বিরাজবৌ

দিন-তিনেক পরে আরোগ্যলাভ করিয়া নীলাম্বর বাহিরে চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া ছিল, মতি মোড়ল আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল—দাঠাকুর, তুমি একবার না দেখলে ত আমার ছিমন্ত আর বাঁচে না। একবার পায়ের ধূলো দাও দেব্‌তা, তাহলে যদি এ-যাত্রা সে বেঁচে—।আর সে বলিতে পারিল না—আকুলভাবে কাঁদিতে লাগিল।

নীলাম্বর জিজ্ঞাসা করিল, গায়ে কি খুব বেশী বেরিয়েচে মতি?

মতি চোখ মুছিতে মুছিতে বলিতে লাগিল, সে আর কি বলব! মা যেন একেবারে ঢেলে দিয়েচেন। ছোটজাত হয়ে জন্মেচি ঠাকুদ্দা, কিছুই ত জানি নে কি করতে হয়—একবার চল, বলিয়া সে দু’পা জড়াইয়া ধরিল।

নীলাম্বর ধীরে ধীরে পা ছাড়াইয়া লইয়া কোমলস্বরে বলিল, কিছু ভয় নেই মতি, তুই যা, আমি পরে যাব।

তাহার কান্নাকাটির কাছে সে নিজের অসুখের কথা বলিতে পারিল না। বিশেষ, সকল রকম রোগের সেবা করিয়া এ বিষয়ে তাহার এত অধিক দক্ষতা জন্মিয়াছিল যে, আশপাশের গ্রামের মধ্যে কাহারও শক্ত অসুখ-বিসুখে তাহাকে একবার না দেখাইয়া, তাহার মুখের আশ্বাস-বাক্য না শুনিয়া রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা কিছুতেই ভরসা পাইত না। নীলাম্বর এ কথা নিজেও জানিত। ডাক্তার কবিরাজের ঔষধের চেয়ে, দেশের অশিক্ষিত লোকের দল তাহার পায়ের ধূলা, তাহার হাতের জলপড়াকে যে অধিক শ্রদ্ধা করে, ইহা সে বুঝিত বলিয়াই কাহাকেও কোনদিন ফিরাইয়া দিতে পারিত না। মতি চাঁড়াল আর একবার কাঁদিয়া, আর একবার পায়ের ধূলার দাবী জানাইয়া, চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেল। নীলাম্বর উদ্বিগ্ন হইয়া ভাবিতে লাগিল। তাহার দেহ তখনও ঈষৎ দুর্বল ছিল বটে কিন্তু সে কিছুই নয়। সে ভাবিতে লাগিল, বাড়ির বাহির হইবে কি করিয়া। সে বিরাজকে অত্যন্ত ভয় করিত, তাহার কাছে এ কথা সে মুখে আনিবে কি করিয়া?

ঠিক এই সময়ে ভিতরের উঠান হইতে হরিমতির সুতীক্ষ্ণ কন্ঠের ডাক আসিল, দাদা, —বৌদি ঘরে এসে শুতে বলচে।

নীলাম্বর জবাব দিল না।

মিনিট-খানেক পরেই হরিমতি নিজে আসিয়া হাজির হইল। বলিল, শুনতে পাওনি দাদা?

নীলাম্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

হরিমতি কহিল, সেই চারটি খেয়ে বসে আছ,—বৌদি বলচে, আর বসে থাকতে হবে না, একটু শোও গে।

নীলাম্বর আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, সে কি করচে রে পুঁটি?

হরিমতি কহিল, এইবার ভাত খেতে বসেচে।

নীলাম্বর আদর করিয়া বলিল, লক্ষ্মী দিদি আমার, একটি কাজ করবি?

পুঁটি মাথা নাড়িয়া বলিল, করব।

নীলাম্বর কন্ঠস্বর আরও কোমল করিয়া কহিল, আস্তে আস্তে আমার চাদর আর ছাতিটা নিয়ে আয় দেখি!

চাদর আর ছাতি?

নীলাম্বর কহিল, হুঁ।

হরিমতি চোখ কপালে তুলিয়া বলিল, বাপ রে! বৌদি ঠিক এই দিকে মুখ করে খেতে বসেচে যে!

নীলাম্বর শেষ চেষ্টা করিয়া বলিল, পারবি নে আনতে?

হরিমতি অধর প্রসারিত করিয়া দুই-তিনবার মাথা নাড়িয়া বলিল, না দাদা, দেখে ফেলবে; তুমি শোবে চল।

বেলা তখন প্রায় দুইটা, বাহিরের প্রচণ্ড রৌদ্রের দিকে চাহিয়া সে শুধু-মাথায় পথে বাহির হইবার কথা ভাবিতেও পারিল না, হতাশ হইয়া ছোটবোনের হাত ধরিয়া ঘরে আসিয়া শুইয়া পড়িল। হরিমতি কিছুক্ষণ অনর্গল বকিতে বকিতে এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়িল। নীলাম্বর চুপ করিয়া মনে মনে নানারূপে আবৃত্তি করিয়া দেখিতে লাগিল, কথাটা ঠিক কি রকম করিয়া পাড়িতে পারিলে খুব সম্ভব বিরাজের করুণা উদ্রেক করিবে।

বেলা প্রায় পড়িয়া আসিয়াছিল। বিরাজ ঘরের শীতল মসৃণ সিমেণ্টের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া বুকের তলায় একটা বালিশ দিয়া মগ্ন হইয়া মামা ও মামীকে চারপাতা-জোড়া পত্র লিখিতেছিল। কি করিয়া এ বাড়িতে শুদ্ধমাত্র মা শীতলার কৃপায় মরা বাঁচিয়াছে, কি করিয়া যে এ যাত্রা সিঁথার সিঁদুর ও হাতের নোয়া বজায় রহিয়া গিয়াছে, লিখিয়া লিখিয়া ক্রমাগত লিখিয়াও সে কাহিনী শেষ হইতেছিল না, এমন সময় খাটের উপর হইতে নীলাম্বর হঠাৎ ডাকিয়া বলিল, একটি কথা রাখবে বিরাজ?

বিরাজ দোয়াতের মধ্যে কলমটা ছাড়িয়া দিয়া মুখ তুলিয়া বলিল, কি কথা?

যদি রাখ ত বলি।

বিরাজ কহিল, রাখবার মত হলেই রাখবো—কি কথা?

নীলাম্বর মুহূর্তকাল চিন্তা করিয়া বলিল, বলে লাভ নেই বিরাজ, তুমি কথা আমার রাখতে পারবে না।

বিরাজ আর প্রশ্ন করিল না, কলমটা তুলিয়া লইয়া পত্রটা শেষ করিবার জন্য আর একবার ঝুঁকিয়া পড়িল। কিন্তু চিঠিতে মন দিতে পারিল না—ভিতরে ভিতরে কৌতূহলটা তাহার প্রবল হইয়া উঠিল। সে উঠিয়া বসিয়া বলিল, আচ্ছা বল, আমি কথা রাখব।

নীলাম্বর একটুখানি হাসিল, একটুখানি ইতস্ততঃ করিল, তাহার পরে বলিল, দুপুরবেলা মতি চাঁড়াল এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরেছিল। তাদের বিশ্বাস, আমার পায়ের ধূলো না পড়লে তার ছিমন্ত বাঁচবে না—আমাকে একবার যেতে হবে।

তাহার মুখপানে চাহিয়া বিরাজ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। খানিক পরে বলিল, এই রোগা দেহ নিয়ে তুমি যাবে?

কি করব বিরাজ, কথা দিয়েচি—আমাকে একবার যেতেই হবে।

কথা দিলে কেন?

নীলাম্বর চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

বিরাজ কঠিনভাবে বলিল, তুমি কি মনে কর, তোমার প্রাণটা তোমার একলার, ওতে কারও কিছু বলবার নেই? তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পার?

নীলাম্বর কথাটা লঘু করিয়া ফেলিবার জন্য হাসিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া তাহার হাসি আসিল না। কোনমতে বলিয়া ফেলিল, কিন্তু তার কান্না দেখলে—

বিরাজ কথার মাঝখানেই বলিয়া উঠিল, ঠিক ত! তার কান্না দেখলে—কিন্তু আমার কান্না দেখবার লোক সংসারে আছে কি? বলিয়া চারপাতা-জোড়া চিঠিখানা তুলিয়া লইয়া কুচিকুচি করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিতে ফেলিতে বলিল, উঃ! পুরুষমানুষেরা কি! চার দিন চার রাত না খেয়ে না ঘুমিয়ে কাটালুম—ও হাতে হাতে তার প্রতিফল দিতে চলল! ঘরে ঘরে জ্বর, ঘরে ঘরে বসন্ত—এই রোগা দেহ নিয়ে ও রোগী ঘাঁটতে চলল—আচ্ছা যাও; আমার ভগবান আছেন। বলিয়া আর একবার বালিশে বুক দিয়া উপুড় হইয়া পড়িল।

0 Shares