কিছু চাই না, একবার মথুরবাবুর সঙ্গে দেখা করব।
তাঁকে ডাকিয়ে পাঠাই, তোমাকে যেতে হবে না। কিন্তু, এমন সময় তাঁকে কেন?
বলে দেব যে অগ্রহায়ণ মাস থেকে তাঁকে আর কাজ করতে হবে
৫০
না।
শান্তি বিস্মিত হইল; কিন্তু সন্তুষ্ট হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর অপরাধ?
অপরাধ যে কি, তা এখন ঠিক বলতে পার্চি না, কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি কর্চেন। তাহার পর আদালতের সার্টিফিকেট ও কয়েকখানা কাগজপত্র দেখাইয়া কহিলেন, এই দেখ, গোলাগাঁয়ে একজন বিধবার ঘর-বাড়ি সমস্ত বেনামী নিলামে খরিদ করে নিয়েচে। আমাকে একবার জিজ্ঞাসাও করেনি।
শান্তি দুঃখিত হইয়া কহিল, আহা বিধবা? তবে এ কাজটা ভাল হয়নি–কিন্তু বিক্রি হল কেন?
দশ বৎসরের খাজনা বাকি ছিল; সুদে-আসলে দেড়-হাজার টাকার নালিশ হয়েছিল।
টাকার কথা শুনিয়া শান্তি মথুরনাথের প্রতি একটু নরম হইয়া পাড়িল। মৃদু হাসিয়া কহিল, তা ম্যানেজারবাবুর বা দোষ কি? অত টাকা কেমন করে ছেড়ে দেন?
সুরেন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক হইয়া ভাবিতে লাগিল । শান্তি প্রশ্ন করিল, অত টাকা ছেড়ে দেবে?
দেব না ত কি, অসহায় বিধবাকে বাড়ি-ছাড়া করব? তূমি কি পরামর্শ দাও?
কথাটার ভিতর যতটুকু জ্বালা ছিল, সবটুকু শান্তির গায়ে লাগিল। অপ্রতিভ হইয়া দুঃখিতভাবে সে বলিল, না, বাড়ি-ছাড়া করতে বলি না। আর তোমার টাকা তুমি দান করবে, আমি তাতে বাধা দেব কেন?
সুরেন্দ্র হাসিয়া কহিলেন, সে নয় শান্তি, আমার টাকা কি তোমার নয়? কিন্তু বল দেখি, আমি যখন না থাকব, তখন তুমি–
ও কি কথা–
তুমি–আমি যা ভালবাসি, তা করবে ত?
শান্তির চোখে জল আসিল, কেন না, স্বামীর শারীরিক অবস্থা ভাল নহে, বলিল, ও কথা কেন বল?
বড় ভাল লাগে, তাই বলি। তুমি, আমার কথা, আমার সাধ ইচ্ছা জেনে রাখবে না শান্তি?
শান্তি চক্ষে অঞ্চল দিয়া মাথা নাড়িল।
কিছুক্ষণ পরে সুরেন্দ্র পুনরায় কহিলেন, আমার বড়দিদির নাম।
শান্তি অঞ্চল সরাইয়া সুরেন্দ্রের মুখপানে চাহিল।
সুরেন্দ্র একখানা কাগজ দেখাইয়া বলিলেন, এই দেখ, আমার বড়দিদির নাম।
কোথায়?
এই দেখ, মাধবী দেবী যাঁর বাড়ি নিলাম হয়েছে।
একমুহূর্তে শান্তি অনেক কথা বুঝিল। কহিল, তাই বুঝি সমস্ত ফিরিয়ে দিতে চাইছ?
সুরেন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া উত্তর দিলেন, তাই হলে নিশ্চয় ফিরিয়ে দেব–সমস্ত–সব!
মাধবীর কথায় শান্তি একটু দুঃখিত হইয়া পড়িল; ভিতরে বোধ হয় একটু হিংসার ভাব ছিল। কহিল, তিনি হয় ত তোমার বড়দিদি নন। শুধু মাধবী নাম আছে। নামেতেই এই!
বড়দিদির নামের একটু সম্মান করব না?
তা কর, কিন্তু তিনি নিজে কিছু জানতে পারবেন না।
তা পারবেন না–কিন্তু আমি কি অসম্মান করতে পারি?
নাম ত এমন কত লোকের আছে।
আছে! তুমি দুর্গা নাম লিখে তাতে পা দিতে পার?
ছি! ও-কি কথা? ঠাকুর-দেবতার নাম নিয়ে–
সুরেন্দ্রনাথ হাসিয়া উঠিলেন, আচ্ছা, ঠাকুর-দেবতার নাম নাই নিলাম, কিন্তু তোমাকে আমি পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারি, যদি একটি কাজ করতে পার।
শান্তি উৎফুল্ল হইয়া কহিল, কি কাজ?
দেয়ালের গায়ে সুরেন্দ্রনাথের একটি ছবি ছিল, সেই দিকে দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, এই ছবিটি যদি–
কি?
চারিজন ব্রাহ্মণ দিয়ে নদীর তীরে পোড়াতে পার।
অদূরে বজ্রাঘাত হইলে লোকের যেমন প্রথমে সমস্ত রক্ত নিমেষে সরিয়া যায়, মুখখানা সর্পদষ্ট রোগীর মত নীলবর্ণ হইয়া থাকে, শান্তির প্রথমে সেইরূপ অবস্থা হইল। তাহার পর ধীরে ধীরে মুখে-চোখে রক্ত ফিরিয়া আসিল–তাহার পর করুণ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখপানে চাহিয়া সে নিঃশব্দে নীচে নামিয়া গেল। পুরোহিত ডাকাইয়া রীতিমত শান্তিস্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করিয়া রাজার অর্ধেক রাজত্ব মানত করিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল যে, এই বড়দিদি যিনিই হউন, ইহাঁর সম্বন্ধে সে আর কোন কথা কহিবে না । তাহার পরে ঘরে দ্বার দিয়া বহুক্ষণ ধরিয়া সে অশ্রুমোচন করিল। এ জীবনে এমন কটু কথা সে আর কখনও শোনে নাই!
সুরেন্দ্রনাথও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন, তাহার পর বাহিরে চলিয়া গেলেন,–কাছারিঘরে মথুরবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলেন, গোলাগাঁয়ে কার সম্পত্তি নিলাম হয়েছে?
মৃত রামতনু সান্যালের বিধবা পুত্রবধূর।
কেন?
দশ বছরের মাল-গুজারি বাকি ছিল।
কই খাতা দেখি?
মথুরানাথ প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া গেল; তাহার পর কহিল, খাতা-পত্র এখনও পাবনা থেকে আনা হয়নি।
আনতে লোক পাঠাও। বিধবার থাকবার স্থানটুকু পর্যন্ত রাখোনি?
বোধ হয় নেই।
তবে সে কোথায় থাকবে?
মথুরানাথ সাহস সঞ্চয় করিয়া কহিল, এতদিন যেখানে ছিল, সেখানে থাকবে বোধ হয়।
এতদিন কোথায় ছিল?
কলিকাতায়। তাহার পিতার বাটীতে।
পিতার নাম কি জান?
জানি। ব্রজরাজ লাহিড়ী।
বিধবার নাম?
মাধবী দেবী।
নতমুখে সুরেন্দ্রনাথ সেখানে বসিয়া পড়িলেন। মথুরানাথ ভাবগতিক দেখিয়া ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হল?
সুরেন্দ্রনাথ সে কথার কোন উত্তর না দিয়া একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া কহিলেন, একটা ভাল ঘোড়া, শীঘ্র জিন কষিতে বল–আমি এখুনি গোলাগাঁয়ে যাব। এখান থেকে গোলাগাঁ কতদূর জান?
প্রায় দশ ক্রোশ।
এখন ন’টা বেজেছে–একটার মধ্যে পৌঁছতে পারব।
ঘোড়া আসিলে তাহাতে চড়িয়া বসিয়া কহিলেন, কোন্ দিকে?
উত্তর দিকে, পরে পশ্চিমে যেতে হবে।
তাহার পর চাবুক খাইয়া ঘোড়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।
এ কথা শুনিয়া শান্তি ঠাকুরঘরে মাথা খুঁড়িয়া রক্ত বাহির করিল,–ঠাকুর,এই তোমার মনে ছিল! আর কি ফিরে পাব!
তাহার পর দুজন পাইক ঘোড়ায় চড়িয়া গোলাগাঁ উদ্দেশে ছুঢিয়া গেল। জানালা দিয়া তাহা দেখিয়া শান্তি ক্রমাগত চক্ষু মুছিতে লাগিল–মা দুর্গা! জোড়া মোষ দেব–যা চাও, তাই দেব–তাঁকে ফিরিয়ে দাও–বুক চিরে রক্ত দেব–যত চাও–হে মা দুর্গা, যত চাও–যতক্ষণ না তোমার পিপাসা মিটে।