বড়দিদি

কোন একটা–

কি একটা?

চাকরি–

ব্রজরাজবাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, আমি চাকরি দিতে পারি এ সংবাদ তোমাকে কে দিল?

পথে একজনের সহিত দেখা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সে-ই আপনার কথা–

ভাল। তোমার বাড়ি কোথায়?

পশ্চিমে।

সেখানে কে আছে?–সুরেন্দ্রনাথ সব কথা বলিল।

তোমার পিতা কি করেন?

অবস্থাবৈগুণ্যে সুরেন্দ্র নূতন ধাঁচ শিখিয়াছিল–একটু জড়াইয়া জড়াইয়া বলিল, সামান্য চাকরি করেন।

তাতে চলে না, তাই তুমি উপার্জন করিতে চাও?

হাঁ।

এখানে কোথায় থাকো?

কোন নির্দিষ্ট স্থান নাই–যেখানে সেখানে।

ব্রজবাবুর দয়া হইল । সুরেন্দ্রনাথকে কাছে বসাইয়া তিনি বলিলেন, তুমি এখনও বালক মাত্র। এই বয়সে বাড়ি ছাড়িয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছ বলিয়া দু:খ হইতেছে। আমি নিজে যদিও কোনও চাকরি দিতে পারি না, কিন্তু যাহাতে কিছু যোগাড় হয়, তাহার উপায় করিয়া দিতে পারি।

আচ্ছা, বলিয়া সুরেন্দ্রনাথ চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া, ব্রজবাবু তাহাকে ফিরাইয়া বলিলেন, আর কিছু তোমার জিজ্ঞাসা করিবার নাই?

না।

ইহাতেই তোমার কাজ হইয়া গেল? কি উপায় করিতে পারি, কবে করিতে পারি,–কিছুই জানিবার প্রয়োজন বিবেচনা করিলে না?

সুরেন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। ব্রজবাবু সহাস্যে বলিলেন, এখন কোথায় যাইবে?

কোন একটা দোকানে।

সেইখানেই আহার করিবে?

প্রতিদিন তাহাই করি।

তুমি লেখাপড়া কতদূর শিখিয়াছ?

কিছু শিখিয়াছি।

আমার ছেলেকে পড়াইতে পারিবে?

সুরেন্দ্র খুশি হইয়া কহিল, পারিব।

ব্রজবাবু আবার হাসিলেন। তাঁহার মনে হইল, দুঃখে এবং দারিদ্র্যে তাহার মাথার ঠিক নাই, কেননা, কাহাকে শিক্ষা দিতে হইবে এবং কি শিক্ষা দিতে হইবে, এ কথা না জানিয়াই অতটা আনন্দিত হওয়া তাঁহার নিকটে পাগলামি বলিয়া বোধ হইল। বলিলেন, যদি সে বলে, আমি বি. এ. ক্লাসে পড়ি, তখন তুমি কি করিয়া পড়াইবে?

সুরেন্দ্র একটু গম্ভীর হইয়া ভাবিয়া বলিল, তা একরকম হইবে–

ব্রজবাবু আর কোন কথা বলিলেন না। ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, বঙ্কু, এই বাবুটির থাকিবার জায়গা করিয়া দাও, এবং স্নানাহারের যোগাড় দেখ।–পরে সুরেন্দ্রের পানে চাহিয়া বলিলেন, সন্ধ্যার পর আবার ডাকাইয়া পাঠাইব। তুমি আমার বাড়িতেই থাক। যতদিন কোন চাকরির উপায় না হয়, ততদিন স্বচ্ছন্দ্যে এখানে থাকিতে পারিবে।

দ্বিপ্রহরের আহার করিতে গিয়া তিনি জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধবীকে ডাকিয়া কহিলেন, মা, একজন দু:খী লোককে বাড়িতে স্থান দিয়াছি।

কে, বাবা?

দুঃখী লোক, এ ছাড়া আর কিছু জানি না। লেখাপড়া বোধ হয় কিছু জানে, কেননা, তোমার দাদাকে পড়াইবার কথা বলাতে, তাহাতেই সে স্বীকার করিয়াছিল। বি.এ. ক্লাসের ছেলেকে যে পড়াইতে সাহস করিতে পারে, অন্তত তোমার ছোট বোনটিকে সে নিশ্চয়ই পড়াইতে পারিবে। মনে, করিতেছি সে-ই প্রমীলার মাস্টার থাকুক।

মাধবী আপত্তি করিল না।

সন্ধ্যার পর তাহাকে ডাকিয়া আনাইয়া, ব্রজবাবু তাহাই বলিয়া দিলেন। পরদিন হইতে সুরেন্দ্রনাথ প্রমীলাকে পড়াইতে লাগিল।

প্রমীলার বয়স সাত বৎসর। সে বোধোদয় পড়ে। বড়দিদি মাধবীর নিকট ফার্স্ট বুকের ভেকের গল্প পর্যন্ত পড়িয়াছিল। সে খাতাপত্র বই, শ্লেট, পেন্সিল, ছবি, লজেঞ্জেস প্রভৃতি আনিয়া পড়িতে বসিল।

Do not move.– সুরেন্দ্রনাথ বলিয়া দিল–Do not move–নড়িও না।

প্রমীলা পড়িতে লাগিল, Do not move–নড়িও না।

তাহার পর সুরেন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক হইয়া শ্লেট টানিয়া লইল–পেন্সিল হাতে করিয়া আঁক পাড়িয়া বসিল। প্রব্‌লেমের পর প্রব্‌লেম সল্‌ভ হইতে লাগিল–ঘড়িতে সাতটার পর আটটা, তারপর নয়টা বাজিতে লাগিল। প্রমীলা কখনও এ-পাশ কখনও ও-পাশ ফিরিয়া, ছবির পাতা উল্টাইয়া, শুইয়া বসিয়া লজেঞ্জেস মুখে পুরিয়া নিরীহ ভেকের সর্বাঙ্গে মসীলিপ্ত করিতে করিতে পড়িতে লাগিল, Do not move–নড়িও না।

মাস্টারমশাই, বাড়ি যাই?

যাও।

সকালবেলাটা তাহার এইরূপেই কাটে। কিন্তু, দুপুরবেলার কাজটা একটু ভিন্ন প্রকৃতির। চাকুরির যাহাতে উপায় হয়, এজন্য ব্রজবাবু অনুগ্রহ করিয়া দু-একজন ভদ্রলোকের নামে খানকতক পত্র দিয়াছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ এইগুলি পকেটে করিয়া বাহির হইয়া পড়ে। সন্ধান করিয়া তাহাদের বাড়ির সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়। দেখে, কত বড় বাড়ি, কয়টা জানালা,

বাহিরে কতগুলি ঘর, দ্বিতল কি ত্রিতল, সম্মুখে কোন ল্যাম্প-পোস্ট আছে কি না, তাহার পর সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরিয়া আসে।

কলিকাতায় আসিয়াই সে কতগুলি পুস্তক ক্রয় করিয়াছিল, বাড়ি হইতেও কতগুলি লইয়া আসিয়াছিল। এখন সেইগুলি সে গ্যাসের আলোকে অধ্যয়ন করিতে থাকে। ব্রজবাবু কাজকর্মের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, হয় চুপ করিয়া থাকে, নাহয় বলে, ভদ্রলোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ হয় না।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

আজ চারি বৎসর হইল ব্রজরাজবাবুর পত্নীবিয়োগ হইয়াছে–বুড়া বয়সের এ দুঃখ বুড়াতেই বোঝে। কিন্তু সে কথা যাক–তাঁহার আদরের কন্যা মাধবী দেবী যে এই তার ষোল বৎসর বয়সেই স্বামী হারাইয়াছে–ইহাই ব্রজরাজের শরীরের অর্ধেক রক্ত শুষিয়া লইয়াছে। সাধ করিয়া ঘটা করিয়া তিনি মেয়ের বিবাহ দিয়াছিলেন। নিজের অনেক টাকা,–তাই অর্থের প্রতি নজর দেন নাই, ছেলেটির বিষয়-আশয় আছে কি না, খোঁজ লন নাই, শুধু দেখিয়াছিলেন, ছেলেটি লেখাপড়া করিতেছে, রূপবান, সৎ, সাধুচরিত্র লক্ষ্য করিয়া মাধবীর বিবাহ দিয়াছিলেন।

এগার বৎসর বয়সে মাধবীর বিবাহ হইয়াছিল। তিন বৎসর সে স্বামীব কাছে ছিল। যত্ন, স্নেহ, ভালবাসা সবই সে পাইয়াছিল।

কিন্তু যোগেন্দ্রনাথ বাঁচিলেন না। মাধবীর এ জীবনের সব সাধ মুছিয়া দিয়া, ব্রজরাজের বক্ষে শেল হানিয়া, তিনি স্বর্গে চলিয়া গেলেন। মরিবার সময় মাধবী যখন বড় কাঁদিতে লাগিল, তখন তিনি মৃদুকন্ঠে কহিয়াছিলেন, মাধবী, তোমাকে যে ছাড়িয়া যাহিতেছি, এইটিই আমার সব চেয়ে দুঃখ। মরি, তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু তুমি যে আজীবন ক্লেশ পাইবে, এইটি আমাকে বড় বিচলিত করিয়াছে। তোমাকে যে যত্ন করিতে পাইলাম না–

0 Shares