই মোটা ধরনের ছিল। অথচ এ সম্বন্ধে কোন যুক্তিতর্কও সহিতে পারিত না। ছেলেবেলায় এই সব লইয়া কখনও-বা পীতাম্বরের সহিত কখনও-বা বিরাজের সহিত মারপিট হইয়া যাইত।

বিরাজ তাহার অপেক্ষা মাত্র চার বছরের ছোট ছিল—তেমন মানিত না। একবার সে মার খাইয়া নীলাম্বরের পেট কামড়াইয়া রক্ত বাহির করিয়া দিয়াছিল। শাশুড়ী উভয়কে ছাড়াইয়া দিয়া বিরাজকে র্ভৎসনা করিয়া বলিয়াছিলেন, ছি মা, গুরুজনকে অমন করে কামড়ে দিতে নেই। বিরাজ কাদিঁতে কাদিঁতে বলিয়াছিল, ও আমাকে আগে মেরেছিল। তিনি পুত্রকে ডাকিয়া শপথ দিয়াছিলেন, বিরাজের গায়ে কখন যেন সে হাত না তোলে। তখন তাহার বয়স চৌদ্দ বৎসর, আজ প্রায় ত্রিশ হইতে চলিয়াছে—সেই অবধি মাতৃভক্ত নীলাম্বর সেদিন পর্যন্ত মাতৃ-আজ্ঞা লঙ্ঘন করে নাই।

আজ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া পুরাতন দিনের এইসব বিস্মৃত কাহিনী স্মরণ করিয়া প্রথমে সে মায়ের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষা চাহিয়া তাহার জাগ্রত ঠাকুরকে দুটা সোজা কথায় বিড়বিড় করিয়া বুঝাইয়া বলিতেছিল—অন্তর্যামী ঠাকুর! তুমি ত সমস্তই দেখতে পেয়েচ! সে যখন এতটুকু অপরাধ করেনি, তখন সমস্ত পাপ আমার মাথায় দিয়ে তাকে স্বর্গে যেতে দাও। এখানে সে অনেক দুঃখ পেয়ে গেছে, আর তাকে দুঃখ দিও না। তাহার নিমীলিত চোখের কোণ বাহিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল। হঠাৎ তাহার ধ্যান ভাঙ্গিয়া গেল।

বাবা!

নীলাম্বর বিস্মিত হইয়া চাহিয়া দেখিল, ছোটবৌ অদূরে বসিয়া আছে। তাহার মুখে সামান্য একটু ঘোমটা, সে সহজকণ্ঠে বলিল, আমি আপনার মেয়ে, বাবা, ভেতরে আসুন, স্নান করে আজ আপনাকে দুটি খেতে হবে।

প্রথমে নীলাম্বর নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল—কত যুগ যেন গত হইয়াছে, তাহাকে কেহ খাইতে ডাকে নাই। ছোটবৌ পুনরায় বলিল, বাবা, রান্না হয়ে গেছে।

এইবার সে বুঝিল। একবার তাহার সর্বশরীর কাঁপিয়া উঠিল, তার পর সেইখানে উপুড় হইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল—রান্না হয়ে গেল মা!

গ্রামের সবাই শুনিল, সবাই বিশ্বাস করিল, বিরাজবৌ জলে ডুবিয়া মরিয়াছে; বিশ্বাস করিল না শুধু ধূর্ত পীতাম্বর। সে মনে মনে তর্ক করিতে লাগিল, এই নদীতে এত বাঁক, এত ঝোপঝাড়, মৃতদেহ কোথাও-না-কোথাও আটকাইবে। নদীতে নৌকা লইয়া, ধারে ধারে বেড়াইয়া, তটভূমের সমস্ত বন-জঙ্গল লোক দিয়া তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করিয়াও যখন শবের কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না, তখন তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইল, বৌঠান আর যাই করুক, নদীতে ডুবিয়া মরে নাই। কিছুকাল পূর্বে একটা সন্দেহ তাহার মনে উঠিয়াছিল, আবার সেই সন্দেহটাই মনের মধ্যে পাক খাইতে লাগিল। অথচ কাহারো কাছে বলিবার জো নাই। একবার মোহিনীকে বলিতে গিয়াছিল, সে জিভ কাটিয়া কানে আঙুল দিয়া পিছাইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তা হলে ঠাকুর-দেবতাও মিছে, রাতও মিছে, দিনও মিছে। দেয়ালে টাঙানো অন্নপূর্ণার ছবির দিকে চাহিয়া বলিল, দিদি ওঁর অংশ ছিলেন। এ কথা আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি জানি, বলিয়া চলিয়া গেল।

পীতাম্বর রাগ করিল না—হঠাৎ সে যেন আলাদা মানুষ হইয়া গিয়াছিল।

মোহিনী ভাসুরের সহিত কথা কহিতে শুরু করিয়াছে। ভাত বাড়িয়া দিয়া একটুখানি আড়ালে বসিয়া একটু একটু করিয়া সমস্ত ঘটনা শুনিয়া লইল। সমস্ত সংসারের মাঝে শুধু সেই জানিল কি ঘটিয়াছিল, শুধু সেই বুঝিল, কি মর্মান্তিক ব্যথা ওঁর বুকে বিঁধিয়া রহিল।

0 Shares