শেষ প্রশ্ন

ভিতরে আসিয়া কমল আহার্য দ্রব্যের প্রাচুর্য দেখিয়া মুহূর্তকাল নীরবে থাকিয়া কহিল, আমার খাওয়াই হয়েছে, কিন্তু এ-সব আমি খাইনে।

সকলে ব্যস্ত হইয়া উঠিলে সে কহিল, আপনারা যাকে হবিষ্যান্ন বলেন—আমি তাই শুধু খাই।

শুনিয়া নীলিমা অবাক হইল, কহিল, সে কি কথা! আপনি হবিষ্যি খেতে যাবেন কিসের দুঃখে?

কমল কহিল, সে ঠিক। দুঃখ নেই তা নয়, কিন্তু এ-সব খাইনে বলেই অভাবটাও আবার কম। আপনি কিছু মনে করবেন না।

কিন্তু মনে না করিলে চলে না। নীলিমা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, না খেলে এত জিনিস যে আমার নষ্ট হবে?

কমল হাসিল, কহিল, যা হবার তা হয়েছে,—সে আর ফিরবে না। তার ওপর খেয়ে আবার নিজে নষ্ট হই কেন?

নীলিমা কাতর হইয়া শেষ চেষ্টা করিয়া বলিল, শুধু আজকের মত, কেবল একটা দিনের জন্যেও কি নিয়ম ভঙ্গ করতে পারেন না?

কমল মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

তাহার হাসিমুখের একটিমাত্র শব্দ। শুনিলে হঠাৎ কিছুই মনে হয় না। কিন্তু ইহার দৃঢ়তা যে কত বড়—তাহা পৌঁছিল হরেন্দ্রের কানে। শুধু সে-ই বুঝিল ইহার ব্যতিক্রম নাই। তাই গৃহকর্ত্রীর দিক হইতে অনুরোধের পুনরুক্তির সূত্রপাতেই সে বাধা দিয়া কহিল, থাক বৌদি, আর না। খাবার আপনার নষ্ট হবে না, আমার বাসার ছেলেদের এনে চেঁচে-পুঁছে খেয়ে যাব, কিন্তু ওঁকে আর নয়। বরঞ্চ, যা খাবেন, তার যোগাড় করে দিন।

নীলিমা রাগ করিয়া বলিল, তা দিচ্ছি। কিন্তু আমাকে আর সান্ত্বনা দিতে হবে না ঠাকুরপো, তুমি থাম। এ ঘাস নয় যে তোমার একপাল ভেড়া নিয়ে এসে চরিয়ে দেবে। আমি বরঞ্চ রাস্তায় ফেলে দেব—তবু তাদের খাওয়াব না।

হরেন্দ্র হাসিয়া কহিল, কেন, তাদের ওপর আপনার রাগ কিসের?

নীলিমা বলিল, তাদের জন্যেই ত তোমার যত দুর্গতি। বাপ টাকা রেখে গেছেন, নিজেও উপার্জন কম কর না। এতদিনে বৌ এলে ত ছেলেপুলেয় ঘর ভরে যেত। এ হতভাগা কাণ্ড ত ঘটত না। নিজেও যেমন আইবুড়ো কার্তিক, দলটিও তৈরি হচ্চে তারই উপযুক্ত। তাদের আমি কিছুতেই খাওয়াব না—এই তোমাকে আমি বলে দিলাম। যাক আমার নষ্ট হয়ে।

কমল বুঝিতে কিছুই পারিল না, আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল। হরেন্দ্র লজ্জা পাইয়া কহিল, বৌদির অনেকদিন থেকে আমার ওপরে নালিশ আছে এ তারই শাস্তি। এই বলিয়া সে সংক্ষেপে জিনিসটা বিবৃত করিয়া কহিল, বাপ-মা-মরা নিরাশ্রয় গুটিকয়েক ছাত্র আছে আমার, তারা আমার কাছে থেকে ইস্কুল কলেজে পড়ে। তাদের ওপরেই ওঁর যত আক্রোশ।

কমল অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, তাই নাকি? কৈ, এ ত এতদিন শুনিনি?

হরেন্দ্র বলিল, শোনবার মত কিছুই নয়। কিন্তু চরিত্রবান ভাল ছেলে তারা। তাদের আমি ভালবাসি।

নীলিমা ক্রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, বড় হয়ে তারা দেশোদ্ধার করবে এই তাদের পণ। অর্থাৎ, গুরুর মত ব্রহ্মচারী হয়ে দিগ্বিজয়ী বীর হবে বোধ করি।

হরেন্দ্র বলিল, যাবেন একবার তাদের দেখতে? দেখলে খুশী হবেন।

কমল তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, আমি কালই যেতে পারি—যদি নিয়ে যান।

হরেন্দ্র বলিল, না কাল নয়, আর একদিন। আমাদের আশ্রমের রাজেন এবং সতীশ গেছে কাশী বেড়াতে; তারা ফিরে এলে আপনাকে নিয়ে যাব। আমি নিশ্চয় বলতে পারি—তাদের দেখলে আপনি খুশী হবেন।

অবিনাশ সেইমাত্র আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, শুনিয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, কতকগুলো লক্ষ্মীছাড়ার আড্ডা বুঝি এরই মধ্যে আশ্রম হয়ে উঠল? কত ভণ্ডামিই তুই জানিস হরেন!

নীলিমা রাগ করিল। কহিল, এ তোমার অন্যায় মুখুয্যেমশায়। ঠাকুরপো ত তোমার কাছে আশ্রমের চাঁদা চাইতে আসেন নি যে ভণ্ড বলে গাল দিচ্চ? নিজের খরচে পরের ছেলে মানুষ করাকে ভণ্ডামি বলে না। বরঞ্চ, যারা বলে—তাদেরই তাই বলে ডাকা উচিত।

হরেন হাসিয়া বলিল, বৌদি, এইমাত্র যে আপনি নিজেই তাদের ভেড়ার পাল বলে তিরস্কার করছিলেন—এখন আপনারই কথার প্রতিধ্বনি করতে গিয়ে সেজদার ভাগ্যে এই পুরস্কার?

নীলিমা কহিল, আমি বলছিলাম রাগে। কিন্তু উনি বলেন কোন্‌ লজ্জায়? ভণ্ডামির ধারণা আগে নিজের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠুক, তার পরে যেন পরকে বলতে যান।

কমল জিজ্ঞাসা করিল, আপনার ছেলেরা ত সবাই ইস্কুল-কলেজে পড়েন?

হরেন বলিল, হাঁ, প্রকাশ্যে তাই বটে।

অবিনাশ কহিলেন, আর অপ্রকাশ্যে কি-সব প্রাণায়াম, রেচক-কুম্ভকের চর্চা করা হয়, সেটাও অম্‌নি খুলে বল?

শুনিয়া সবাই হাসিল। নীলিমা অনুনয়ের সুরে কমলকে কহিল, মুখুয্যেমশায়ের আজকের মেজাজ দেখে যেন ওঁর বিচার করে নেবেন না। মাঝে মাঝে মাথা ওঁর অনেক ঠাণ্ডা থাকে। নইলে বহু পূর্বেই আমাকে পালিয়ে বাঁচতে হতো। এই বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

কোথায় একটুখানি যেন উত্তাপের বাষ্প জমিয়া উঠিতেছিল, এই স্নিগ্ধ পরিহাসটুকুর পরে যেন তাহা মিলাইয়া গেল। বামুনঠাকুর আসিয়া জানাইল, কমলের খাবার তৈরি হইয়া গেছে। অতএব, এখনকার মত আলোচনা স্থগিত রাখিয়া সকলকে উঠিতে হইল।

ঘণ্টা-দুই পরে আহারাদি সমাধা হইলে পুনরায় সকলে আসিয়া যখন বাহিরের ঘরে বসিলেন,—কমল তখন পূর্ব-প্রসঙ্গের সূত্র ধরিয়া প্রশ্ন করিল, ছেলেরা রেচক-কুম্ভক না কুম্ভক না করুক, কলেজের পড়া মুখস্থ করা ছাড়াও ত কিছু করে,—সে কি?

হরেন্দ্র বলিল, করে। ভবিষ্যতে যাতে সত্যিই মানুষ হতে পারে সে চেষ্টাতেও তাদের অবহেলা নেই। কিন্তু পায়ের ধূলো যেদিন পড়বে সেদিন সমস্ত বুঝিয়ে বলব, আজ নয়।

এই মেয়েটির প্রতি সম্মানের আতিশয্যে অবিনাশের গা জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু তিনি চুপ করিয়াই রহিলেন।

নীলিমা কহিল, আজ বলতেই বা বাধা কি ঠাকুরপো? তোমার শেখানোর পদ্ধতি না হয় না-ই ভাঙলে কিন্তু পুরাকালের ভারতীয় আদর্শে নিজের মত করে যে তাদের ব্রহ্মচর্য শিক্ষা দিচ্চ এ কথা জানাতে দোষ কি? তোমার কাছে ত আমি আভাসে একদিন এই কথাই শুনেছিলাম।

0 Shares