শুভদা – দ্বিতীয় অধ্যায়

ওঘরে আসিয়া, দুগ্ধের কড়ায় হাত রাখিয়া শুভদা আরো একটু কাঁদিয়া লইল, সাবধান হইয়া আরো দুই-চারিটা বড় বড় ফোঁটা মৃত্তিকার উপরে ফেলিল, তাহার পর চক্ষু মুছিয়া দুগ্ধ ঢালিতে লাগিল। শুভদা কাঁদিল বটে, কিন্তু তাহা অন্তর্ভেদী রক্তবিন্দু নহে; বরং অসম্ভব আনন্দাশ্রু; ললনার শোকের একফোঁটা জল; স্বামীর বেদনার একবিন্দু বারি।

আহার সমাপন করিয়া সদানন্দ মাঠপানে চলিল। সেখানে তাহার ক্ষেত আছে, কৃষাণ কাজ করে, গরুবাছুর চরিয়া বেড়ায়— সেখানে সদানন্দ আলের উপর কিছুক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল, একটা অশ্বত্থমূলে বসিয়া দুই-চারিটা কালীনাম করিল, দুই-চারি ছিলিম তামাকু পোড়াইল, তাহার পর তথা হইতে উঠিয়া হরমোহনবাবুর বৈঠকখানায় আসিয়া উপস্থিত হইল।

বৃদ্ধ হরমোহন তখন নিদ্রান্তে তাম্বুল চর্বণ করিতেছিলেন, কলিকার তাওয়াটা তখনও তত উত্তপ্ত হয় নাই, একটু একটু ধূম নির্গত হইতেছিল মাত্র।

বৃদ্ধ, সদানন্দকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, কি হে, অনেকদিন যে তোমাকে দেখি নাই?

সদানন্দ বলিল, অনেকদিন কাশীতে ছিলাম।

তাহা শুনিয়াছিলাম। তোমার পিসিমাতার কাশীপ্রাপ্তি হইয়াছে তাহাও শুনিয়াছি। আসিলে কবে? বসো।

সদানন্দ বিলক্ষণ সপ্রতিভভাবে নিকটেই স্থান গ্রহণ করিয়া উপবেশন করিল। সদানন্দ মুখবন্ধের ধার ধারে না, মিথ্যা আড়ম্বরের ঘটা তাহার ভাল লাগে না; বসিয়াই বলিল, মহাশয়ের নিকট বিবাহের ঘটক হইয়া আসিয়াছি।

হরমোহন হাসিয়া বলিলেন, কাহার?

আপনার পুত্রের।

বৃদ্ধ এইবার গম্ভীর হইলেন। বিষয়ী লোক সাংসারিক কথাবার্তার সময় হাসিতামাশাগুলিকে অনেকদূরে বিদায় দিয়া আইসেন। হরমোহনের নিকট তাঁহার পুত্রের বিবাহ সম্বন্ধে কথাবার্তা একটা গুরুতর বৈষয়িক আলোচনার মধ্যে। এতাবৎ এবিষয়ে তাঁহাকে অনেক মাথা ঘামাইয়া আসিতে হইয়াছে, অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাইতে হইয়াছে। তাঁহার মতে এরূপ জটিল দেনা-পাওনার যুক্তিতর্কে রীতিমত বুদ্ধি পরিচালনা না করিতে পারিলে কিছুতেই একটা ন্যায্য মীমাংসায় আসিতে পারা যায় না, এবং পলিতমুণ্ড, মুণ্ডিতশ্মশ্রু ব্যক্তি ভিন্ন যে ঘটকালির কথা অপর কাহারও মুখেও আসিতে পারে তাহা তাঁহার ধারণাই ছিল না। এখন উক্তরূপ গম্ভীর বিষয়ের অবতারণা একজন বালকের মুখে শুনিয়া বৃদ্ধ কিঞ্চিৎ বিহ্বল হইয়া পড়িলেন। কিছু দিবস পূর্ব হইতে তিনি শুনিতে পাইতেছিলেন যে, সদানন্দ আরো একটু অধিক বিকৃতমস্তিষ্ক হইয়াছে, এবং এখন তাহার ক্ষিপ্ততা সম্বন্ধে এরূপ অকাট্য প্রমাণ পাইয়া বিলক্ষণ রুক্ষভাবে এবং যথারীতি গম্ভীর হইয়া বলিলেন, কাহার বিবাহ?

শারদার?

আজ্ঞা হাঁ।

বৃদ্ধ অন্যমনস্কভাবে বাটীর ভিতরপানে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক কহিলেন, ঐদিকে বোধ হয় শারদা আছে, যাও।

তাঁহার আকৃতি-প্রকৃতি দেখিয়া একথার অর্থ সদানন্দ বুঝিল। একটু হাসিয়া বলিল, শারদার সহিত আমার প্রয়োজন নাই, আপনার নিকটেই আসিয়াছি।

বৃদ্ধ পূর্বোক্ত প্রকারেই জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার নিকট?

আজ্ঞা হাঁ।

কেন?

এই যে বলিলাম—আপনার পুত্রের সম্বন্ধ করিতে। শারদার কি বিবাহ দিবেন না?

দিব—কিন্তু সে কথা কেন?

প্রয়োজন না থাকিলেই কি আসিয়াছি?

তোমার প্রয়োজন? আমার সহিত?

আজ্ঞা হাঁ।

কিন্তু তোমার সহিত সেসব কথা হইতে পারে না।

সদানন্দ বুঝিল যে, জগতের এ শ্রেণীর লোকের নিকট, মুখে একবিন্দু হাসির চিহ্নমাত্র থাকিলেও সাংসারিক কোনরূপ কথাবার্তা চলিতে পারে না; মুখখানা তোলোহাঁড়ির মত না করিতে পারিলে, সে যে দেনাপাওনা, টাকাকড়ির কথা একবিন্দুও বুঝিতে পারে তাহা এ সম্প্রদায়ের মনুষ্য ধারণার মধ্যেই আনিতে পারে না। তখন সদানন্দ চেষ্টা করিয়া যতখানি পারিল ততখানি গম্ভীর হইয়া বলিল, খুব হইতে পারে। বাল্যকালে আমার পিতৃদেবের স্বর্গলাভ হইয়াছে; সেই অবধি আমিই তাঁহার সমস্ত বিষয়-আশয় দেখিয়া আসিতেছি। সাংসারিক কথাবার্তা আমাদিগকেও কহিতে হয়; বিবাহের সম্বন্ধ করিতে আসিয়া দেনাপাওনা মীমাংসা করিতে হয় তাহা অবগত আছি এবং আশা করি সে বিষয়ে আপনিও যতটা বুঝিবেন, আমিও প্রায় ততটাই বুঝিব।

বৃদ্ধ হরমোহনের এই প্রথম বোধ হইল যে, ইহা ঠিক পাগলের মত বলা হয় নাই। একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, অবশ্য দেনাপাওনার মীমাংসা ত একটা করাই চাই।

সদানন্দ হাসি চাপিতে পারে না; তাই আবার একটু হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, পূর্বেই মহাশয়কে নিবেদন করিয়াছি যে, সে সব আমার সহিত হইলে বিশেষ ক্ষতি হইবে না; তাহার কোনরূপ একটা মীমাংসা করিতে আসিয়াছি।

হরমোহন একটু নরম হইলেন। বলিলেন, কাহার কন্যা? কোথায়?

এই গ্রামেই। শ্রীযুক্ত হারাণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কন্যা।

হারাণের?

আজ্ঞা হাঁ।

সে কি দিবে?

আপনি যাহা চাহিবেন তাহাই।

বৃদ্ধ একটু চিন্তা করিয়া লইলেন ; তাহার পর বলিলেন, মেয়েটি দেখিতে শুনিতে কেমন?

আপনি তাহাকে দেখিয়াছেন, কিন্তু বোধ হয় আপনার স্মরণ নাই; যাহা হউক, মেয়েটি দেখিতে শুনিতে আমার বিবেচনায় মন্দ নয়। আপনার পুত্র তাহাকে দেখিয়াছে—বিবাহ করিতেও অনিচ্ছুক নহে।

বৃদ্ধ এবার একটু হাসিল। বলিল, তা হইলেই হইল। আর আমাদের গৃহস্থ পরিবারে মোমের পুতুলেরও বিশেষ প্রয়োজন নাই; দেখিতে শুনিতে নিতান্ত মন্দ না হয় এবং কাজকর্ম করিতে পারে, এই হইলেই হইল।

সদানন্দ বলিল, তা পারিবে।

কিন্তু হারাণ কি দিতে পারিবে? তার অবস্থা ত এখন ভাল নয়।

না, অবস্থা ভাল নয়। তাই বুঝে আপনি যাহা আদেশ করিবেন তাহাই দিবেন।

বৃদ্ধ একটু মুস্কিলে পড়িলেন। মনে মনে ভাবিলেন, উপরোক্ত কথাটা না বলিলেই ভাল করিতেন। কিন্তু বিষয়-বুদ্ধিশালী হরমোহন তাহা সহজেই শোধরাইয়া লইয়া বলিলেন, তা কি জানি বাপু, মেয়ের বিবাহের কিছু খরচ আছেই।

0 Shares