সুরেন্দ্রবাবু পরপারে তীরের অনতিদূরে জলের উপর কালো মত কি একটা পদার্থ ভাসিয়া আছে, তাহাই দেখিতেছিলেন। পদার্থটা একটা মনুষ্য-মস্তক বলিয়া বোধ হইতেছিল—তাহাই মনোযোগ করিয়া দেখিতেছিলেন। ওস্তাদজীর শব্দ প্রথমে কর্ণে প্রবেশ করিল না।
ওস্তাদজী উত্তর না পাইয়া আবার বলিল, হুজুর!
সুরেন্দ্রবাবু ফিরিয়া চাহিলেন। ওস্তাদজীকে দেখিয়া বলিলেন, ওস্তাদজী, এখন বোধ হয় ঝড় আসিবে না; একটু গীতবাদ্য হউক।
সে মাথা নাড়িয়া বলিল, যো হুকুম।
সুরেন্দ্রবাবু আবার সেই পদার্থটা দেখিতে লাগিলেন।
অল্পক্ষণ পরেই একজন যুবতী আসিয়া নিকটে একখানা গালিচার উপর উপবেশন করিল। পশ্চাতে ওস্তাদজী বাঁয়াতবলা হাতে করিয়া ছাদের উপর উঠিতেছিল; সুরেন্দ্রনাথ দেখিয়া বলিলেন, ওস্তাদজী, তুমি নীচে যাও—বাজনায় আর কাজ নেই; আজ শুধুই গান হউক।
ওস্তাদজী একটু শুষ্ক হাস্য করিয়া নামিয়া গেল।
ইতিপূর্বে যে স্ত্রীলোকটি গালিচার উপর আসিয়া বসিয়াছিল তাহার নাম জয়াবতী; বয়সে বোধ হয় বিংশতি হইবে। বেশ হৃষ্টপুষ্ট সুডৌল শরীর—দেখিতে মন্দ নহে; বহুদিবস হইতে সুরেন্দ্রবাবুর অনুগ্রহ পাইয়া আসিতেছে। বাঙ্গালীর ঘরের মেয়ে, সাজসজ্জার আড়ম্বর বেশি কিছু ছিল না। একখানা দেশী কালাপেড়ে শাটি ও দুই-একখানা গহনা পরিয়া শিষ্টশান্ত ঘরের বধূটির মত স্থির হইয়া বসিয়াছিল। সুরেন্দ্রবাবু তাহার পানে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, জয়া, আজ যে তোমাকে সমস্ত দিন দেখি নাই?
মাথার বেদনায় সমস্ত দিন শুয়েছিলাম।
এখন ভাল হয়েছে কি?
জয়াবতী অল্প আসিয়া বলিল, অল্প।
গান গাইতে পারবে কি?
জয়াবতী আবার হাসিল—হুকুম করুন।
হুকুম আর কি, যা ইচ্ছা হয় গাও।
জয়াবতী গীত গাহিতে আরম্ভ করিল।
সুরেন্দ্রবাবু পরপারস্থিত ভাসমান কৃষ্ণ পদার্থটার পানে চক্ষু রাখিয়া অন্যমনস্কভাবে শুনিতে লাগিলেন। শুনিতে শুনিতে কিছুক্ষণ পরে, জয়াবতীর গান শেষ হইবার পূর্বেই বলিয়া উঠিলেন, জয়া, ওটা নড়ে বেড়াচ্চে—না?
জয়াবতী গান ছাড়িয়া সেটা বিশেষ পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, বোধ হয়।
তবে আমার দূরবীনটা। ডাকিয়া বলিলেন, ওরে নীচে থেকে আমার দূরবীনের বাক্সটা নিয়ে আয় ত।
দূরবীন আসিলে বাক্স খুলিয়া বহুক্ষণ ধরিয়া সেই পদার্থটা দেখিয়া দূরবীন বাক্সবন্ধ করিয়া রাখিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন।
জয়াবতী জিজ্ঞাসা করিল, কি ওটা?
একজন মানুষ বলে বোধ হয়।
এতক্ষণ ধ’রে জলে কি কচ্চে?
তা জানি নে। দেখলে হয়।
একজন লোক পাঠিয়ে দিন না।
আমি নিজেই যাব। অনুজ্ঞা মত একজন মাঝি অল্পক্ষণ পরে বজরাসংলগ্ন বোট লইয়া আসিল।
সুরেন্দ্রবাবু বলিলেন, ওপারে চল।
বোট কাছে আসিলে সুরেন্দ্রবাবু দেখিলেন, পদ্মের মত অনিন্দ্যসুন্দর একজন স্ত্রীলোক গলা পর্যন্ত জলে ডুবাইয়া, কাল মেঘের মত একরাশি চুল নীল জলের উপর চতুর্দিকে ভাসাইয়া দিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সুরেন্দ্রবাবু আরও নিকটে আসিলেন, তথাপি, স্ত্রীলোকটা উঠিল না বা উঠিবার ইচ্ছাও প্রকাশ করিল না, যেমন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়াছিল সেইরূপভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
সুরেন্দ্রবাবু একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, নিকটে কোন গ্রাম আছে কি?
স্ত্রীলোকটি বলিল, আমি বলতে পারি না। বোধ হয় নাই।
তবে তুমি এখানে কোথা হতে এলে?
স্ত্রীলোকটি চুপ করিয়া রহিল।
তোমার বাড়ি কি নিকটেই?
না; অনেক দূর।
তবে এখানে কেন?
আমাদের নৌকা ডুবিয়া গিয়াছিল।
কবে?
কাল রাত্রে।
তোমার সঙ্গীরা কোথায়?
বলিতে পারি না।
তুমি এতক্ষণ ধরিয়া জলে দাঁড়াইয়া আছ কেন? নিকটবর্তী কোন গ্রাম অনুসন্ধান কর নাই কেন?
সে পুনর্বার চুপ করিয়া রহিল।
সুরেন্দ্রবাবু কথার উত্তর না পাইয়া বলিলেন, তোমার বাড়ি এখান হইতে কতদূরে হইবে?
প্রায় দশ-বারো ক্রোশ।
কোন্ দিকে?
সুরেন্দ্রবাবুর বজরা যেদিকে যাইতেছিল সেইদিকটা দেখাইয়া দিয়া বলিল, ঐদিকে।
সুরেন্দ্রবাবু একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, আমি ঐদিকেই যাইব। আমার বজরায় স্ত্রীলোক আছে, যদি কোনরূপ আপত্তি না থাকে ত আমার সহিত আইস; তোমাকে বাটী পৌঁছাইয়া দিব।
আবার সে মৌন হইয়া রহিল।
সুরেন্দ্রবাবু না বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, যাইবে?
যাইব।
তবে আইস।
পুনর্বার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল, আমার কাপড় ভাসিয়া গিয়াছে।
এইবার সুরেন্দ্রনাথ বুঝিলেন, সে কিজন্য এতক্ষণ ধরিয়া জলে দাঁড়াইয়া আছে। নিজে তীরে নামিয়া মাঝিকে পুনরায় বজরায় ফিরিয়া গিয়া বস্ত্র আনিতে বলিয়া দিয়া বলিলেন, বস্ত্র আসিলে আমার সহিত যাইবে ত?
স্ত্রীলোকটি মাথা নাড়িয়া বলিল, যাইবে।
মাঝি বস্ত্র লইয়া প্রত্যাগমন করিল, অল্পক্ষণ পরে সুরেন্দ্রনাথ সকলকে লইয়া বজরায় আসিয়া উঠিলেন।
বজরায় আসিয়া সুরেন্দ্রবাবু আগন্তুককে জয়াবতীর জিম্মা করিয়া দিলেন; সে মিষ্ট সম্ভাষণ করিয়া, যত্ন, আত্মীয়তা করিয়া তাহাকে আপনার কামরায় সে রাত্রের মত লইয়া গেল।
আহার করাইয়া, পান দিয়া, কাছে বসিয়া জয়াবতী কহিল, ভাই, তোমার নামটি?
আমার নাম মালতী। তোমার নাম?
জয়াবতী। তোমাদের বাড়ি?
মহেশপুরে।
এখান থেকে কত দূরে?
প্রায় দশ-বারো ক্রোশ উত্তরে।
তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথা ভাই?
মালতী ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কোথাও নয়।
সে কি—বিয়ে হয়নি?
হয়েছিল, কিন্তু সেসব চুকে গেছে।
জয়াবতী একটু দুঃখিতভাবে কহিল, কতদিন?
অনেক দিন। আমার সেসব কথা মনে পড়ে না।
জয়াবতী একথা চাপিয়া দিয়া বলিল, তোমাদের বাড়িতে কে আছে?
কেউ নেই। এক পিসি ছিল, তিনিও বোধ হয় বেঁচে নেই।
জয়াবতী বুঝিল নৌকাডুবির কথা আসিয়া পড়িয়াছে, সুতরাং এ কথারও আন্দোলন করা উচিত মনে করিল না। কহিল, তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে ভাই?
মালতী একটু চিন্তা করিয়া বলিল, সাগরদ্বীপে।