শেষ প্রশ্ন

আশুবাবু নিজেও বোধ হয় ক্ষণকালের জন্য বিমনা হইয়া পড়িয়াছিলেন, হঠাৎ সচেতন হইয়া পূর্ব প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিয়া কহিলেন, মজা দেখলে ত অজিত? আমি নিশ্চয় বলছি এ ঐ শিবনাথ লোকটার কৌশল।

অজিত কহিল, না-ও হতে পারে। না জেনে বলা যায় না।

আশুবাবু বলিলেন, তা বটে! কিন্তু আমার বিশ্বাস, এ চাল শিবনাথের। আমাকে সে বড়লোক বলে জানে।

অজিত কহিল, এ খবর ত সবাই জানে। কমল নিজেও না জানে তা নয়।

আশুবাবু বলিলেন, তা হলে ত ঢের বেশী অন্যায়। স্বামীকে লুকোনো ত ভাল কাজ নয়।

অজিত চুপ করিয়া রহিল। আশুবাবু কহিতে লাগিলেন, স্বামীর অগোচরে, হয়ত বা তাঁর মতের বিরুদ্ধে পরের কাছে টাকা ধার করিতে যাওয়া স্ত্রীলোকের কত বড় অন্যায় বল ত? এ কিছুতে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।

অজিত কহিল, তিনি টাকা ত চাননি, শুধু জামিন হতে অনুরোধ করেছিলেন।

আশুবাবু বলিলেন, সে ঐ একই কথা। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, আর ঐ আমাকে আত্মীয় পরিচয়ে লোকটাকে ছলনা করাই বা কিসের জন্য? সত্যিই ত আমি তার আত্মীয় নই।

অজিত বলিল, তিনি হয়ত আপনাকে সত্যিই আত্মীয় মনে করেন। বোধ হয় কাউকেই ছলনা করা তাঁর স্বভাব নয়।

না না, কথাটা ঠিক ওভাবে বলিনি অজিত। এই বলিয়া তিনি নিজের কাছেই যেন জবাবদিহি করিলেন। সেই লোকটিকে হঠাৎ ঝোঁকের উপর বিদায় করা পর্যন্ত মনের মধ্যে তাঁহার ভারী একটা গ্লানি চলিতেছিল; কহিলেন, সে আমাকে আত্মীয় বলেই যদি জানে, আর দু-পাঁচশো টাকার যদি দরকারই পড়েছিল, সোজা নিজে এসে ত নিয়ে গেলেই হত। খামকা একটা বাইরের লোককে সকলের সামনে পাঠানোর কি আবশ্যকতা ছিল? আর যাই বল, মেয়েটার বুদ্ধি-বিবেচনা নেই।

বেহারা আসিয়া খাবার দেওয়া হইয়াছে, জানাইয়া গেল। অজিত উঠিতে যাইতেছিল, আশুবাবু কহিলেন, লোকটাকে মার্ক করেছিলে অজিত, বিশ্রী চেহারা—মনি-লেন্‌ডার কিনা। ফিরে গিয়ে হয়ত নানান্‌খানা করে বানিয়ে বলবে।

অজিত হাসিয়া কহিল, বানানোর দরকার হবে না আশুবাবু, সত্যি বললেই যথেষ্ট হবে। এই বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইতেই তিনি বাস্তবিকই বিচলিত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন, এই অক্ষয় লোকটা একেবারে নুইসেন্স। মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। না হয় একটা কাজ কর না অজিত। যদুকে ডেকে ঐ দেরাজটা খুলে দেখ না কি আছে। অন্ততঃ পাঁচ-সাতশো টাকা,—আপাততঃ যা আছে পাঠিয়ে দাও। আমাদের ড্রাইভার বোধ হয় তাদের বাসাটা চেনে—শিবনাথকে মাঝে মাঝে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। এই বলিয়া তিনি নিজেই চীৎকার করিয়া বেহারাকে ডাকাডাকি শুরু করিয়া দিলেন।

অজিত বাধা দিয়া বলিল, যা হবার তা হয়েই গেছে, আজ রাত্রে থাক, কাল সকালে বিবেচনা করে দেখলেই হবে।

আশুবাবু প্রতিবাদ করিলেন, তুমি বোঝ না অজিত বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে সে রাত্রেই কখনো লোক পাঠাতো না।

অজিত কিছুক্ষণ স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শেষে বলিল, ড্রাইভার বাড়ি নেই, মনোরমাকে নিয়ে কখন ফিরবে তাও ঠিকানা নেই। ইতিমধ্যে কমল সমস্তই শুনতে পাবেন। তার পরে আর টাকা পাঠান উচিত হবে না আশুবাবু। বোধ হয় আপনার হাত থেকে আর তিনি সাহায্য নেবেন না।

কিন্তু এ ত তোমার শুধু অনুমানমাত্র অজিত।

হাঁ, অনুমান বৈ আর কি।

কিন্তু, বিদেশে তার টাকার প্রয়োজন ত এর চেয়েও বড় হতে পারে?

তা পারে, কিন্তু তাঁর আত্মমর্যাদার চেয়েও বড় না হতে পারে।

আশুবাবু বলিলেন, কিন্তু এ-ও ত শুধু তোমার অনুমান।

অজিত সহসা উত্তর দিল না। ক্ষণকাল অধোমুখে নিঃশব্দে থাকিয়া কহিল, না, এ আমার অনুমানের চেয়ে বড়। এ আমার বিশ্বাস। এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

আশুবাবু আর তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন না, কেবল বেদনায় দুই চক্ষু প্রসারিত করিয়া সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। কমলের সম্বন্ধে এ বিশ্বাস অসম্ভবও নয়, অসঙ্গতও নয়। ইহা তিনি নিজেও জানিতেন। নিরুপায় অনুশোচনায় বুকের ভিতরটা যেন তাঁহার আঁচড়াইতে লাগিল।

পরিচ্ছেদ – তের

নারী-কল্যাণ-সমিতি হইতে ফিরিয়া নীলিমা অবিনাশকে ধরিয়া পড়িল, মুখুয্যেমশাই, কমলকে আমি একবার দেখব। আমার ভারী ইচ্ছে করে তাকে নেমত্যন্ন করে খাওয়াই।

অবিনাশ আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, তোমার সাহস ত কম নয় ছোটগিন্নী; শুধু আলাপ নয়, একেবারে নেমত্যন্ন করা!

কেন, সে বাঘ না ভালুক? তাকে এত ভয়টা কিসের?

অবিনাশ বলিলেন, বাঘ-ভালুক এদেশে মেলে না, নইলে তোমার হুকুমে তাদেরও নেমত্যন্ন করে আসতে পারি, কিন্তু এঁকে নয়। অক্ষয় খবর পেলে আর রক্ষে থাকবে না। আমাকে দেশছাড়া করে ছাড়বে।

নীলিমা কহিল, অক্ষয়বাবুকে আমি ভয় করিনে।

অবিনাশ বলিলেন, তুমি না করলেও ক্ষতি নেই, আমি একা করলেই তাঁর কাজ চলে যাবে।

নীলিমা জিদ করিয়া বলিল, না, সে হবে না। তুমি না যাও আমি নিজে গিয়ে তাঁকে আহ্বান করে আসব।

কিন্তু আমি ত তাদের বাসাটা চিনিনে।

নীলিমা কহিল, ঠাকুরপো চেনেন। আমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তিনি তোমাদের মত ভীতু লোক নন।

একটু ভাবিয়া বলিল, তোমাদের মুখে যা শুনি তাতে শিবনাথবাবুরই দোষ,— তাঁকে ত আমি নেমত্যন্ন করতে চাইনে। আমি চাই কমলকে দেখতে, তার সঙ্গে আলাপ করতে! কমল যদি আসতে রাজী হয়, ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের স্ত্রী—তিনিও বলেচেন আসবেন। বুঝলে?

অবিনাশ বুঝিলেন সমস্তই, কিন্তু স্পষ্ট করিয়া সম্মতি দিতে পারিলেন না। অথচ বাধা দিতেও ভরসা পাইলেন না। নীলিমাকে তিনি শুধু স্নেহ ও শ্রদ্ধা করিতেন তাই নয়, মনে মনে ভয় করিতেন।

পরদিন সকালে হরেন্দ্রকে ডাকাইয়া আনিয়া নীলিমা কহিল, ঠাকুরপো, তোমাকে আর একটি কাজ করে দিতে হবে। তুমি আইবুড়ো মানুষ, ঘরে বৌ নেই যে সদাচারের নাম করে তোমার কান মলে দেবে। বাসায় ত থাকো, শুধু বাপ-মা-মরা একপাল ছাত্র নিয়ে,—তোমার ভয়টা কিসের?

0 Shares