বড়দিদি

গোলাগাঁ পৌঁছিতে আর দুই ক্রোশ আছে। অশ্বের ক্ষুর পর্যন্ত ফেনায় ভরিয়া গিয়াছে। প্রাণপণে ধূলা উড়াইয়া, আল ডিঙ্গাইয়া,খানা টপকাইয়া ঘোড়া ছুটিয়া চলিয়াছে। মাথার উপর প্রচণ্ড সূর্য।

ঘোড়ার উপর থাকিয়াই সুরেন্দ্রের গা–বমি বমি করিয়া উঠিল; ভিতরের প্রত্যেক নাড়ী যেন ছিঁড়িয়া বাহির হইয়া পড়িবে! তাহার পর টপ্‌ করিয়া ফোঁটা দুই-তিন রক্ত কষ বহিয়া ধূলিধূসরিত পিরানের উপর পড়িল; সুরেন্দ্রনাথ হাত দিয়া মুখ মুছিয়া ফেলিলেন । একটার পূর্বেই গোলগাঁয়ে উপস্থিত হইলেন। পথের ধারে দোকানে জিজ্ঞাসা করিলেন,এই গোলাগাঁ?

হ্যাঁ।

রামতনু সান্যালের বাটী?

ঐ দিকে।

আবার ঘোড়া ছুটিল। অল্পক্ষণে বাঞ্ছিত বাটীর সম্মুখে দাঁড়াইল।

দ্বারেই একজন সিপাহী বসিয়াছিল; প্রভুকে দেখিয়া সে প্রণাম করিল।

বাঢীতে কে আছেন?

কেউ না।

কেউ না? কোথায় গেলেন?

ভোরেই নৌকা করে চলে গেছেন।

কোথায়–কোন্‌ পথে?

দক্ষিণ দিকে।

নদীর ধারে ধারে পথ আছে? ঘোড়া দৌড়তে পারবে?

বলতে পারি না। বোধ হয় নেই।

পুনর্বার ঘোড়া ছুটিয়া চলিল। ক্রোশ-দুই আসিয়া আর পথ নাই। ঘোড়া চলে না। ঘোড়া ছাড়িয়া দিয়া তখন সুরেন্দ্রনাথ পদব্রজে চলিলেন। একবার চাহিয়া দেখিলেন–জামার উপর অনেক ফোঁটা রক্ত ধূলায় জমিয়া গিয়াছে। ওষ্ঠ বাহিয়া তখনও রক্ত পড়িতেছে। নদীতে নামিয়া অঞ্জলি ভরিয়া জল পান করিলেন, তার পর প্রাণপণে ছুটিয়া চলিলেন। পায়ে আর জুতা নাই–সর্বাঙ্গে কাদা, মাঝে মাঝে শোণিতের দাগ! বুকের উপর কে যেন রক্ত ছিটাইয়া দিয়াছে।

বেলা পড়িয়া আসিল। পা আর চলে না– যেন এইবার শুইতে পারিলেই জন্মের মত ঘুমাইয়া পড়িবে–তাই যেন অন্তিম শয্যায় এই জীবনের মহা-বিশ্রামের আশায় সে উন্মত্তের

মত ছুটিয়া চলিয়াছে। এ দেহে যতটুকু শক্তি আছে, সমস্ত অকাতরে ব্যয় করিয়া শেষশয্যা আশ্রয় করিবে, আর উঠিবে না!

নদীর বাঁকের পাশে–একখানা নৌকা না? কলমীশাকের দল কাটিয়া পথ করিতেছে! সুরেন্দ্র ডাকিল, ‘বড়দিদি ‘! শুষ্ককণ্ঠে শব্দ বাহির হইল না–শুধু দুই ফোঁটা রক্ত বাহির হইল।

‘বড়দিদি ‘– আবার দুই ফোঁটা রক্ত ।

কলমীর দল নৌকার গতি রোধ করিতেছে। সুরেন্দ্রর কাছে আসিয়া পড়িল।

আবার ডাকিল, ‘বড়দিদি’।

সমস্ত দিনের উপবাস ও মনঃকষ্টে মাধবী নির্জীবের মত নিদ্রিত সন্তোষকুমারের পার্শ্বে চক্ষু মুদিয়া শুইয়াছিল। সহসা কানে শব্দ পোঁছিল : পুরাতন পরিচিত স্বরে–কে ডাকে না!

মাধবী উঠিয়া বসিল। ভিতর হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিল। সর্বাঙ্গে ধূলা-কাদা-মাখা–মাষ্টারমহাশয় না?

ও নয়নতারার মা, মাঝিকে শীগগির নৌকা লাগাতে বল্‌।

সুরেন্দ্রনাথ তখন ধীরে ধীরে কাদার উপর শুইয়া পড়িতেছিলেন।

সকলে মিলিয়া সুরেন্দ্রনাথকে ধরাধরি করিয়া নৌকায় তুলিয়া আনিল। মুখে-চোখে জল দিল। একজন মাঝি চিনিত, সে কহিল, লাল্‌তাগাঁয়ের জমিদার। মাধবী ইষ্ট-কবচসুদ্ধ স্বর্ণহার কন্ঠ হইতে খুলিয়া লইয়া তাহার হাতে দিয়া বলিল, লাল্‌তাগাঁয়ে এই রাত্রে পৌছঁতে পার? সবাইকে এক-একটা হার দেব।

সোনার হার দেখিয়া তাহাদের মধ্যে তিনজন গুণ ঘাড়ে লইয়া নামিয়া পড়িল।

মাঠাকরুন, চাঁদনি রাত; ভোর নাগাদ পৌঁছে দেব।

সন্ধ্যার পরে সুরেন্দ্রনাথের জ্ঞান হইল। চক্ষু মেলিয়া তিনি মাধবীর মুখপানে চাহিয়া রহিলেন! মাধবীর মুখে এখন অবগুন্ঠন নাই, শুধু কপালের কিয়দংশ অঞ্চলে ঢাকা। ক্রোড়ের উপর সুরেন্দ্রর মাথা লইয়া মাধবী বসিয়াছিল।

কিছুক্ষণ চাহিয়া সুরেন্দ্র কহিল, তুমি বড়দিদি?

অঞ্চল দিয়া মাধবী সযত্নে তাহার ওষ্ঠ-সংলগ্ন রক্তবিন্দু মুছাইয়া দিল, তাহার পর আপনার চোখ মুছিল।

তুমি বড়দিদি?

আমি মাধবী।

সুরেন্দ্রনাথ চক্ষু মুছিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, আঃ–তাই!

বিশ্বের আরাম যেন এই ক্রোড়ে লুকাইয়াছিল। এতদিন পরে সুরেন্দ্রনাথ তাহা খুঁজিয়া পাইয়াছেন। অধরের কোণে সরক্ত হাসি তাই ফুটিয়া উঠিয়াছে–বড়দিদি, যে কষ্ট!

তর্‌তর্‌‌ ছল্‌ছল্‌ করিয়া নৌকা ছুটিয়াছে। ছইয়ের ভিতর সুরেন্দ্রের মুখের উপর চাঁদের কিরণ পড়িয়াছে। নয়নতারার মা একটা ভাঙ্গা পাখা লইয়া মৃদু মৃদু বাতাস করিতেছে। সুরেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে কহিলেন, কোথায় যাচ্ছিলে?

মাধবী ভগ্নকণ্ঠে কহিল, প্রমীলার শ্বশুরবাড়ি।

ছিঃ–এমন করে কি কুটুমের বাড়ি যেতে আছে দিদি?

দশম পরিচ্ছেদ

নিজের অট্টালিকায়, তাহার শয়নকক্ষে, বড়দিদির কোলে মাথা রাখিয়া সুরেন্দ্রনাথ মৃত্যুশয্যায় শুইয়া আছে। পা-দুটি শান্তি কোলে করিয়া অশ্রুজলে ধুইয়া দিতেছে। পাবনায় যতগুলি ডাক্তার-কবিরাজ সমবেত চেষ্টা ও পরিশ্রমেও রক্ত বন্ধ করিতে পারিতেছে না। পাঁচ বৎসর পূর্বেকার সেই আঘাতে এখন রক্ত বমন করিতেছে।

মাধবীর অন্তরের কথা খুলিয়া বলিতে পারিব না। আমি নিজেও ভাল জানি না, বোধ করি, তাহার পাঁচ বৎসর পূর্বের কথা মনে পড়িতেছে। বাড়ি হইতে সে তাড়াইয়া দিয়াছিল, আর ফিরাইতে পারে নাই; পাঁচ বৎসর পরে সুরেন্দ্রনাথ কিন্তু তাহাকে ফিরাইয়া আনিয়াছে।

সন্ধ্যার পর উজ্জ্বল দীপালোকে সুরেন্দ্রনাথ মাধবীর মুখের পানে চাহিল। পায়ের কাছে শান্তি বসিয়া আছে, সে যেন শুনিতে না পায়–হাত দিয়া তাই মাধবীর মুখ আপনার মুখের কাছে টানিয়া আনিয়া বলিল, বড়দিদি, সেদিনের কথা মনে পড়ে, সেদিন তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আমি তাই এখন শোধ নিয়েছি, তোমাকেও তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, কেমন, শোধ হল ত?

মুহুর্তের মধ্যে মাধবী চৈতন্য হারাইয়া লুন্ঠিত-মস্তক সুরেন্দ্রের স্কন্ধের পার্শ্বে রাখিল,– যখন জ্ঞান হইল, তখন বাঢীময় ক্রন্দনের রোল উঠিয়াছে।

(সমাপ্ত)

0 Shares