শেষ প্রশ্ন

নীলিমা বলিল, তা হলে আমার সম্বন্ধেও দয়া করে ওঁকে স্মরণ করিয়ে দাও ঠাকুরপো, যে কাউকে ছোটগিন্নী বলে ডাকতে থাকলেই সে সত্যিকার গৃহিণী হয়ে যায় না। তাকে শাসন করার মাত্রা-বোধ থাকা চাই। আমার দিক থেকে মুখুয্যেমশায়ের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারঘরে এইটুকু আজ বরঞ্চ জমা হয়ে থাক—ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।

হরেন্দ্র হাত জোড় করিয়া বলিল, রক্ষে করুন বৌদি, যত অভিজ্ঞতার লড়াই কি আজ আমার বাসায় এসে? যেটুকু বাকী রইল এখন থাক, বাড়ি ফিরে গিয়ে সমাধা করে নেবেন, নইলে আমরা যে মারা যাই। যে ভয়ে অক্ষয়কে ডাকলাম না, তাই কি শেষে ভাগ্যে ঘটলো?

শুনিয়া অজিত ও কমল উভয়েই হাসিয়া ফেলিল। হরেন জিজ্ঞাসা করিল, অজিতবাবু, শুনিলাম কাল নাকি আপনি বাড়ি যাবেন?

কিন্তু আপনি শুনলেন কার কাছে?

আশুবাবুকে আনতে গিয়েছিলাম, তিনিই বললেন, কাল বোধ হয় আপনি বাড়ি চলে যাচ্চেন!

অজিত কহিল, বোধ হয়। কিন্তু সে কাল নয়, পরশু। এবং বাড়ি কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। হয়ত, বিকেল নাগাদ স্টেশনে গিয়ে উপস্থিত হব,—উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যে-কোন দিকের গাড়ি পাবো তাতেই এ যাত্রা শুরু করে দেব।

হরেন সহাস্যে কহিল, অনেকটা বিবাগী হওয়ার মত। অর্থাৎ গন্তব্য স্থানের নির্দেশ নেই।

অজিত বলিল, না।

কিন্তু ফিরে আসবার?

না, তারও আপাততঃ কোন নির্দেশ নেই।

হরেন কহিল, অজিতবাবু, আপনি ভাগ্যবান লোক। কিন্তু তল্পি বইবার লোকের দরকার হয় ত আমি একজনকে দিতে পারি, বিদেশে এমন বন্ধু আর পাবেন না।

কমল কহিল, আর রাঁধবার লোকের দরকার হয় ত আমিও একজনকে দিতে পারি, রাঁধতে যার জোড়া নেই। আপনিও স্বীকার করবেন, হাঁ, অহঙ্কার করতে পারে বটে।

অবিনাশের কিছুই আর ভাল লাগিতেছিল না; বলিলেন, হরেন, আর দেরি কিসের, এবার ফেরবার উদ্যোগ করা যাক না, কি বল?

হরেন সবিনয়ে কহিল, ছেলেদের সঙ্গে একটু পরিচয় করবেন না? দুটো উপদেশ তাদের দিয়ে যাবেন না সেজদা?

অবিনাশ কহিলেন, উপদেশ দিতে ত আমি আসিনি, এসেছিলাম শুধু ওঁদের সঙ্গী হিসেবে। তার বোধ হয় আর দরকার নেই।

সতীশ অনেকগুলি ছেলে সঙ্গে লইয়া উপস্থিত হইল। দশ-বারো বছরের বালক হইতে উনিশ-কুড়ি বছরের যুবক পর্যন্ত তাহাতে আছে। শীতের দিন। গায়ে শুধু একটি জামা, কিন্তু কাহারও পায়ে জুতা নাই,—জীবনধারণের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় নয় বলিয়াই। আহারের ব্যবস্থা পূর্বেই দেখানো হইয়াছে। ব্রহ্মচর্যাশ্রমে এ-সকল শিক্ষার অঙ্গ। হরেন্দ্র আজ একটা সুন্দর বক্তৃতা রচনা করিয়া রাখিয়াছিল, মনে মনে তাহাই আবৃত্তি করিয়া লইয়া যথোচিত গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, এই ছেলেরা স্বদেশের কাজে জীবন উৎসর্গ করেছে। আশ্রমের এই মহৎ আদর্শ যাতে নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে পারে, আজ এদের সেই আশীর্বাদ আপনারা করুন।

সকলে মুক্তকণ্ঠে আশীর্বাদ করিলেন।

হরেন কহিল, যদি সময় থাকে আমাদের বক্তব্য আমি পরে নিবেদন করব। এই বলিয়া সে কমলকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, আপনাকেই আজ আমরা বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করে এনেছি কিছু শুনবো বলে। ছেলেরা আশা করে আছে আপনার মুখ থেকে আজ তারা এমন কিছু পাবে যাতে জীবনের ব্রত তাদের অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

কমল সঙ্কোচ ও দ্বিধায় আরক্ত হইয়া উঠিল। কহিল, আমি ত বক্তৃতা দিতে পারিনে, হরেনবাবু।

উত্তর দিল সতীশ, কহিল, বক্তৃতা নয়, উপদেশ। দেশের কাজে যা তাদের সবচেয়ে বেশী কাজে লাগবে, শুধু তাই।

কমল তাহাকেই প্রশ্ন করিল, দেশের কাজ বলতে আপনারা কি বোঝেন, আগে বলুন।

সতীশ কহিল, যাতে দেশের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হয় সেই তো দেশের কাজ।

কমল বলিল, কিন্তু কল্যাণের ধারণা ত সকলের এক নয়। আপনার সঙ্গে আমার ধারণা যদি না মেলে আমার উপদেশ ত আপনাদের কাজে লাগবে না।

সতীশ মুশকিলে পড়িল। এ কথার ঠিক উত্তর সে খুঁজিয়া পাইল না। তাহাকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে হরেন কহিল, দেশের মুক্তি যাতে আসে সেই হল দেশের একমাত্র কল্যাণ। দেশে এমন কে আছে যে এ সত্য স্বীকার করবে না?

কমল বলিল, না বলতে ভয় হয় হরেনবাবু, সবাই ক্ষেপে যাবে। নইলে আমিই বলতাম, এই মুক্তি শব্দটার মত ভোলবার এবং ভোলাবার এতবড় ছল আর নেই। কার থেকে মুক্তি, হরেনবাবু? ত্রিবিধ দুঃখ থেকে, না ভাববন্ধন থেকে? কোন্‌টাকে দেশের একমাত্র কল্যাণ স্থির করে আশ্রম-প্রতিষ্ঠায় নিযুক্ত হয়েছেন বলুন ত? এই কি আপনার স্বদেশ-সেবার আদর্শ?

হরেন ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, না না না, এ-সব নয়, এ-সব নয়। এ আমাদের কাম্য নয়।

কমল কহিল, তাই বলুন এ আমাদের কাম্য নয়, বলুন আমাদের আদর্শ স্বতন্ত্র। বলুন, সংসারত্যাগ ও বৈরাগ্য-সাধনা আমাদের নয়, আমাদের সাধনা পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য, সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু তার শিক্ষা কি ছেলেদের এই? গায়ে একটা মোটা জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, পরনে জীর্ণবস্ত্র, মাথায় রুক্ষকেশ, একবেলা অর্ধাশনে যারা কেবল অস্বীকারের মধ্যে দিয়েই বড় হয়ে উঠচে, পাওয়ার আনন্দ যার নিজের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, দেশের লক্ষ্মী কি পাঠিয়ে দেবেন শেষে তাদের হাত দিয়েই তাঁর ভাঁড়ারের চাবি? হরেনবাবু, পৃথিবীর দিকে একবার চেয়ে দেখুন। যারা অনেক পেয়েছে, তারা সহজেই দিয়েছে, এমন অকিঞ্চনতার ইস্কুল খুলে তাদের ত্যাগের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে হয়নি।

সতীশ হতবুদ্ধি হইয়া প্রশ্ন করিল, দেশের মুক্তি-সংগ্রামে কি ধর্মের সাধনা, ত্যাগের দীক্ষা প্রয়োজনীয় নয় আপনি বলেন?

কমল কহিল, মুক্তি-সংগ্রামের অর্থটা আগে পরিষ্কার হোক।

সতীশ ইতস্ততঃ করিতে লাগিল; কমল হাসিয়া বলিল, ভাবে বোধ হয় আপনি বিদেশী রাজশক্তির বন্ধন-মোচনকেই দেশের মুক্তি-সংগ্রাম বলচেন। তা যদি হয় সতীশবাবু, আমি নিজে ত ধর্মের সাধনাও করিনি, ত্যাগের দীক্ষাও নিইনি। তবুও আমাকে ঠিক সামনের দলেই পাবেন এ আপনাকে আমি কথা দিলাম। কিন্তু আপনাদের খুঁজে পাব ত?

0 Shares