শুভদা – দ্বিতীয় অধ্যায়

সদানন্দ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। বলিল, যে মরিয়াছে সে নিশ্চয়ই মরিত! তুমি কি করিবে?

শা। তাহা জানি। তবুও যদি তাহার কথা রাখিতাম, যদি বিবাহ করিতাম!

সদানন্দ হাসিল; জাত যাইত যে।

শারদাচরণ তাহা ভাবিল; বলিল, তাহা যাইত।

তবে আর তুমি কি করিবে?

শারদার চোখে জল আসিল। আর কি করিব, কিন্তু এত অনুতাপ হইত না!

সদানন্দ অন্যদিকে চাহিয়া বলিল, ক্রমশঃ চলিয়া যাইবে।

শা। আহা, যদি তাহার শেষ অনুরোধটাও রক্ষা করিতে পারিতাম!

স। কি অনুরোধ?

শা। বলিয়াছিল, একঘর দরিদ্রের জাতি বাঁচাও—ছলনাকে বিবাহ কর।

সদানন্দ তাহার মুখপানে চাহিয়া বলিল, ছলনাকে কি বিবাহ করিবে না?

শা। করিব, কিন্তু তার অনুরোধ রক্ষা করা হইল কি?

স। কেন হইল না?

শা। প্রকারান্তরে হইল বটে, কিন্তু—আচ্ছা সদানন্দ, বাবাকে তুমি কি করিয়া সম্মত করিলে?

সদানন্দ মৃদু হাসিল; বললাম, যে তোমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা আছে।

শা। শুধু এই?

স। আবার কি?

শা। আমি কি বাবাকে চিনি না?

সদানন্দ আবার হাসিল; বলিল, তবে জিজ্ঞাসা কর কেন?

শা। জিজ্ঞাসা করিতেছি যে কত টাকা দিতে হইবে?

স। সেকথা শুনিয়া তোমার লাভ নাই।

শা। সদানন্দ, এ যে পাপের ধন!

স। আমি আশীর্বাদ করিব যেন তোমার জীবন চিরসুখে কাটে।

শা। সময় হইলে আমি ফিরাইয়া দিব।

স। দিও। বলিয়া সদানন্দ উঠিয়া আসিয়া যেস্থানে ললনার বস্ত্র পড়িয়াছিল সেস্থানের মাটি তুলিতে লাগিল।

শারদা বিস্মিত হইয়া বলিল, ও কি কর! সন্ধ্যাবেলা মাটি তোল কেন?

সদানন্দ খুব জোরে হাসিয়া উঠিয়া বলিল, পাগলামি করিতেছি।

বাস্তবিক বলিতে কি, শারদাচরণ তাহার কথার সহিত কাজের বিশেষ প্রভেদ দেখিতে পাইল না; তথাপি বলিল, পাগলামি করিতেছ তাহা ত বলি নাই।

স। তুমি বলিবে কেন, আমি বলিতেছি।

শা। না না, সত্য বল মাটি লইয়া কি করিবে?

স। আমি আজকাল শিবপূজা করি; বাটীতে গঙ্গামাটি নাই তাই লইয়া যাইতেছি।

শারদাচরণ দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল।

সদানন্দ মাটি লইয়া একটা তাল পাকাইল, তাহার পর গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করিয়া হাতমুখ ধুইয়া শারদার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, চল শারদা বাড়ি যাই।

শা। তুমি ওসব কি করিলে?

স। তাহা ত চক্ষেই দেখিলে।

শা। কৈ, শিবপূজার মাটি লইলে না?

স। না। আর শিবপূজা করিব না।

শা। কেন?

স। আর একদিন বলিব।

তখন দুইজনে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিয়া স্ব স্ব আবাসাভিমুখে প্রস্থান করিল। বাটী আসিয়া সদানন্দ সেরাত্রের মত দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।

রাত্রে আহার করিবার জন্য ছলনা, পিসিমা ক্রমে ক্রমে ডাকিতে আসিলেন, কিন্তু সে দ্বার খুলিল না। ভিতর হইতে বলিল, আজ তাহার বড় শরীর খারাপ হইয়াছে। শুভদা দেখিতে আসিলেন, কিন্তু তখন সদানন্দ ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। অনেক ডাকাডাকি করিয়া তিনি ফিরিয়া গেলেন।

পরদিন সকাল হইলে সে আবার উঠিল, মাঠে গেল, আহার করিতে আসিল, হাসিয়া গান গাহিতে লাগিল, নিত্যকর্ম প্রতিদিন যাহা করে তাহাই করিতে লাগিল; কেহ বুঝিল না যে সে প্রতিদিন পরিবর্তিত হইয়া যাইতেছে; কাল যেমন ছিল, আজ ঠিক তেমনটি আর নাই! ক্রমে ১৬ই আষাঢ় ছলনার বিবাহের দিন আসিল। আজি সকলের মুখেই আনন্দ, সকলের মনেই উৎসাহ ; সদানন্দর বসিবার অবকাশ নাই, হারাণ মুখুজ্যের চিৎকারের শেষ নাই, পিসিমাতার চক্ষুজলের অর্গল নাই—বাটীতে যে আসিতেছে, তাহাকেই কাঁদিয়া জানাইতেছে যে, এমন সুখের দিনেও ললনার জন্য তাঁহার মনে একতিল সুখ নাই—বোধ হয় অনেকেই তাঁহার সহিত এ ব্যথা বুঝিতেছে; কেবল শুভদা আজি বড় শ্রান্ত, বড় ধীর।

ক্রমে সন্ধ্যা হইল, অনেক বাজনা–বাদ্য বাজিল, অনেক লোক জমা হইল—তাহার পর শুভক্ষণে শুভলগ্নে ছলনাময়ীর বিবাহ হইয়া গেল।

আজ গ্রামময়, কৃপণ হরমোহনের সুখ্যাতির একটা সাড়া পড়িয়া গিয়েছে; শত্রুতেও মনে মনে স্বীকার করিল যে, হাঁ, মনটা দরজা বটে!

মুখের সম্মুখে কেহ তাঁহার গুণগান করিলে, নিতান্ত কুণ্ঠিতভাবে বৃদ্ধ হরমোহন বলেন, কি আর করি বল, একটি বৈ ছেলে নয়, তার ওখানে বিবাহ করিতে ইচ্ছা—আমি আর তাহাতে অমত কেন করিব? আর গ্রামের মধ্যে আমরাই ওদের পালটি ঘর—প্রতিবাসীকে একটু দেখিতেও হয়!

শারদাচরণ একথা শুনিয়া অলক্ষ্যে ভ্রূ কুঞ্চিত করিত।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

অনেক কাজ ছিল, অনেক কষ্টে তাহা সমাধা হইয়া গিয়াছে! এখন আরাম করিয়া নিঃশ্বাস ফেলিতে বেশ লাগে, কিন্তু দুই–চারিদিন পরে সে আরামটা আর তেমন করিয়া উপভোগ করিয়া উঠিতে পারা যায় না। নিতান্ত আলস্যভাবে নিষ্কর্মার মত বসিয়া থাকিতেও কেমন ব্যাজার বোধ হয়। ছলনাময়ীর বিবাহ দিয়া, লুকাইয়া লুকাইয়া হরমোহনকে বেশ দু পয়সা ঘুষ দিয়া হত্যাপরাধে ধৃত আসামীর খালাস পাওয়ার মত, বিছানায় পড়িয়া মনের আনন্দে পাশবালিশ জড়াইয়া, এপাশ ওপাশ করিয়া গড়াইয়া গড়াইয়া সদানন্দ দুই–চারিদিন নির্বিবাদে কাটাইয়া দিল, তাহার পর বোধ হইতে লাগিল যে, শয্যাটা একটু গরম, বালিশগুলো একটু শক্ত হইয়াছে, ঘরটার ভিতর একটু অধিকমাত্রায় অন্ধকার ঢুকিয়াছে, সদানন্দ উঠিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি সমস্তদিন ধরিয়া হইতেছিল, তাহা তখনও শেষ হয় নাই; কালো মেঘগুলা ছোটখাট বাতাসে দুই–চারি পা করিয়া মাঝে মাঝে সরিয়া দাঁড়াইতেছে বটে, কিন্তু জল বর্ষাইতে ছাড়িতেছে না—ছাড়িবেও না, সদানন্দ অন্ততঃ এইরূপ মনে করিয়া লইল; তাহার পর মাথায় ছাতা দিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। বহুক্ষণ এপথ ওপথ করিয়া, কাপড় ভিজাইয়া, একপা কাদা লইয়া হারাণচন্দ্রের বাটীর ভিতরে আসিয়া খাড়া হইল। শুভদা বোধ হয় রন্ধনশালায় ছিলেন, সদানন্দ সেদিকে গেল না; পিসিমাতা সম্ভবতঃ পাড়া বেড়াইতে গিয়াছিলেন, সে খোঁজ সে লইল না। পা ধুইয়া এদিক ওদিক চাহিয়া যে ঘরে মাধবচন্দ্র শয়ন করিত সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

0 Shares