বড়দিদি

নিচে ফেলিয়া সরাইয়া রাখিয়া যায়; যেন কোন দ্রব্যই তাহার মনে ধরে না। ভৃত্যেরা আসিয়া কহে, মাস্টারবাবু পাগলা, কিছু দেখে না, কিছু জানে না–বই নিয়েই বসে আছে।

ব্রজবাবু মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞাসা করেন, চাকরির কোনরূপ সুবিধা হইতেছে কি না। সুরেন্দ্র সে কথার ভাসা ভাসা উত্তর দেয়। মাধবী পিতার নিকট সেসব শুনিতে পায়, সে-ই কেবল বুঝিতে পারে যে, চাকরির জন্য মাস্টারবাবুর একতিল উদ্যোগ নাই, ইচ্ছাও নাই। যাহা আপাতত হইয়াছে, তাহাতেই সে পরম সন্তুষ্ট। বেলা দশটা বাজিলেই বড়দিদির নিকট হইতে স্নানাহারের তাগিদ আসে। ভাল করিয়া আহার না করিলে বড়দিদির হইয়া প্রমীলা অনুযোগ করিয়া যায়। অধিক রাত্রি পর্যন্ত বই লইয়া বসিয়া থাকিলে ভৃত্যেরা গ্যাসের চাবি বন্ধ করিয়া দেয়, বারণ করিলে শুনে না-বড়দিদির হুকুম।

একদিন মাধবী পিতার কাছে হাসিয়া বলিল, বাবা, প্রমীলা যেমন, তার মাস্টারও ঠিক তেমনি।

কেন মা?

দু’জনেই ছেলেমানুষ। প্রমীলা যেমন বোঝে না, তার কখন কি দরকার, কখন কি খাইতে হয়, কখন শুইতে হয়, কখন কি করা উচিত, তার মাস্টারও সেইরকম, নিজের কিছুই বোঝে না–অথচ, অসময়ে এমনি জিনিস চাহিয়া বসে যে, জ্ঞান হইলে তাহা আর কেহ চায় না।

ব্রজবাবু বুঝিতে পারিলেন না, মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

মাধবী হাসিয়া বলিল, তোমার মেয়েটি বোঝে কখন তার কি দরকার?

তা বোঝে না?

অথচ, অসময়ে উৎপাত করে ত?

তা করে।

মাষ্টারবাবু তাই করে–

ব্রজবাবু হাসিয়া বলিলেন, ছেলেটি বোধহয় একটু পাগল।

পাগল নয়। উনি বোধ হয় বড়লোকের ছেলে।

ব্রজবাবু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন করিয়া জানিলে?

মাধবী জানিত না, কিন্তু এমনি বুঝিত। সুরেন্দ্র যে নিজের একটি কাজও নিজ়ে করিতে পারে না, পরের উপর নির্ভর করিয়া থাকে, পরে করিয়া দিলে হয়, না করিয়া দিলে হয় না–এই অক্ষমতাই তাহাকে মাধবীর নিকটে ধরাইয়া দিয়াছিল। তাহার মনে হইত–এটা তাহার পূর্বের অভ্যাস। বিশেষ এই নূতন ধরনের আহার-প্রণালীটা মাধবীকে আরো চমৎকৃত করিয়া দিয়াছে। কোন খাদ্যদ্রব্যই যে তাহার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারেনা, কিছুই সে তৃপ্তিপূর্বক আহার করে না–কোনটির উপরই স্পৃহা নাই, এই বৃদ্ধের মত বৈরাগ্য, অথচ বালকের ন্যায় সরলতা, পাগলের মত উপেক্ষা,–খাইতে দিলে খায়, না দিলে খায় না–এ সকল তাহার নিকট বড় রহস্যময় বোধ হইত। একটা অজ্ঞাত করুণাচক্ষুও সেই জন্য এই অজ্ঞাত মাষ্টারবাবুর উপর পডিয়াছিল। সে যে লজ্জা করিয়া চাহে না, তাহা নহে, তাহার প্রয়োজন হয় না, তাই সে চাহে না। যখন প্রয়োজন হয়, তখন কিন্তু আর সময়-অসময় থাকে না–একেবারে বড়দিদির নিকট আবেদন আসিয়া উপস্থিত হয়। মাধবী মুখ টিপিয়া হাসে, মনে হয়, এ লোকটি নিতান্ত বালকের মত সরল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মনোরমা মাধবীর বাল্যকালের সখী, তাহাকে বহুদিন পত্র লেখা হয় নাই, উত্তর না পাইয়া সে বিষম চটিয়া গিয়াছিল। আজ দ্বিপ্রহরের পর একটু সময় করিয়া, মাধবী তাহাকে পত্র লিখিতে বসিয়াছিল। এমন সময় প্রমীলা আসিয়া ডাকিল, বড়দিদি ! মাধবী মুখ তুলিয়া কহিল, কি?

মাষ্টারমশায়ের চশমা কোথায় হারিয়ে গেছে–একটা চশমা দাও। মাধবী হাসিয়া ফেলিল।

তোমার মাস্টারমশায়কে বল গে, আমি কি চশমার দোকান করি? প্রমীলা ছুটিয়া যাইতেছিল। মাধবী তাহাকে ডাকিয়া ফিরাইল,

কোথায় যাচ্ছিস?

বলতে।

তার চেয়ে সরকারমশায়কে ডেকে নিয়ে আয়।

প্রমীলা সরকারমশায়কে ডাকিয়া আনিলে, মাধবী বলিয়া দিল–মাষ্টারবাবু চশমা হারিয়েছেন, ভাল দেখে একটা কিনে দাও গে।

সরকার চলিয়া গেলে, সে মনোরমাকে পত্র লিখিল, শেষে লিখিয়া দিল–

প্রমীলার জন্য বাবা একজন শিক্ষক নিযুক্ত করিয়াছেন–তাহাকে মানুষ বলিলেও হয়, ছোট ছেলে বলিলেও হয়। আমার বোধ হয়, ইহার পূর্বে সে কখনও বাটীর বাহিরে হয় নাই–সংসারের কিছুই জানে না। তাহাকে না দেখিলে, না তত্ত্ব লইলে তাহার একদন্ডও চলে না। আমার অর্ধেক সময় সে কাড়িয়া লইয়াছে,–তোমাদের পত্র লিখিব আর কখন? এখন যদি তোমার শীঘ্র আসা হয়, তাহা হইলে, এই অকর্মণ্য লোকটিকে দেখাইয়া দিব। এমন অকেজো, অন্যমনস্ক লোক, তুমি জন্মে দেখ নাই। খাইতে দিলে খায়, না দিলে চূপ করিয়া উপবাস করে। হয়ত সমস্ত দিনের মধ্যেও তাহার মনেও পড়ে না যে, তাহার আহার হইয়াছে কি না! একদিনের জন্যও সে আপনাকে চালাইয়া লইতে পারে না। তাই ভাবি এমন লোক সংসারে বাহির হয় কেন? শুনিতে পাই, তাহার পিতামাতা আছেন, কিন্তু আমার মনে হয় তাঁদের পাথরের মত শক্ত প্রাণ। আমি ত বোধ হয়, এমন লোককে চক্ষের আড়াল করিতে পারিতাম না!

মনোরমা তামাশা করিয়া উত্তর লিখিল–তোমার পত্রে অন্যান্য সংবাদের মধ্যে জানিতে পরিলাম যে, তূমি বাড়িতে একটি বাঁদর পুষিয়াছ, আর তুমি তার সীতাদেবী হইয়াছ। কিন্তু তবু একটু সাবধান করিয়া দিতেছি। ইতি–মনোরমা।

পত্র পড়িয়া মাধবীর মুখ ঈষৎ রঞ্জিত হইয়া উঠিল। সে উত্তর লিখিল–তোমার পোড়া মুখ, তাই কাহাকে কি ঠাট্টা করিতে হয়, জান না।

মাধবী জিজ্ঞাসা করিল, প্রমীলা, তোমার মাস্টারমশায়ের চশমা কেমন হয়েছে?

প্রমীলা বলিল, বেশ।

কেমন করে জানলে?

মাস্টারমশায় সেই চশমা চোখে দিয়ে বেশ বই পড়েন–তাই জানলুম।

মাধবী কহিল, তিনি নিজে কিছু বলেন নি?

কিছু না।

একটি কথাও না? ভাল হয়েছে, কি মন্দ হয়েছে, কিছু না?

না কিছু না।

মাধবীর সদাপ্রফুল্ল মুখ যেন মুহূর্তের জন্য মলিন হইল; কিন্তু তখনি হাসিয়া কহিল, তোমার মাস্টারকে বলে দিয়ো, তিনি যেন আর হারিয়ে না ফেলেন।

আচ্ছা, বলে দেব।

দূর পাগ্‌লি, তা কি বলতে আছে! তিনি হয়ত কিছু মনে করবেন।

তবে কি বলব না?

না।

শিবচন্দ্র মাধবীর দাদা। মাধবী একদিন তাহাকে ধরিয়া বলিল, দাদা, প্রমীলার মাস্টার রাতদিন কি পড়ে জান?

0 Shares