শেষ প্রশ্ন

শুধু একটা বিষয়ে হরেন্দ্র এবং সতীশ উভয়েই পীড়া বোধ করিতেছিল। কিছুদিন হইতে উভয়েই অনুভব করিতেছিল যে, রাজেনের আচরণ পূর্বের মত আর নাই। আশ্রমের কোন কাজেই সে আর গা দেয় না, সকালের সাধন-ভজনের নিত্যকর্মে এখন সে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে, জিজ্ঞাসা করিলে বলে, শরীর ভাল নাই। অথচ, শরীর ভাল না থাকার বিশেষ কোন লক্ষণও দেখা যায় না। কি তাহার নালিশ, কেন সে এমন হইতেছে প্রশ্ন করিয়াও জবাব পাওয়া যায় না। কোনদিন হয়ত প্রভাতেই কোথায় চলিয়া যায়, সারাদিন আসে না, রাত্রে যখন বাড়ি ফিরে তখন এমনি তাহার চেহারা যে, কারণ জিজ্ঞাসা করিতে হরেন্দ্ররও সাহস হয় না। অথচ এ-সকল একান্তই আশ্রমের নিয়মবিরুদ্ধ। একা হরেন্দ্র ব্যতীত সন্ধ্যার পরে কাহারো বাহিরে থাকিবার জো নাই—এ কথা রাজেন ভাল করিয়াই জানে, অথচ গ্রাহ্য করে না। আশ্রমের সেক্রেটারি সতীশ, শৃঙ্খলারক্ষার ভার তাহারই উপরে। এই-সকল অনাচারের বিরুদ্ধে সে হরেন্দ্রর কাছে ঠিক যে অভিযোগ করিত তাহা নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে আভাসে-ইঙ্গিতে এমন ভাব প্রকাশ করিত যে, ইহাকে আশ্রমে রাখা ঠিক সঙ্গত হইতেছে না—ছেলেরা বিগড়াইতে পারে। হরেন নিজেও যে না বুঝিত তাহা নহে, কিন্তু মুখ ফুটিয়া বলিবার সাহস তাহার ছিল না। একদিন সমস্ত রাত্রিই তাহার দেখা নাই,—সকালে যখন সে বাড়ি ফিরিল তখন এই লইয়াই একটা রীতিমত আলোচনা চলিতে ছিল। হরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিল, ব্যাপার কি রাজেন, কাল ছিলে কোথায়?

সে একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, একটা গাছতলায় পড়ে ছিলাম।

গাছতলায়? গাছতলায় কেন?

অনেক রাত হয়ে গেল—আর ডাকাডাকি করে আপনাদের ঘুম ভাঙ্গালাম না।

বেশ। অত রাত্রিই বা হল কেন?

এমনি ঘুরতে ঘুরতে। এই বলিয়া সে নিজের ঘরে চলিয়া গেল।

সতীশ নিকটে ছিল, হরেন জিজ্ঞাসা করিল, কি কাণ্ড বল ত?

সতীশ বলিল, আপনাকেই কথা কাটিয়ে চলে গেল—গ্রাহ্য করলে না, আর আমি জানব কি করে?

তাই ত হে, এতটা ত ভাল নয়।

সতীশ মুখ ভারী করিয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আপনি ত একটা কথা জানেন, পুলিশে ওকে বছর-দুই জেলে রেখেছিল?

হরেন বলিল, জানি, কিন্তু সে ত মিথ্যে সন্দেহের উপর। ওর ত কোন সত্যিকার দোষ ছিল না।

সতীশ কহিল, আমি শুধু ওর বন্ধু বলেই জেলে যেতে যেতে রয়ে গিয়েছিলাম। পুলিশের সুদৃষ্টি ওকে আজও ছাড়েনি।

হরেন কহিল, অসম্ভব নয়।

প্রত্যুত্তরে সতীশ একটুখানি বিষাদের হাসি হাসিয়া কহিল, আমি ভাবি, ওর থেকে আমাদের আশ্রমের উপরে না তাদের মায়া জন্মায়।

শুনিয়া হরেন চিন্তিতমুখে চুপ করিয়া রহিল। সতীশ নিজেও খানিকক্ষণ নীরবে থাকিয়া সহসা জিজ্ঞাসা করিল, আপনি বোধ হয় জানেন যে রাজেন ভগবান পর্যন্ত বিশ্বাস করে না?

হরেন আশ্চর্য হইয়া বলিল, কৈ না!

সতীশ কহিল, আমি জানি সে করে না। আশ্রমের কাজকর্ম, বিধিনিষেধের প্রতিও তার তিলার্ধ শ্রদ্ধা নেই। আপনি বরঞ্চ কোথাও তার একটা চাকরি-বাকরি করে দিন।

হরেন্দ্র কহিল, চাকরি ত গাছের ফল নয়, সতীশ, যে ইচ্ছে করলেই পেড়ে হাতে দেব। তার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করতে হয়।

সতীশ বলিল, তা হলে তাই করুন। আপনি যখন আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট, এবং আমি এর সেক্রেটারি, তখন সকল বিষয় আপনার গোচর করাই আমার কর্তব্য। আপনি ওকে অত্যন্ত স্নেহ করেন এবং আমারও সে বন্ধু। তাই তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে এতদিন আমার প্রবৃত্তি হয়নি, কিন্তু এখন আপনাকে সতর্ক করে দেওয়াও আমি কর্তব্য মনে করি।

হরেন মনে মনে ভীত হইয়া কহিল, কিন্তু আমি জানি তার নির্মল চরিত্র—

সতীশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ। এদিক দিয়ে অতিবড় শত্রুও তার দোষ দিতে পারে না। রাজেন আজীবন কুমার, কিন্তু সে ব্রহ্মচারীও নয়। আসল কারণ, স্ত্রীলোক বলে সংসারে যে কিছু আছে এ কথা ভাববারও তার সময় নেই। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, তার চরিত্রের অভিযোগ আমি করিনি, সে অস্বাভাবিক রকমের নির্মল, কিন্তু—

হরেন প্রশ্ন করিল, তবুও তোমার কিন্তুটা কি?

সতীশ বলিল, কলকাতার বাসায় আমরা দুজনে এক ঘরে থাকতাম। ও তখন ক্যাম্‌বেল মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এবং বাসায় বি. এস্‌-সি. পড়ত। সবাই জানত ও-ই ফার্স্ট হবে, কিন্তু একজামিনের আগে হঠাৎ কোথায় চলে গেল—

হরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ও কি ডাক্তারি পড়ত নাকি? কিন্তু আমাকে যে বলেছিল ও শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু পড়াশুনো ভয়ানক শক্ত বলে ওকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল—

সতীশ কহিল, কিন্তু খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন কলেজে থার্ড-ইয়ারে সে-ই হয়েছিল প্রথম। অথচ বিনা কারণে চলে আসায় কলেজের সমস্ত মাস্টাররাই অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিল। ওর পিসীমা বড়লোক, তিনিই পড়ার খরচ দিচ্ছিলেন। এই ব্যাপারে বিরক্ত হয়ে টাকা বন্ধ করলেন, তার পরেই বোধ হয় আপনার সঙ্গে ওর পরিচয়। বছর-দুই ঘুরে ঘুরে যখন ফিরে এলো তখন পিসীমা তারই মত নিয়ে তাকে ডাক্তারি স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। ক্লাশে প্রত্যেক বিষয়েই ও ফার্স্ট হচ্ছিল, অথচ বছর-তিনেক পরে হঠাৎ একদিন ছেড়ে দিলে! ওই এক ছুতো—ভারী শক্ত, ও আমি পেরে উঠবো না। ছেড়ে দিয়ে আমার বাসায় আমার ঘরে এসে আড্ডা নিলে। বললে, ছেলে পড়িয়ে বি. এস্‌-সি. পাস করে কোথাও কোন গ্রামে গিয়ে মাস্টারি করে কাটাব। আমি বললাম, বেশ তাই কর। তার পরে দিন-পনর নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই, চোখের ঘুম কোথায় গেল তার ঠিকানা নেই,—এমনি পড়াই পড়লে যে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। সবাই বললে, এ না হলে কি আর কেউ প্রত্যেক বিষয়ে প্রথম হতে পারে!

হরেন এ-সব কিছুই জানিত না,—রুদ্ধনিঃশ্বাসে কহিল, তার পরে?

সতীশ কহিল, তার পরে যা আরম্ভ করলে সেও এমনি অদ্ভুত। বই আর ছুঁলে না। কোথায় রইল তার খাতা-পেন্সিল, কোথায় রইল তার নোট্‌ বুক—কোথায় যায়, কোথায় থাকে, পাত্তাই পাওয়া যায় না। যখন ফিতে আসে তার চেহারা দেখলে ভয় হয়। যেন এতদিন ওর স্নানাহার পর্যন্ত ছিল না!

0 Shares