বড়দিদি

মাধবী ভাবিল, এ কেমন কথা!

বিন্দু বলিল, তবে আপনি কি জন্য আছেন?

না থাকলে কোথা যাব?

তবে পড়ান না কেন?

সুরেন্দ্রনাথের এবার চৈতন্য হইল! ফিরিয়া বসিয়া কহিল, কি বলচ?

বিন্দু এতক্ষণ ধরিয়া কি কহিতেছিল, তাহাই আবার আবৃত্তি করিল।

সুরেন্দ্রনাথ তখন কহিল, সে ত রোজ পড়ে!

পড়ে, কিন্তু আপনি দেখেন কি?

না। আমার সময় হয় না।

তবে এ বাড়িতে কেন আছেন?–সুরেন্দ্র চুপ করিয়া তাহা ভাবিতে লাগিল।

আপনি আর পড়াতে পারবেন না?

না। আমার পড়াতে ভাল লাগে না।

মাধবী ভিতর হইতে কহিল, জিজ্ঞাসা কর্‌ বিন্দু, কেন এতদিন তবে মিছা কথা বলে আসছেন? বিন্দু তাহাই কহিল। শুনিয়া সুরেন্দ্রের প্রব্‌লেমের জাল একেবারে ছিন্ন হইয়া গেল। একটু দুঃখিত হইল, একটু ভাবিয়া বলিল, তাইত, বড় ভুল হয়েছে।

এই চার মাস ধরে ক্রমাগত ভুল?

হ্যাঁ, তাইত হয়েছে দেখছি–তা কথাটা আমার তত মনে ছিল না।

পরদিন প্রমীলা পড়িতে আসিল না, সুরেন্দ্রেরও তত মনে হইল না। তার পরদিনও আসিল না–সেদিনও অমনি গেল।

তৃতীয় দিবস প্রমীলাকে না দেখিতে পাইয়া সুরেন্দ্রনাথ একজন ভৃত্যকে কহিল, প্রমীলাকে ডেকে আন।

ভৃত্য ভিতর হইতে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, ছোটদিদি আর আপনার কাছে পড়বেন না।

কার কাছে তবে পড়বে?

ভৃত্য বুদ্ধি খরচ করিয়া বলিল, অন্য মাস্টার আসবে।

বেলা তখন নয়টা বাজিয়াছিল। সুরেন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ ভাবিয়া চিন্তিয়া দুই-তিন খানা বই বগলে চাপিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। চশমাটা খাপে পুরিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিল, তারপর ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

ভৃত্য কহিল, মাস্টারবাবু, এ সময়ে কোথায় যাচ্ছেন?

বড়দিদিকে বলে দিও, আমি যাচ্ছি।

আর আসবেন না?

সুরেন্দ্রনাথ একথা শুনিতে পাইল না। বিনা উত্তরে ফটকের বাহিরে আসিয়া পড়িল। বেলা দুইটা বাজিয়া গেল, তথাপি সুরেন্দ্র ফিরিল না। ভৃত্য তখন মাধবীকে সংবাদ দিল যে, মাস্টারমহাশয় চলিয়া গিয়াছেন।

কোথায় গেছেন?

তা জানি না। বেলা নটার সময় চলে যান। যাবার সময় আমায় বলে যান যে, বড়দিদিকে বলো আমি চলে যাচ্ছি।

সে কিরে? না খেয়ে চলে গেলেন? মাধবী উদ্বিগ্ন হইল।

তারপর সে নিজ়ে সুরেন্দ্রনাথের কক্ষে আসিয়া দেখিল–সব জিনিসপত্রই তেমনি আছে, টেবিলের উপর চশমাটি খাপেমোড়া রাখা আছে, শুধু বই কয়খানি নাই।

সন্ধ্যা হইল, রাত্রি হইল–সুরেন্দ্রনাথ আসিল না। পরদিন মাধবী দুইজন ভৃত্যকে ডাকিয়া কহিয়া দিল, তোমরা অনুসন্ধান করিয়া ফিরাইয়া আনিলে দশ টাকা পুরস্কার পাইবে। পুরস্কারের লোভে তাহারা ছুটিল; কিন্তু সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসিয়া কহিল যে, কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।

প্রমীলা কাঁদিয়া কহিল, বড়দিদি, তিনি চলে গেলেন কেন?

মাধবী তাহাকে সরাইয়া দিয়া কহিল, বাইরে যা, কাঁদিস নে।

দুইদিন, তিনদিন করিয়া যতদিন যাইতে লাগিল, মাধবী তত অধিক উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িল। বিন্দু কহিল, বড়দিদি, তা এত খোঁজাখুঁজি কেন? কলকাতা শহরে আর কি মাস্টার পাওয়া যায় না?

মাধবী ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, তুই দূর হ! একটা মানুষ একটি পয়সা হাতে না নিয়ে চলে গেল, আর তুই বলিস খোঁজাখুঁজি কেন?

তার কাছে একটিও পয়সা নেই, তা কি করে জানলে ?

তা আমি জানি, কিন্তু তোর অত কথায় কাজ কি?

বিন্দু চুপ করিয়া গেল। ক্রমে যখন সাতদিন কাটিয়া গেল, অথচ কেহ ফিরিয়া আসিল না, তখন মাধবী একরূপ অন্নজল ত্যাগ করিল। তাহার মনে হইত, সুরেন্দ্রনাথ অনাহারে আছে। যে বাড়ির জিনিস চাহিয়া খাইতে পারে না, পরের কাছে কি সে চাহিতে পারে? তাহার দৃঢ় ধারণা সুরেন্দ্রনাথের কিনিয়া খাইবার পয়সা নাই, ভিক্ষা করিবার সামর্থ্য নাই, ছোটছেলের মত অসহায় অবস্থায় হয়ত বা কোন ফুটপাতে বসিয়া কাঁদিতেছে, না হয় কোন গাছের তলায় বই মাথায় দিয়া ঘুমাইয়া আছে।

ব্রজরাজবাবু ফিরিয়া আসিয়া সব কথা শুনিয়া মাধবীকে কহিলেন, কাজটা ভাল হয়নি মা। মাধবী কষ্টে অশ্রু সংবরণ করিল।

এদিকে সুরেন্দ্রনাথ পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইত। তিনদিন অনাহারে কাটিল, কলের জলে পয়সা লাগে না, তাই ক্ষুধা পাইলে পেট ভরিয়া জল খাইত।

একদিন রাত্রে অবসন্ন শরীরে সে কালীঘাটে যাইতেছিল, কোথায় নাকি শুনিয়াছিল, সেখানে খাইতে পাওয়া যায়। অন্ধকার রাত্রি, তাহাতে আবার মেঘ করিয়াছিল, চৌরঙ্গীর মোড়ে একখানা গাড়ি তাহার উপর আসিয়া পড়িল। গাড়োয়ান কোনরূপে অশ্বের বেগ সংবরণ করিতে পারিয়াছিল। সুরেন্দ্র প্রাণে মরিল না বটে কিন্তু বক্ষে ও পার্শ্বে প্রচন্ড আঘাত পাইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল। পুলিশ আসিয়া গাড়ি করিয়া হাসপাতালে লইয়া গেল। চার-পাঁচদিন অজ্ঞান অবস্থায় অতীত হইবার পর, রাত্রে চক্ষু চাহিয়া কহিল, বড়দিদি!

কলেজের একজন ছাত্র, যে সে-রাত্রে ডিউটিতে ছিল, শুনিতে পাইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সুরেন্দ্র কহিল, বড়দিদি এসেছেন?

কাল সকালে আসবেন।

পরদিন সুরেন্দ্রের বেশ জ্ঞান হইল, কিন্তু বড়দিদির কথা কহিল না, প্রবল জ্বরে সমস্তদিন ছটফট করিয়া সন্ধ্যার সময় একজনকে জিজ্ঞাসা করিল, আমি হাসপাতালে আছি?

হ্যাঁ।

কেন?

আপনি গাড়িচাপা পড়েছিলেন।

বাঁচার আশা আছে?

নিশ্চয়।

পরদিন সেই ছাত্রটি কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার আত্মীয় কেহ এখানে আছেন?

কেহ না।

তবে সে-রাত্রে বড়দিদি বলে ডাকছিলেন কাকে? তিনি কি এখানে আছেন?

আছেন, কিন্তু তিনি আসতে পারবেন না। আমার পিতাকে সংবাদ দিতে পারেন?

পারি।

সুরেন্দ্রনাথ পিতার ঠিকানা বলিয়া দিল। সেই ছাত্রটি সেদিন পত্র লিখিয়া দিল। তাহার পর বড়দিদির সন্ধান লইবার জন্য জিজ্ঞাসা করিল,―এখানে স্ত্রীলোক ইচ্ছা করিলে আসতে পারেন, আমরা সে বন্দোবস্ত করতে পারি। আপনার জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ঠিকানা জানতে পারলে তাঁকেও সংবাদ দিতে পারি।

0 Shares