শুভদা – দ্বিতীয় অধ্যায়

মালতী সেইরূপ ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে কহিল, আমি তোমার দাসীরও দাসীর যোগ্য নই—আমি কে যে আমার জন্য তুমি এতই সহিবে—তোমার কেশাগ্রও বিসর্জন দিবে? আমি আজন্ম দুঃখী—এত করুণা এ জীবনে কখন পাই নাই। তাহার পর কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, যদি শেষ হয়, ঈশ্বর করুন যেন ইহাই আমার শেষ হয়।

সুরেন্দ্রনাথ সযত্নে তাহাকে হাত ধরিয়া উঠাইলেন; তাহার পর পার্শ্বে বসাইয়া বলিলেন, কিন্তু কিছুতেই ত তুমি সুখ পাইতেছ না।

মালতী চক্ষে অঞ্চল দিয়া কহিল, আমরা বড় দরিদ্র।

সু। কিন্তু আমি ত দরিদ্র নহি। আমার যাহা আছে, তোমারও ত তাহা আছে।

মা। আমি নিজের কথা বলিতেছি না।

সু। তবে কাহার কথা? তোমার ত কেহ নাই!

মা। ভগবান জানেন এখন আর কেহ আছে কিনা, কিন্তু যখন চলিয়া আসিয়াছিলাম তখন সব ছিল।

সু। সে কি? নৌকাডুবি হইয়া—

মা। সেসব মিছে কথা, নৌকাডুবি আদতে ঘটে নাই।

সুরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া মালতীর মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। বোধ হয় একবার মনে হইয়াছিল যে, এসকল ছলনা, না সত্য কথা? কিন্তু সে–মুখে ছলনা সম্ভবে না—সে–চক্ষু, সে–অশ্রুজলের মধ্যেও যে প্রতারণা, মিথ্যাকথা প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে তাঁহার তাহা বোধ হইল না। কিছুক্ষণ পরে ডাকিলেন, মালতী।

কি?

সব সত্য?

এবার মালতী মুখপানে চাহিয়া রহিল, দেখিতে দেখিতে তাহার চক্ষু জলে ভরিয়া গেল।

সুরেন্দ্রনাথ লজ্জিত হইলেন, স্বহস্তে অশ্রু মুছাইয়া দিয়া বলিলেন, তবে সব কথা খুলিয়া বল।

মালতী ধীরে ধীরে তখন তাঁহার জানুর উপর মাথা রাখিয়া কখন কাঁদিয়া, কখন স্থির হইয়া বলিতে লাগিল, জন্মাবধি দুঃখের ক্রোড়ে লালিত–পালিত হইয়াছি—কিন্তু আমাদের সব ছিল। পিতা আমার যথাসাধ্য দেখিয়া শুনিয়া বিবাহ দিয়াছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগিনী আমি এক বৎসরের মধ্যেই বিধবা হইলাম—যাঁহার সহিত বিবাহ হইল তাঁহাকে বোধ হয় একবারের অধিক দেখিতেও পাই নাই। আমি বাপের বাটীতে ছিলাম, সেই অবধি পাঁচ বৎসর প্রায় সেইখানেই থাকিলাম। পিতা আমাদিগের গ্রাম হলুদপুর হইতে প্রায় অর্ধ ক্রোশ দূরে এক জমিদারের নিকটে কর্ম করিতেন। সামান্যই বেতন পাইতেন, কিন্তু তাহাতেই আমাদের একরূপ দুঃখ–কষ্টে চলিয়া যাইত। এইসময় তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল।

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, তোমাদের বাড়িতে তখন কে কে ছিলেন?

মা। সবাই ছিলেন—বাবা, মা, পিসিমা, আমরা দুই বোন, আর একটি ছোট ভাই। তাহার পর চুরির অপরাধে বাবার চাকুরি যায়—সেই অবধি নিত্য ভিক্ষা করিয়া কোনদিন আমাদের আহার হইত, কোনদিন হইত না। মা আমার সতীলক্ষ্মী ছিলেন—চাহিয়া চিন্তিয়া যাহা মিলিত তাহাতে অপরাপর সকলকে খাওয়াইয়া মা প্রায় নিত্য উপবাসী থাকিতেন; এমন কি একসঙ্গে তিনদিনও—এই সময় মালতী ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে আপনাকে কিঞ্চিৎ সামলাইয়া লইয়া বলিল, বাবা কিন্তু এসব দিকে ফিরিয়াও চাহিতেন না। গাঁজা-গুলি খাইতেন, যেখানে সেখানে পড়িয়া থাকিতেন—হয়ত বা চার-পাঁচদিন ধরিয়া বাড়িতেই আসিতেন না।

আমার ছোটভাই মাধব প্রায় একবৎসর হইতে পীড়ায় ভুগিতেছিল, চিকিৎসা ভিন্ন কিছুতেই আরোগ্য হইতে পারিতেছিল না, বোধ হয় এতদিনে সে আর বাঁচিয়াও নাই—

এ সময়ে সুরেন্দ্রনাথের চক্ষু জলে ভরিয়া গেল।

তাহার পর মালতী কৃষ্ণঠাকুরানীর কথা বলিল, সদানন্দর কথা বলিল, শেষে বলিল ছলনার কথা। মালতী কহিল, ছলনার বিবাহের বয়স হইল, কিন্তু দরিদ্র বলিয়া কেহ বিবাহ করিতে চাহিল না। বিবাহ না হইলে ব্রাহ্মণের ঘরে জাতি যায়—আমাদেরও জাতি যায়-যায় হইল; মা আমার আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিলেন। পিতা ফিরিয়াও চাহিতেন না, শুধু ভরসা ছিল সদানন্দ, কিন্তু তিনিও তখন দেশে ছিলেন না—কাশীতে তাঁহার পিসিমাতাকে লইয়া গিয়াছিলেন।

পিতার চাকুরি যাইবার পর হইতে ক্রমে ক্রমে এইরূপে ছয়মাস কাটিয়া গেল। পাড়া-প্রতিবেশীতে আর কত সাহায্য করিবে? সদাদাদা কাশী যাবার সময় যে পঞ্চাশ টাকা দিয়া গিয়াছিলেন তাহাও ফুরাইয়া গেল—এ সময়ের কথা আর বলিতে পারি না—মালতী আবার কাঁদিতে লাগিল, সুরেন্দ্রনাথও কাঁদিলেন; কিছুক্ষণ পরে চক্ষু মুছিয়া বলিলেন, আর কাজ নাই—অন্যদিন বলিও।

মালতী চক্ষু মুছিয়া বলিল, আজই বলি। লোকে আমাকে সুন্দরী বলিত, আমি ভাবিতাম কলিকাতায় গিয়া উপার্জন করিব। একদিন রাত্রে গঙ্গার তীরে আসিলাম, মনে করিলাম তীরে তীরে কলিকাতায় যাইব—তাহা হইলে বড় কেহ দেখিতে পাইবে না, কাহাকেও পথও জিজ্ঞাসা করিতে হইবে না। ঘাটে আসিয়া দেখিলাম অদূরে একটা প্রকাণ্ড নৌকা পাল ভরে যাইতেছে, আমি সাঁতার জানিতাম, নৌকা দেখিয়া ভাবিলাম নিঃশব্দে সাঁতার দিয়া নৌকার হাল ধরিয়া থাকিব। শুনিয়াছিলাম আমাদের দেশ হইতে কলিকাতা অধিক দূর নহে—তবে ঠিক জানিতাম না যে কতদূর। ভাবিলাম রাত্রিশেষে নৌকা নিশ্চয় কলিকাতায় পৌঁছিবে, আমিও তখন নামিয়া যাইব। জলে পড়িলাম, সাঁতার দিয়া কিছুদূর আসিলাম—এই সময়ে কাপড়খানা হাতে পায়ে সর্বাঙ্গে জড়াইয়া গেল, আমিও প্রায় ডুবিবার মত হইলাম, কিন্তু বহু ক্লেশে অবশেষে সেখানা খুলিয়া ফেলিলাম, কিন্তু হাত হইতে সেটা পিছলাইয়া কোথায় সরিয়া গেল, এইসময় নৌকাখানাও কাছে আসিয়া পড়িল; আমার হাতপা-ও ধরিয়া গিয়াছিল—ভাবিলাম আর ফিরিয়া যাইতে পারিব না—তাই হালটা ধরিয়া ফেলিলাম।

নৌকা চলিতে লাগিল, আমিও সাহস করিয়া তাহা ছাড়িতে পারিলাম না, ভয় হইল, তাহা হইলেই ডুবিয়া যাইব। এইরূপ বহুদূর চলিয়া আসিলাম। তখন আর ফিরিয়া যাইবারও উপায় ছিল না। অবশেষে স্থির করিলাম, প্রাতঃকালে গঙ্গাস্নান করিতে অনেক স্ত্রীলোকেই আসিয়া থাকে, তাহাদের নিকট বস্ত্রও থাকে—ভিক্ষা করিয়া একটা চাহিয়া লইব—বিবস্ত্রা দেখিলে স্ত্রীলোকের দয়া হইবেই—। তারপর সব তুমি জান।

0 Shares