শেষ প্রশ্ন

কমলের মুখে স্মিতহাস্যে বিকশিত হইয়া উঠিল, বলিল, এর মধ্যে ভালটা কি আছে হরেনবাবু? অপরের গৃহের নিঃস্বার্থ গৃহিণী ও অপরের ছেলের নিঃস্বার্থ জননী হবার দৃষ্টান্ত হয়ত জগতের আর কোথাও নেই। নেই বলে অদ্ভুত হতে পারে, কিন্তু ভাল হয়ে উঠবে কিসের জোরে?

শুনিয়া হরেন্দ্র স্তব্ধ হইয়া রহিল, এবং নীলিমা আশ্চর্য দুই চক্ষু মেলিয়া নির্নিমেষে তাহার মুখের প্রতি তাকাইয়া রহিল। কমল তাহাকেই লক্ষ্য করিয়া বলিল, বাক্যের ছটায়, বিশেষণের চাতুর্যে লোকে একে যত গৌরবান্বিতই করে তুলুক, গৃহিণীপনার এই মিথ্যে অভিনয়ের সম্মান নেই। এ গৌরব ছাড়াই ভাল।

হরেন্দ্র গভীর বেদনার সহিত কহিল, একটা সুশৃঙ্খল সংসার নষ্ট করে দিয়ে চলে যাবার উপদেশ—এ ত আপনার কাছে কেউ আশা করে না।

কমল বলিল, কিন্তু সংসার ত ওঁর নিজের নয়—হলে এ উপদেশ দিতাম না। অথচ, এমনি করেই কর্মভোগের নেশায় পুরুষেরা আমাদের মাতাল করে রাখে। তাদের বাহবার কড়া মদ খেয়ে চোখে আমাদের ঘোর লাগে, ভাবি, এই বুঝি নারী-জীবনের সার্থকতা। আমাদের চা-বাগানের হরিশবাবুর কথা মনে পড়ে। ষোল বছরের ছোট বোনটির যখন স্বামী মারা গেল—তাকে বাড়িতে এনে নিজের একপাল ছেলে-মেয়ে দেখিয়ে কেঁদে বললেন, লক্ষ্মী দিদি আমার, এখন এরাই তোর ছেলে-মেয়ে। তোর ভাবনা কি বোন, এদের মানুষ করে, এদের মায়ের মত হয়ে, এ বাড়ির সর্বেসর্বা হয়ে আজ থেকে তুই সার্থক হ—এই আমার আশীর্বাদ। হরিশবাবু ভাল লোক, বাগানময় তাঁর ধন্য ধন্য পড়ে গেল, সবাই বললে, লক্ষ্মীর কপাল ভাল। ভাল ত বটেই। শুধু মেয়েমানুষেই জানে এতবড় দুর্ভোগ, এতবড় ফাঁকি আর নেই, কিন্তু একদিন এ বিড়ম্বনা যখন ধরা পড়ে, তখন প্রতিকারের সময় বয়ে যায়।

হরেন্দ্র কহিল, তার পরে?

কমল বলিল, পরের খবর জানিনে, হরেনবাবু, লক্ষ্মীর সার্থকতার শেষ দেখে আসতে পারিনি, আগেই চলে আসতে হয়েছিল; কিন্তু ঐ যে আমার গাড়ি এসে দাঁড়াল। চলুন, পথে যেতে যেতে বলব। নমস্কার। এই বলিয়া সে একমুহূর্তে উঠিয়া দাঁড়াইল।

নীলিমা নিঃশব্দে নমস্কার করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার দুই চক্ষের তারকা যেন অঙ্গারের মত জ্বলিতে লাগিল।

পরিচ্ছেদ – চৌদ্দ

‘আশ্রম’ শব্দটা কমলের সম্মুখে হরেন্দ্রর মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া গিয়াছিল। শুনিয়া অবিনাশ যে-ঠাট্টা করিয়াছিলেন সে অন্যায় হয় নাই। জনকয়েক দরিদ্র ছাত্র ওখানে থাকিয়া বিনা-খরচায় স্কুলে পড়াশুনা করিতে পায়—ইহাই লোকে জানে। বস্তুতঃ, নিজের এই বাসস্থানটাকে বাহিরের লোকের কাছে অতবড় একটা গৌরবের পদবীতে তুলিয়া ধরার সঙ্কল্প হরেন্দ্রর ছিল না। ও নিতান্তই একটা সাধারণ ব্যাপার এবং প্রথমে আরম্ভও হইয়াছিল সামান্যভাবে। কিন্তু এ-সকল জিনিসের স্বভাবই এই যে, দাতার দুর্বলতায় একবার জন্মগ্রহণ করিলে আর ইহাদের গতির বিরাম থাকে না। কঠিন আগাছার ন্যায় মৃত্তিকার সমস্ত রস নিঃশেষে আকর্ষণ করিয়া ডালে-মূলে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতে ইহাদের বিলম্ব হয় না। হইলও তাই। এ বিবরণটাই প্রকাশ করিয়া বলি।

হরেন্দ্রর ভাই-বোন ছিল না। পিতা ওকালতি করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পরে সংসারে অবশিষ্ট ছিলেন শুধু হরেনের বিধবা মা। তিনিও পরলোক গমন করিলেন। ছেলের তখন লেখাপড়া সাঙ্গ হইল। অতএব, আপনার বলিতে এমন কেহই আর রহিল না যে তাহাকে বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করে, কিংবা উদ্যোগ ও আয়োজন করিয়া পায়ে শৃঙ্খল পরায়। অতএব, পড়া যখন সমাপ্ত হইল তখন নিতান্ত কাজের অভাবেই হরেন্দ্র দেশ ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করিল। সাধুসঙ্গ বিস্তর করিল, ব্যাঙ্কের জমানো সুদ বাহির করিয়া দুর্ভিক্ষ-নিবারণী-সমিতি গঠন করিল, বন্যাপ্লাবনে আচার্যদেবের দলে ভিড়িল, মুক্তি-সঙ্ঘে মিলিয়া কানা-খোঁড়া-নুলো-হাবা-বোবা ধরিয়া আনিয়া সেবা করিল,—নাম জাহির হইতেই দলে দলে ভালো লোকেরা আসিয়া তাহাকে বলিতে লাগিল, টাকা দাও, পরোপকার করি। বাড়তি টাকা শেষ হইয়াছে, পুঁজিতে হাত না দিলে আর চলে না,—এমনি যখন অবস্থা, তখন হঠাৎ একদিন অবিনাশের সঙ্গে তাহার পরিচয়। সম্বন্ধ যত দূরের হউক, পৃথিবীতে একটা লোকও যে তখনো বাকী আছে যাহাকে আত্মীয় বলা চলে, এ খবর সেইদিন সে প্রথম পাইল।অবিনাশদের কলেজে তখন মাস্টারি একটা খালি ছিল; চেষ্টা করিয়া সেই কর্মে তাহাকে নিযুক্ত করাইয়া সঙ্গে করিয়া আগ্রায় আনিলেন। এ দেশে আসিবার ইহাই তাহার ইতিহাস। পশ্চিমের মুসলমানী আমলের প্রাচীন শহরগুলার সাবেককালের অনেক বড় বড় বাড়ি এখনও অল্প ভাড়ায় পাওয়া যায়, ইহারই একটা হরেন্দ্র যোগাড় করিয়া লইল। এই তাহার আশ্রম।

কিন্তু এখানে আসিয়া যে-কয়দিন সে অবিনাশের গৃহে অতিবাহিত করিল—তাহারই অবকাশে নীলিমার সহিত তাহার পরিচয়। এই মেয়েটি অচেনা লোক বলিয়া একটা দিনের জন্যও আড়ালে থাকিয়া দাসী-চাকরের হাত দিয়া আত্মীয়তা করিবার চেষ্টা করিল না—একেবারে প্রথম দিনটিতেই সম্মুখে বাহির হইল। কহিল, তোমার কখন কি চাই, ঠাকুরপো, আমাকে জানাতে লজ্জা করো না। আমি বাড়ির গিন্নী নই—অথচ গিন্নীপনার ভার পড়েছে আমার ওপর। তোমার দাদা বলছিলেন, ভায়ার অযত্ন হলে মাইনে কাটা যাবে। গরীব মানুষের লোকসান করে দিয়ো না ভাই। দরকারগুলো যেন জানতে পারি।

হরেন কি যে জবাব দিবে খুঁজিয়া পাইল না। লজ্জায় সে এমনি জড়সড় হইয়া উঠিল যে, এই মিষ্ট কথাগুলি যিনি অবলীলাক্রমে বলিয়া গেলেন তাঁহার মুখের দিকেও চাহিতে পারিল না। কিন্তু লজ্জা কাটিতেও তাহার দিন-দুয়ের বেশী লাগিল না। ঠিক যেন না কাটিয়া উপায় নাই,—এমনি। এই রমণীর যেমন স্বচ্ছন্দ অনাড়ম্বর প্রীতি, তেমনি সহজ সেবা। তিনি যে বিধবা, সংসারে তাঁহার যে সত্যকার আশ্রয় কোথাও নাই—তিনিও যে এ বাড়িতে পর—এই কথাটাও একদিকে যেমন তাঁহার মুখের চেহারায়, তাঁহার সাজসজ্জায়, তাঁহার রহস্য-মধুর আলাপ-আলোচনায় ধরিবার জো নেই, তেমনি এইগুলাই যে তাঁহার সবটুকু নহে এ কথাটাও না বুঝিয়া উপায়ান্তর নাই।

0 Shares