শেষ প্রশ্ন

অজিত মুশকিলে পড়িল। সঙ্গে আজ সোফার পর্যন্ত ছিল না, শিবনাথবাবুও গৃহে নাই তাহা পূর্বেই শুনিয়াছে, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করিতেও বাধিল। একটুখানি দ্বিধা করিয়া কহিল, এখানে আপনার সঙ্গী-সাথী বুঝি কেউ নেই?

কমল কহিল, শোন কথা! সঙ্গী-সাথী পাব কোথায়? দেখুন না চেয়ে একবার পল্লীর দশা। শহরের বাইরে বললেই হয়,—সাহগঞ্জ না কি নাম, কোথাও কাছাকাছি বোধ করি একটা চামড়ার কারখানা আছে,—আমার প্রতিবেশী ত শুধু মুচিরা। কারখানায় যায় আসে, মদ খায়, সারা রাত হল্লা করে,—এই ত আমার পাড়া।

অজিত জিজ্ঞাসা করিল, এদিকে ভদ্রলোক বুঝি নেই?

কমল বলিল, বোধ হয় না। আর থাকলেই বা কি—আমাকে তারা বাড়িতে যেতে দেবে কেন? তা হলে ত,—মাঝে মাঝে যখন বড্ড একলা মনে হয়,—তখন আপনাদের ওখানেও যেতে পারতাম। বলিতে বলিতে সে গাড়ির খোলা দরজা দিয়া নিজেই ভিতরে গিয়া বসিল; কহিল, আসুন, আমি অনেকদিন মোটরে চড়িনি। আজ কিন্তু আমাকে অনেকদূর পর্যন্ত বেড়িয়ে আনতে হবে।

কি করা উচিত অজিত ভাবিয়া পাইল না, সঙ্কোচের সহিত কহিল, বেশী দূরে গেলে রাত্রি হয়ে যেতে পারে। শিবনাথবাবু বাড়ি ফিরে আপনাকে দেখতে না পেলে হয়ত কিছু মনে করবেন।

কমল বলিল, নাঃ,—মনে করবার কিছু নেই।

অজিত কহিল, তা হলে ড্রাইভারের পাশে না বসে ভেতরে বসুন না?

কমল বলিল, ড্রাইভার ত আপনি নিজে। কাছে না বসলে গল্প করব কি করে? অতদূরে পিছনে বসে বুঝি মুখ বুজে যাওয়া যায়? আপনি উঠুন, আর দেরি করবেন না।

অজিত উঠিয়া বসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। পথ সুন্দর এবং নির্জন, কদাচিৎ এক-আধজনের দেখা পাওয়া যায়,—এইমাত্র। গাড়ির দ্রুতবেগ ক্রমশঃ দ্রুততর হইয়া উঠিল, কমল কহিল, আপনি জোরে গাড়ি চালাতেই ভালবাসেন, না?

অজিত বলিল, হাঁ।

ভয় করে না?

না। আমার অভ্যাস আছে।

অভ্যাসই সব। এই বলিয়া কমল একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, কিন্তু আমার ত অভ্যাস নেই, তবু এই আমার ভাল লাগচে। বোধ হয় স্বভাব, না?

অজিত কহিল, তা হতে পারে।

কমল কহিল, নিশ্চয়। অথচ এর বিপদ আছে। যারা চড়ে তাদেরও, আর যারা চাপা পড়ে তাদেরও,—না?

অজিত কহিল, না, চাপা পড়বে কেন?

কমল কহিল, পড়লেই বা অজিতবাবু! দ্রুতবেগের ভারী একটা আনন্দ আছে। গাড়িরই বা কি, আর এই জীবনেরই বা কি! কিন্তু যারা ভীতু লোক তারা পারে না। সাবধানে ধীরে ধীরে চলে। ভাবে পথ হাঁটার দুঃখটা যে বাঁচলো এই তাদের ঢের। পথটাকে ফাঁকি দিয়েই তারা খুশী, নিজেদের ফাঁকিটা টেরও পায় না। ঠিক না অজিতবাবু?

কথাটা অজিত বুঝিতে পারিল না, বলিল, এর মানে?

কমল তাহার মুখের পানে চাহিয়া একটুখানি হাসিল। ক্ষণেক পরে মাথা নাড়িয়া বলিল, মানে নেই। এমনি।

কথাটা সে যে বুঝাইয়া বলিতে চাহে না, এইটুকুই শুধু বুঝা গেল, আর কিছু না।

অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া আসিতেছে। অজিত ফিরিতে চাহিল, কমল কহিল, এরই মধ্যে? চলুন আর একটু যাই।

অজিত কহিল, অনেকদূরে এসে পড়েচি। ফিরতে রাত হবে।

কমল বলিল, হলই বা।

কিন্তু শিবনাথবাবু হয়ত বিরক্ত হবেন।

কমল জবাব দিল, হলেনই বা।

অজিত মনে মনে বিস্মিত হইয়া বলিল, কিন্তু আশুবাবুদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, বিলম্ব হলে ভাল হবে না।

কমল প্রত্যুত্তরে কহিল, আগ্রা শহরে ত গাড়ির অভাব নেই, তাঁরা অনায়াসে যেতে পারবেন। চলুন, আরো একটু। এমনি করিয়া কমল যেন তাহাকে জোর করিয়াই নিরন্তর সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল।

ক্রমশঃ লোকবিরল পথ একান্ত জনহীন ও রাত্রির অন্ধকার প্রগাঢ় হইয়া উঠিল, চারিদিকের দিগন্ত-বিস্তৃত প্রান্তর নিরতিশয় স্তব্ধ। অজিত হঠাৎ একসময়ে উদ্বিগ্ন-চিত্তে গাড়ির গতিরোধ করিয়া বলিল, আর না, ফিরি চলুন।

কমল কহিল, চলুন।

ফিরিবার পথে সে ধীরে ধীরে বলিল, ভাবছিলাম, মিথ্যের সঙ্গে রফা করতে গিয়ে জীবনের কত অমূল্য সম্পদই না মানুষে নষ্ট করে। আমাকে একলা নিয়ে যেতে আপনার কত সঙ্কোচই না হয়েছিল, আমিও যদি সেই ভয়েই পেছিয়ে যেতাম, এমন আনন্দটি ত অদৃষ্টে ঘটত না।

অজিত কহিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত না দেখে নিশ্চয় করে ত কিছুই বলা যায় না। ফিরে গিয়ে আনন্দের পরিবর্তে নিরানন্দও ত অদৃষ্টে লেখা থাকতে পারে।

কমল কহিল, এই অন্ধকার নির্জন পথে একলা আপনার পাশে বসে ঊর্ধ্বশ্বাসে কত দূরেই না বেড়িয়ে এলাম। আজ আমার কি ভালই যে লেগেছে তা আর বলতে পারিনে।

অজিত বুঝিল কমল তাহার কথায় কান দেয় নাই,—সে যেন নিজের কথা নিজেকেই বলিয়া চলিতেছে। শুনিয়া লজ্জা পাইবার মত হয়ত সত্যই ইহাতে কিছুই নাই, তবুও প্রথমটা সে যেন সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। ওই মেয়েটির সম্বন্ধে বিরুদ্ধ কল্পনা ও অশুভ জনশ্রুতির অতিরিক্ত বোধ হয় কেহই কিছু জানে না,—যাহা জানে তাহারও হয়ত অনেকখানি মিথ্যা,—এবং সত্য যাহা আছে তাহাতেও হয়ত অসত্যের ছায়া এমনি ঘোরালো হইয়া পড়িয়াছে যে চিনিয়া লইবার পথ নাই। ইচ্ছা করিলে যাচাই করিয়া যাহারা দিতে পারে তাহারা দেয় না, যেন সমস্তটাই তাহাদের কাছে একেবারে নিছক পরিহাস।

অজিত চুপ করিয়া আছে, ইহাতেই কমলের যেন চেতনা হইল। কহিল, ভাল কথা, কি বলছিলেন, ফিরে গিয়ে আনন্দের বদলে নিরানন্দ অদৃষ্টে লেখা থাকতে পারে? পারে বৈ কি!

অজিত কহিল, তা হলে?

কমল বলিল, তা হলেও এ প্রমাণ হয় না, যে আনন্দ আজ পেলাম তা পাইনি!

এবার অজিত হাসিল। বলিল, সে প্রমাণ হয় না, কিন্তু এ প্রমাণ হয় যে আপনি তার্কিক কম নয়। আপনার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা ভার।

অর্থাৎ যাকে বলে কূট-তার্কিক, তাই আমি?

অজিত কহিল, না, তা নয়, কিন্তু শেষ ফল যার দুঃখেই শেষ হয় তার গোড়ার দিকে যত আনন্দই থাক, তাকে সত্যকার আনন্দভোগ বলা চলে না। এ ত আপনি নিশ্চয়ই মানেন?

কমল বলিল, না, আমি মানিনে। আমি মানি, যখন যেটুকু পাই তাকেই যেন সত্যি বলে মেনে নিতে পারি। দুঃখের দাহ যেন আমার বিগত-সুখের শিশিরবিন্দুগুলিকে শুষে ফেলতে না পারে। সে যত অল্পই হোক, পরিমাণ তার যত তুচ্ছই সংসারে গণ্য হোক, তবুও যেন না তাকে অস্বীকার করি। একদিনের আনন্দ যেন না আর একদিনের নিরানন্দের কাছে লজ্জাবোধ করে। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, এ জীবনে সুখ-দুঃখের কোনটাই সত্যি নয় অজিতবাবু, সত্যি শুধু তার চঞ্চল মুহূর্তগুলি, সত্যি শুধু তার চলে যাওয়ার ছন্দটুকু। বুদ্ধি এবং হৃদয় দিয়ে একে পাওয়াই ত সত্যিকার পাওয়া। এই কি ঠিক নয়?

0 Shares