শুভদা – দ্বিতীয় অধ্যায়

সুরেন্দ্রনাথ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন, তাহার পর ধীরে ধীরে তাহাকে নিজের কাছে টানিয়া লইয়া বলিলেন, যেজন্য এত করিলে এতদিনে তাহার কোন উপায় করিয়াছ কি?

মালতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

সু। তাহা জানি। আর তাই ভাবিতেছি, যে মুখ ফুটিয়া একটি কথা বলিতে পারে না সে কোন্‌ সাহসে এতটা করিয়াছে।

মালতী চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল।

সু। মাসে মাসে কত টাকা হইলে তাঁহাদের চলে?

মা। কুড়ি টাকা।

সু। প্রতি মাসে সেখানে পঞ্চাশ টাকা করিয়া পাঠাইয়া দিও।

মা। তুমি দেবে?

সুরেন্দ্রনাথ হাসিলেন; বলিলেন, দোবো; আরো চাও আরো দোবো।

মালতী মনে মনে কহিল—এতদিনে তাহার জন্ম সার্থক হইল।

সু। তার পরে একটা কাজ করিও—আমাকে বিবাহ করিও—কেননা নরাধম হইলেও—অত শুভ্র হৃদয়ে আমি কলঙ্কের ছাপ লাগিতে দিব না।

মালতী তাঁহার বুকের ভিতর মাথা রাখিয়া অস্ফুটে কহিল, না—

সু। কেন—না? তুমি ভাবিতেছ আমার জাতি যাইবে; কিন্তু আমি এস্থানের জমিদার, আমার অনেক টাকা—যাহার টাকা আছে তাহার জাতি শীঘ্র যায় না।

মা। গোলমাল হইবে।

সু। হইবে। কিন্তু তাহাও অধিকদিন স্থায়ী হইবে না।

মা। বংশ, কুল, মান, সম্ভ্রম?

সু। মালতী! একদিনের জন্যও সেসকল ভুলতে দাও—জগতে আসিয়া অনেক দ্রব্য পাইয়াছি—কিন্তু সুখ কখন পাই নাই; একদিনের জন্য আমাকে যথার্থ সুখী হইতে দাও।—

কথা শুনিয়া মালতীর ভিতর পর্যন্ত কাঁদিয়া উঠিল, কিন্তু তাহা চাপিল। ধীরে ধীরে বলিল, আমি তোমার নিকট চিরদিন থাকিব।

সু। ঈশ্বর করুন তাহাই হউক। তুমি চিরদিন থাকিবে, কিন্তু আমি পারিব কি? তুমি সংসার দেখ নাই, কিন্তু আমি দেখিয়াছি। আমি জানি আমাকে বিশ্বাস নাই। যে প্রেমে তুমি চিরজীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটাইয়া দিবে, আমি হয়ত কোনদিন তাহা মাঝখানে ছিন্ন করিয়া পলাইয়া যাইব। মালতী! সময় থাকিতে আমাকে বাঁধিয়া ফেল।

মালতী ভাল করিয়া সমস্ত শুনিল, অনেক দিনের পর আর একবার স্থির হইয়া ভাবিয়া লইল—তাহার পর অকম্পিতকণ্ঠে কহিল, বাঁধিয়াছি, পার ইহাই ছিন্ন করিও। ইহার উপর আর বন্ধনের প্রয়োজন নাই।

সু। তোমার নাই কিন্তু আমার আছে।

মা। থাকুক, কিন্তু বিবাহ হইতে পারে না।

সু। কেন, বিধবাকে কি বিবাহ করিতে নাই?

মা। বিধবাকে বিবাহ করিতে আছে, কিন্তু বেশ্যাকে নাই।—

সুরেন্দ্রনাথের সহসা সমস্ত শরীর শিহরিয়া উঠিল—তুমি কি তাই?

মা। নয় কি? নিজেই ভাবিয়া দেখ দেখি।

সু। ছি ছি!—ওকথা মুখে আনিও না—তোমাকে কত ভালবাসি।

মা। সেইজন্যই মুখে আনিলাম; না হইলে হয়ত বিবাহ করিতেও সম্মত হইতাম।

সু। মালতী!

মা। কি?

সু। সব কথা খুলিয়া বলিবে?

মা। বলিব। তুমি ভিন্ন আমার দেহ পূর্বে কেহ স্পর্শও করে নাই, কিন্তু একজনকে মনপ্রাণ সমস্তই মনে মনে দিয়াছিলাম।

সু। তার পর?

মা। আমাকে বিবাহ করিবার জন্য তাহাকে অনেক সাধিয়াছিলাম।

সু। তার পর?

মা। জাতি যাইবার ভয়ে সে বিবাহ করিল না।

সু। সে মনপ্রাণ ফিরাইয়া লইলে কিরূপে?

মা। সে যেরূপে ফিরাইয়া দিল।

সু। পারিলে?

মালতী একটু মৌন থাকিয়া কহিল, পূর্বেই বলিয়াছি, আমি বেশ্যা—বেশ্যায় সব পারে।

সু। উঃ—সে কি সদানন্দ?

মা। না—আর একজন।

সু। তবে তুমি মানুষ চিনিতে পার নাই—তাহাকে বল নাই কেন? সে তোমাকে ভালবাসিত।

সহসা মালতীর সর্বাঙ্গে তড়িৎপ্রবাহ ছুটিয়া গেল। সেই পাগল ক্ষ্যাপা মুখখানা! মালতীর মনে পড়িল, সেই বৃষ্টির দিন; সে সন্ধ্যার সময় ঘাট হইতে জল আনিতেছিল, পথিমধ্যে বৃষ্টি আসিয়া পড়িল, ভিজিয়া জ্বর হইবার ভয়ে সদানন্দর বাটীতে আশ্রয় গ্রহণ করিল। মনে পড়িল, সেই প্রথম তাহার নিকট অর্থসাহায্য পাওয়া; তাহার পর নিত্য হাতে গুঁজিয়া দেওয়া; সেই কাশী যাইবার দিন; সেই বালিশের নীচে একরাশ টাকা দেওয়া;—সেই আরো কত কি! মনে পড়িল, দুঃখের সময় সেই সহানুভূতি। নিমিষে তাহার চক্ষুর্দ্বয় জলে ভরিয়া গেল, কিন্তু বহিয়া পড়িবার পূর্বে মালতী তাহা মুছিয়া ফেলিল। সুরেন্দ্রনাথ কিন্তু তাহা দেখিতে পাইলেন না। তিনি কৌচের বাহুতে হেলান দিয়া চক্ষু মুদিয়া অন্য অনেক কথা ভাবিতেছিলেন, বলিলেন, তারপর?

মা। কলিকাতায় যাইতেছিলাম।

সু। তারপর?

মা। দয়া করিয়া পায়ে স্থান দিয়াছ।

পূর্বোক্ত প্রশ্ন তিনি অন্যমনস্ক হইয়া বলিয়াছিলেন, উত্তর শুনিয়া তাহা বুঝিলেন। উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, মালতী, তুমি রত্ন। রত্ন কুস্থানে পাইলেও গলায় পরিতে হয়।

মা। কে বলিল? যে রত্ন একজন গলায় পরে, অন্যে হয়ত তাহা পায়ে রাখিতেও ঘৃণা বোধ করেন। তুমি আমাকে চরণে স্থান দিও,—আমি রত্ন, তাহাতেই পরম সৌভাগ্য মনে করিব।

সুরেন্দ্রনাথ অল্প হাসিলেন; বলিলেন, মালতী, আমি ভাবিতাম তুমি বোকা, কিন্তু তা তুমি নও—

মালতী অল্প হাসিল। দুঃখে কষ্টে আজ তাহার অধরে প্রথম হাসির রেখা দেখা দিল।

এই সময়ে বাহির হইতে দাসী বলিল, বাবু, অঘোরবাবুর জুড়ি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।

সুরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইলেন; অঘোরবাবুর? কিন্তু এ বাগানবাড়িতে কেন?

তিনি বলে পাঠিয়েছেন বড় দরকার।

সুরেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি উঠিয়া বলিলেন, মালতী, এখন তবে আসি।

এস। কিন্তু অঘোরবাবু কে?

পরে শুনিও।

অঘোরবাবুকে জিজ্ঞাসা করিও, তিনি কোথায় বিবাহ করিয়াছেন?

সুরেন্দ্রনাথ হাসিয়া ফেলিলেন—কেন, পরিচয় আছে নাকি?

বোধ হয় কতক আছে!

একাদশ পরিচ্ছেদ

জন্মিলে মরিতে হয়, আকাশে প্রস্তর নিক্ষেপ করিলে তাহাকে ভূমিতে পড়িতে হয়, খুন করিলে ফাঁসি যাইতে হয়, চুরি করিলে কারাগারে যাইতে হয়, তেমনি ভালবাসিলে কাঁদিতে হয়—অপরাপরের মত ইহাও একটি জগতের নিয়ম। কিন্তু এ নিয়ম কে প্রচলিত করিল জানি না। ঈশ্বর-ইচ্ছায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া চক্ষে জল আপনি ফুটিয়া উঠে, কিংবা মানুষে শখ করিয়া কাঁদে, কিংবা দায়ে পড়িয়া কাঁদে, অথবা চিরপ্রসিদ্ধ মৌলিক আচার বলিয়াই তাহাদিগকে বাধ্য হইয়া কাঁদিতে হয়—তাহা যাঁহারা ভালবাসিয়াছেন এবং তাহার পরে কাঁদিয়াছেন, তাঁহারাই বিশেষ বলিতে পারেন। আমরা অধম, এ স্বাদ কখন পাইলাম না, না হইলে ইচ্ছা ছিল ভালবাসিয়া একচোট খুব কাঁদিয়া লইব, ভালবাসার ক্রন্দনটা মিষ্ট বা কটু পরীক্ষা করিব। আবার ইহাতে বড় আশঙ্কার কথাও আছে, শুনিতে পাই ইহাতে নাকি বুক-ফাটাফাটি কাণ্ডও বাঁধিয়া উঠে, অমনি শিহরিয়া শতহস্ত পিছাইয়া দাঁড়াই—মনে ভাবি এ যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে সহসা গিয়া পড়িব না। অদৃষ্ট ভাল নয়—কি জানি যদি পরীক্ষা করিতে গিয়া শেষে নিজের বুকখানাই ফাটাইয়া লইয়া বাটী ফিরিয়া আসিতে হয়; এ ইচ্ছার আমি ঐখানেই ইস্তফা দিয়াছি। তবে কৌতূহল আছে। যেখানে কেহ ভালবাসিয়া কাঁদে, আমি উঁকিঝুঁকি মারিয়া তাহা দেখিতে থাকি; বিবর্ণ, শঙ্কিতমুখে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকি, বুঝি এইবার বা ইহার বুকখানা ফাটিয়া যাইবে দেখিতে পাইব, কিন্তু সে যখন অবশেষে চোখের জল মুছিয়া হৃষ্টপুষ্টভাবে উঠিয়া বসে তখন দুঃখিত হইয়া ফিরিয়া যাই। তবে এমন ইচ্ছা করি না যে, তাহাদের বুকখানা ফাটিয়া যাউক, কিন্তু দেখিবার ইচ্ছাও কি জানি কেন এ পোড়া মন হইতে একেবারে ফেলিয়া দিতে পারি না। আজও সেইজন্য মালতীর এখানে আসিয়াছি। যাহা দেখিয়াছি তাহা পরে বলিতেছি, কিন্তু যাহা শিখিয়াছি তাহা এই যে, মানুষ ভালবাসিয়া ঈশ্বরের সম্মুখীন হইয়া দাঁড়ায়, মালতীর মত ভালবাসার এ অশ্রু-বিসর্জন ভগবান-পদপ্রান্তে পদ্মের মত ফুটিয়া উঠে। আপনাকে ভুলিয়া, যোগ্যাযোগ্য বিবেচনা না করিয়া, পরের চরণে তাহার মত আত্মবলিদানে অজ্ঞাতে শুধু তাঁহারই সাধনা করা হয়—মানুষ জীবন্মুক্ত হয়। লোকে হয়ত পাগল বলে, আমিও হয়ত পূর্বে কত বলিয়াছি—কিন্তু তখন বুঝি নাই যে, এরূপ পাগল জগতে সচরাচর মিলে না; এইরূপ পাগল সাজিতে পারিলেও এ তুচ্ছ জীবনের অনেকটা কাজ হয়।

0 Shares