বড়দিদি

সুরেন্দ্র বাটী আসিয়া এ কথা ভাবিতে বসিল। যত ভাবিল তত সে দেখিতে পাইল যে, বন্ধু ঠিক বলিয়াছে–ভিক্ষা করিয়া খাওয়া ভাল । সবাই কিন্তু বিলাত যাইতে পারে না, কিন্তু এমন জীবিত ও মৃতের মাঝামাঝি হইয়াও সকলকে দিন কাটাইতে হয় না।

একদিন গভীর রাত্রে সে স্টেশনে আসিয়া কলিকাতার টিকিট কিনিয়া গাড়িতে বসিল এবং ডাকযোগে পিতাকে পত্র লিখিয়া দিল যে, কিছুদিনের জন্য সে বাড়ি পরিত্যাগ করিতেছে, অনর্থক অনুসন্ধান করিয়া বিশেষ লাভ হইবে না এবং সন্ধান পাইলেও যে সে বাটীতে ফিরিয়া আসিবে, এরূপ সম্ভাবনাও নাই।

রায়মহাশয় গৃহিণীকে এ, পত্র দেখাইলেন। তিনি বলিলেন, সুরো এখন মানুষ হইয়াছে–বিদ্যা শিখিয়াছে–পাখা বাহির হইয়াছে–এখন উড়িয়া পলাইবে না ত কখন পলাইবে!

তথাপি তিনি অনুসন্ধান করিলেন–কলিকাতায় যাহারা পরিচিত ছিল, তাহাদিগকে পত্র দিলেন; কিন্তু কোন উপায় হইল না। সুরেন্দ্রের কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কলিকাতার জনকোলাহলপূর্ণ রাজপথে পড়িয়া সুরেন্দ্রনাথ প্রমাদ গণিল। এখানে তিরস্কার করিবারও কেহ নাই, দিবানিশি শাসনে রাখিতেও কেহ চাহে না। মুখ শুকাইলে কেহ ফিরিয়া দেখে না, মুখ ভারী হইলেও কেহ লক্ষ্য করে না। এখানে নিজেকে নিজে দেখিতে হয় । এখানে ভিক্ষাও জোটে, করুণারও স্থান আছে, আশ্রয়ও মিলে–কিন্তু আপনার চেষ্টা চাই; স্বেচ্ছায় কেহই তোমার মাঝে ঝাঁপাইয়া পড়িবে না।

খাইবার চেষ্টা যে আপনাকে করিতে হয়, আশ্রয়ের স্থানটুকু যে নিজেকে খুঁজিয়া লইতে হয়, কিংবা, নিদ্রা এবং ক্ষুধার মাঝে যে একটু প্রভেদ আছে–এইখানে আসিয়া সে এইবার প্রথম শিক্ষা করিল।

কতদিন হইল, সে বাড়ি ছাড়িয়াছে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইয়া শরীরটাও নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া আসিয়াছে, অর্থও ফুরাইয়া আসিতেছে, বস্ত্রাদি মলিন এবং জীর্ণ হইতে চলিল, রাত্রে শুইয়া থাকিবার স্থানটুকুরও কোন ঠিকানা নাই–সুরেন্দ্রের চক্ষে জল আসিল। বাটীতে পত্র লিখিতেও ইচ্ছা হয় না–বড় লজ্জা করে এবং সকলের উপর যখন তাহার বিমাতার সেই স্নেহ-কঠিন মুখখানি মনে পড়ে, তখন বাটি যাইবার ইচ্ছা একেবারে আকাশকুসুম হইয়া দাঁড়ায়। সেখানে যে সে কখনও ছিল এ কথা ভাবিতেও তাহার ভয় হয়।

একদিন সে তাহারই মত একজন দরিদ্রকে কাছে পাইয়া বলিল, বাপু, তোমরা এখানে খাও কি করিয়া?

লোকটা একটু বোকা ধরনের–না হইলে উপহাস করিত। সে বলিল, চাকরি করিয়া খাটিয়া খাই। কলিকাতায় রোজগারের ভাবনা কি?

সুরেন্দ্র বলিল, আমাকে একটা চাকরি করিয়া দিতে পার?

সে কহিল, তূমি কি কাজ জান?

সুরেন্দ্রনাথ কোন কাজই জানিত না, তাই সে চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল।

তুমি কি ভদ্রলোক? –সুরেন্দ্র মাথা নাড়িল।

তবে লেখাপড়া শেখনি কেন?

শিখেছি।

সে লোকটা একটু ভাবিয়া বলিল, তবে ঐ বড়বাড়িতে যাও। ওখানে বড়লোক জমিদার থাকে–একটা কিছু কাজ করিয়া দিবেই। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।

সুরেন্দ্রনাথ ফটকের কাছে আসিল। একবার দাঁড়াইল, আবার পিছাইয়া গেল, আবার ফিরিয়া আসিল–আবার ফিরিয়া গেল। সেদিন আর কিছু হইল না। পরদিনও ঐরূপ করিয়া কাটিল। দুই দিন ধরিয়া সে ফটকের নিকট উমেদারি করিয়া তৃতীয় দিবসে অপেক্ষাকৃত সাহস সঞ্চয় করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। সম্মুখে একজন ভৃত্য দাঁড়াইয়া ছিল। সে জিজ্ঞাসা করিল, কি চান?

বাবুকে–

বাবু বাড়ি নেই।

সুরেন্দ্রনাথের বুকখানা আনন্দে ভরিয়া উঠিল–একটা নিতান্ত শক্ত কাজের হাত হইতে সে পরিত্রাণ পাইল। বাবু বাড়ি নাই। চাকরির কথা, দুঃখের কাহিনী বলিতে হইল না, ইহাই তাহার আনন্দের কারণ। তখন দ্বিগুণ উৎসাহে ফিরিয়া গিয়া, দোকানে বসিয়া পেট ভরিয়া খাবার খাইয়া খানিকক্ষণ সে মনের আনন্দে ঘুরিয়া বেড়াইল, এবং মনে মনে রীতিমত আলোচনা করিতে লাগিল যে, পরদিন কেমন করিয়া কথাবার্তা কহিতে পারিলে তাহার নিশ্চিত একটা কিনারা হইয়া যাইবে।

পরদিন কিন্তু উৎসাহটা তেমন রহিল না। বাটীর যত নিকটবর্তী হইতে লাগিল, ততই তাহার ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা হইতে লাগিল। ক্রমে ফটকের নিকট আসিয়া একেবারে সে দমিয়া পড়িল–পা আর কোন মতেই ভিতরে যাইতে চাহে না। আজ তাহার কিছুতেই মনে হইতেছে না যে, সে নিজের কাজের জন্যই নিজে আসিয়াছে–ঠিক মনে হইতেছিল, যেন জোর করিয়া আর কেহ তাহাকে পাঠাইয়া দিয়াছে। কিন্তু দ্বারের কাছে সে আর উমেদারি করিবে না, তাই ভিতরে আসিল। সেই ভৃত্যটার সহিত দেখা হইল। সে বলিল, বাবু বাড়ি আছেন, দেখা করবেন কি?

হাঁ।

তবে চলুন।

এটা আরও কঠিন!

জমিদারবাবুর প্রকান্ড বাড়ি। রীতিমত সাহেবী ধরনের সাজান আসবাবপত্র। কক্ষের পর কক্ষ, মারবেল-প্রস্তরের সোপানাবলী, ঝাড়লন্ঠন লাল কাপড়ে ঢাকা প্রতি কক্ষে শোভা পাইতেছে, ভিত্তি-সংলগ্ন প্রকান্ড মুকুর, কত ছবি, কত ফটোগ্রাফ। এ-সকল অপরের পক্ষে যাহাই হউক, সুরেন্দ্রের নিকট নূতন নহে। কারণ, তাহার পিতার বাটীও দরিদ্রের কুটীর নহে; আর যাহাই হউক, সে দরিদ্র পিতার আশ্রয়ে এত বড় হয় নাই। সুরেন্দ্র ভাবিতেছেল–সেই লোকটির কথা, যাহার সহিত দেখা করিতে, অনুনয়-বিনয় করিতে যাইতেছে,–তিনি কি প্রশ্ন করিবেন, এবং সে কি উত্তর দিবে।

কিন্তু এত ভাবিবার সময় নাই–কর্তা সম্মুখে বসিয়া ছিলেন; সুরেন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করিলেন, কি প্রয়োজন?

আজ তিন দিন ধরিয়া সুরেন্দ্র এই কথাই ভাবিতেছিল, কিন্তু এখন সব ভুলিয়া গেল, বলিল, আমি–আমি–

ব্রজরাজ লাহিড়ী পূর্ববঙ্গের জমিদার। মাথায় দুই-চারিগাছা চুলও পাকিয়াছে–বাতিকে নহে, ঠিক বয়সেই পাকিয়াছিল। বড়লোক, অনেককে দেখিয়াছিলেন; তাই চট্‌ করিয়া সুরেন্দ্রনাথকে অনেকটা বুঝিয়া লইলেন, কহিলেন, হাঁ বাপু, কি চাও তুমি?

0 Shares