শেষ প্রশ্ন

হরেন্দ্র সবিনয়ে বলিল, মিথ্যে শুনেচেন তাও ত বলচি নে বৌদি, বলিয়াই তাহার সেদিনের তর্কের ব্যাপারটা স্মরণ হইল। কমলের প্রতি চাহিয়া বলিল, আপনারও বোধ করি আমার কাজে সহানুভূতি নেই?

কমল কহিল, কাজটা আপনার ঠিক কি, না জানলে ত বলা যায় না হরেনবাবু। কিন্তু পুরাকালের ছাঁচে তৈরি করে তোলাটাই যে সত্যিকারের মানুষের ছাঁচে গড়ে তোলা এও ত যুক্তি নয়।

হরেন্দ্র বলিল, কিন্তু সেই যে আমাদের ভারতের আদর্শ?

কমল জবাব দিল, ভারতের আদর্শই যে চিরযুগের চরম আদর্শ,—এই বা কে স্থির করে দিলে বলুন?

অবিনাশ এতক্ষণ কথা কহেন নাই, রাগ চাপিয়া বলিলেন, চরম আদর্শ না হতে পারে কমল, কিন্তু এ আমাদের পূর্বপিতামহগণের আদর্শ। ভারতবাসীর এই নিত্যকালের লক্ষ্য—এই তাদের একটিমাত্র চলবার পথ। হরেনের আশ্রমের ব্যাপার আমি জানিনে, কিন্তু সে এই লক্ষ্যই যদি গ্রহণ করে থাকে আমি তাকে আশীর্বাদ করি।

কমল কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া কহিল, জানিনে কেন মানুষের এ ভুল হয়। নিজেদের ছাড়া তারা যেন আর কোন ভারতবাসীকে চোখে দেখতেই পায় না। আরও ত ঢের জাত আছে—তারা এ আদর্শ নেবে কেন?

অবিনাশ কুপিত হইয়া কহিলেন, চুলোয় যাক তারা। আমার কাছে এ আবেদন নিষ্ফল। আমি শুধু নিজেদের আদর্শ-ই স্পষ্ট করে দেখতে পেলে যথেষ্ট মনে করব।

কমল ধীরে ধীরে বলিল, এ আপনার অত্যন্ত রাগের কথা অবিনাশবাবু। নইলে এতবড় অন্ধ ভাবতে আপনাকে আমার প্রবৃত্তি হয় না। একটুখানি থামিয়া বলিল, কিন্তু কি জানি, পুরুষেরা সবাই বুঝি শুধু এমনি করেই ভাবে। সেদিন অজিতবাবুর সুমুখেও হঠাৎ এই প্রসঙ্গই উঠে পড়েছিল। ভারতের সনাতন বৈশিষ্ট্য, তার স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হবার উল্লেখে তাঁর সমস্ত মুখ ব্যথায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এতদিন তিনি ছিলেন উৎকট স্বদেশী,—আজও মনে মনে হয়ত তাই আছেন,—এ সম্ভাবনা তাঁর কাছে কেবল প্রলয়ের নামান্তর। এই বলিয়া সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিল। অবিনাশ কি একটা বোধ হয় জবাব দিতেছিলেন, কিন্তু, কমল সেদিকে দৃকপাত না করিয়াই বলিতে লাগিল, কিন্তু আমি ভাবি এতে ভয় কিসের? বিশেষ কোন একটা দেশে জন্মেচি বলে তারই নিজস্ব আচার-আচরণ চিরদিন আঁকড়ে থাকতে হবে কেন? গেলই বা তার বিশেষত্ব নিঃশেষ হয়ে। এতই কি মমতা? বিশ্বের সকল মানব যদি একই চিন্তা, একই ভাব, একই বিধি-নিষেধের ধ্বজা বয়ে দাঁড়ায়—কি তাতে ক্ষতি? ভারতীয় বলে চেনা যাবে না এই ত ভয়? না-ই বা গেল চেনা। বিশ্বের মানবজাতির একজন বলে পরিচয় দিতে ত কেউ বাধা দেবে না। তার গৌরবই বা কি কম?

অবিনাশ সহসা জবাব খুঁজিয়া না পাইয়া বলিলেন, কমল, তুমি যা বলচ, নিজে তার অর্থ বোঝ না। এতে মানুষের সর্বনাশ হবে।

কমল উত্তর দিল, মানুষের হবে না অবিনাশবাবু, যারা অন্ধ তাদের অহঙ্কারের সর্বনাশ হবে।

অবিনাশ কহিল, এ-সব নিছক শিবনাথের কথা।

কমল কহিল, তা ত জানিনে—তিনিও এ কথা বলেন।

এবার অবিনাশ আত্মবিস্মৃত হইলেন। বিদ্রূপে মুখ কালো করিয়া বলিলেন, খুব জান। কথাগুলি মুখস্থ করেচ। আর জান না কার?

তাঁহার এই কদর্য দৃঢ়তার জবাব কমল দিল না, দিল নীলিমা। কহিল, কথা যারই হোক মুখুয্যেমশায়, মাস্টারিগিরি কাজে কড়া কথার ধমক দিয়ে ছাত্রের মুখ বন্ধ করা যায়, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয় না। প্রশ্নের জবাব না দিতে পারলে ত লজ্জা নেই, কিন্তু ভদ্রতা লঙ্ঘন করায় লজ্জা আছে। কিন্তু ঠাকুরপো, একটা গাড়ি ডাকতে পাঠাও না ভাই। তোমাকে কিন্তু গিয়ে পৌঁছে দিতে হবে। তুমি ব্রহ্মচারী মানুষ, তোমাকে সঙ্গে দিতে ত আর ভয় নেই। এই বলিয়া সে কটাক্ষে অবিনাশের প্রতি চাহিয়া বলিল, মুখুয্যেমশায়ের মুখের চেহারা যে-রকম মিষ্টি হয়ে উঠচে—তাতে বিলম্ব করা আর সঙ্গত হবে না।

অবিনাশ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, বেশ ত, তোমরা বসে গল্প কর না, আমি শুতে চললাম। বলিয়া উঠিয়া গেলেন।

চাকর গাড়ি ডাকিতে গিয়াছিল, হরেন্দ্র কমলকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, আমার আশ্রমে কিন্তু একদিন যেতে হবে। সেদিন আনতে গেলে কিন্তু না বলতে পারবেন না।

কমল সহাস্যে কহিল, ব্রক্ষ্মচারীদের আশ্রমে আমাকে কেন হরেনবাবু? না-ই বা গেলাম?

না, সে হবে না। ব্রহ্মচারী বলে আমরা ভয়ানক কিছু নই। নিতান্তই সাদাসিধে। গেরুয়াও পরিনে, জটা-বল্কলও ধারণ করিনে। সাধারণের মাঝখানে আমরা তাদের সঙ্গেই মিশে আছি।

কিন্তু সেও ত ভাল নয়! অসাধারণ হয়েও সাধারণের মধ্যে আত্মগোপনের চেষ্টা আর একরকমের জোচ্চুরি। বোধ হয় অবিনাশবাবু একেই বলেছিলেন ভণ্ডামি। তার চেয়ে বরঞ্চ জটা-বল্কল-গেরুয়া ঢের ভাল। তাতে মানুষকে চেনবার সুবিধে হয়, ঠকবার সম্ভাবনা কম থাকে।

হরেন্দ্র কহিল, আপনার সঙ্গে তর্কে পারবার জো নেই—হটতেই হবে। কিন্তু বাস্তবিক, আমাদের প্রতিষ্ঠানটিকে আপনি কি ভাল বলেন না? পারি, আর না পারি, এর আদর্শ কত বড়!

কমল কহিল, তা বলতে পারব না হরেনবাবু। সমস্ত সংযমের মত যৌন-সংযমেও সত্য আছে। কিন্তু সে গৌণ সত্য। ঘটা করে তাকে জীবনের মুখ্য সত্য করে তুললে সে হয় আর এক-ধরনের অসংযম। তার দণ্ড আছে। আত্ম-নিগ্রহের উগ্র দম্ভে আধ্যাত্মিকতা ক্ষীণ হয়ে আসে। বেশ, আমি যাব আপনার আশ্রমে।

হরেন্দ্র বলিল, যেতেই হবে,—না গেলে আমি ছাড়ব না। কিন্তু একটা কথা বলে রাখি, আমাদের আড়ম্বর নেই—ঘটা করে আমরা কিছুই করিনে। সহসা নীলিমাকে দেখাইয়া কহিল, আমার আদর্শ উনি। ওঁর মতই আমরা সহজের পথিক। বৈধব্যের কোন বাহ্যপ্রকাশ ওঁতে নেই,—বাইরে থেকে মনে হবে যেন বিলাস-ব্যসনে মগ্ন হয়ে আছেন, কিন্তু জানি ওঁর দুঃসাধ্য আচার-নিষ্ঠা, ওঁর কঠোর আত্মশাসন!

কমল মৌন হইয়া রহিল। হরেন্দ্র ভক্তি ও শ্রদ্ধায় বিগলিত হইয়া বলিতে লাগিল, আপনি ভারতের অতীত যুগের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন নন, ভারতের আদর্শ আপনাকে মুগ্ধ করে না; কিন্তু বলুন ত—নারীত্বের এতবড় মহিমা, এতবড় আদর্শ আর কোন্‌ দেশে আছে? এই গৃহের উনি গৃহিণী, সেজদার মা-মরা সন্তানের উনি জননীর ন্যায়। এ-বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব ওঁর উপরে। অথচ, কোন স্বার্থ, কোন বন্ধন নেই। বলুন ত, কোন্‌ দেশের বিধবারা এমন পরের কাজে আপনাকে বিলিয়ে দিতে পেরেছে?

0 Shares