শেষ প্রশ্ন

নিশ্চয় পড়ে।

আচ্ছা, তার সঙ্গে আজ কোথায় তফাত বলতে পারেন? বলুন ত দেখি?

অজিত ঘরের মধ্যে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া কোন্‌খানে কি ছিল এবং নাই, মনে করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।

কমল হাসিমুখে কহিল, ওদিকে সারারাত খুঁজলেও পাবেন না। আর একদিকে সন্ধান করতে হবে।

কোন্‌ দিকে বলুন তো?

আমার দিকে।

অজিত হঠাৎ কি একপ্রকার লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া গেল। আস্তে আস্তে বলিল, কোনদিনই আপনার মুখের পানে আমি খুব বেশী করে চেয়ে দেখিনি। অন্য সবাই পেরেছে, শুধু আমিই কি জানি কেন পেরে উঠিনি।

কমল কহিল, অপরের সঙ্গে আপনার প্রভেদ ওইখানে। তারা যে পারতো তার কারণ, তাদের দৃষ্টির মধ্যে আমার প্রতি সম্ভ্রম-বোধ ছিল না।

অজিত চুপ করিয়া রহিল। কমল বলিতে লাগিল, আমি স্থির করেছিলাম, যেমন করে হোক আপনাকে খুঁজে বার করবোই। আশুবাবুর বাড়িতে আজই যে দেখা হবে এ আশা ছিল না, কিন্তু দৈবাৎ দেখা হয়ে যখন গেল, তখনই জানি ধরে আনবোই। খাওয়ানো একটা ছোট্ট উপলক্ষ,—তাই ওটা শেষ হলেই ছুটি পাবেন না। আজ রাত্রে আপনাকে আমি কোথাও যেতে দেবো না,—এই বাড়িতেই বন্ধ করে রাখবো।

কিন্তু তাতে আপনার লাভ কি?

কমল কহিল, লাভের কথা পরে বলবো, কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ বললে আমি সত্যিই ব্যথা পাই। একদিন ‘তুমি’ বলে ডাকতেন, সেদিনও বলতে আমি সাধিনি, নিজে ইচ্ছে করেই ডেকেছিলেন। আজ সেটা বদলে দেবার মত কোন অপরাধও করিনি। অভিমান করে সাড়া যদি না দিই, আপনি নিজেও কষ্ট পাবেন।

অজিত ঘাড় নাড়িয়া বলিল, তা বোধ হয় পাবো।

কমল কহিল, বোধ হয় নয়, নিশ্চয় পাবেন। আপনি আগ্রায় এসেছিলেন মনোরমার জন্যে। কিন্তু সে যখন অমন করে চলে গেল, তখন সবাই ভাবলে আর একদণ্ডও আপনি এখানে থাকবেন না। কেবল আমি জানতাম আপনি যেতে পারবেন না। আচ্ছা, আমিও যে ভালবাসি এ কথা আপনি বিশ্বাস করেন?

না, করিনে।

নিশ্চয় করেন। তাইতে আপনার বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ আছে।

অজিত কৌতূহলী হইয়া বলিল, অনেক নালিশ? একটা শুনি।

কমল বলিল, শোনাবো বলেই ত যেতে দিইনি। প্রথমে নিজের কথাটা বলি। উপায় নেই বলে দুঃখী-গরীবদের কাপড় সেলাই করে নিজের খাওয়া-পরা চালাই—এ আমার সয়। কিন্তু দায়ে পড়েচি বলে আপনারও জামা সেলাই করার দাম নেবো—এও কি সয়?

কিন্তু তুমি ত কারও দান নাও না!

না, দান আমি কারও নিইনে, এমন কি আপনারও না। কিন্তু দান করা ছাড়া দেবার কি সংসারে আর কোন পথ খোলা নেই? কেন এসে জোর করে বললেন না, কমল, এ কাজ তোমাকে আমি করতে দেবো না। আমি তার কি জবাব দিতাম? আজ যদি কোন দুর্বিপাকে আমার খেটে খাবার শক্তি যায়, আপনি বেঁচে থাকতে কি আমি পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াবো?

কথাটা ব্যথায় তাহাকে ব্যাকুল করিয়া দিল, বলিল, এমন হতেই পারে না কমল, আমি বেঁচে থাকতে এ অসম্ভব। তোমার সম্বন্ধে আমি একটা দিনও এমন করে ভেবে দেখিনি। এখনো যেন বিশ্বাস হতে চায় না যে, যে কমলকে আমরা সবাই জানি সে-ই তুমি।

কমল কহিল, সবাই যা ইচ্ছে জানুক, কিন্তু আপনি কি কেবল তাদেরই একজন? তার বেশি নয়?

এই প্রশ্নের উত্তর আসিল না, বোধ করি অত্যন্ত কঠিন বলিয়াই; এবং ইহার পরে উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। হয়ত অপরকে প্রশ্ন করার চেয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন দুজনেই বেশি করিয়া অনুভব করিল।

কি-ই বা রান্না, শেষ হইতে বিলম্ব হইল না। আহারে বসিয়া অজিত গম্ভীর হইয়া বলিল, অথচ মজা এই যে, যার যত টাকাকড়িই থাকুক তোমার উপার্জনের অন্ন হাত পেতে না খেয়ে কারও পরিত্রাণ নেই। অথচ, নিজে তুমি কারও নেবে না, কারও খাবে না। মাথা খুঁড়ে মরে গেলেও না।

কমল হাসিয়া কহিল, আপনারা খান কেন? তা ছাড়া কবেই বা আপনি মাথা খুঁড়লেন?

অজিত বলিল, মাথা খোঁড়বার ইচ্ছে বহুবারই হয়েছে। আর, তোমার খাই শুধু তোমার জবরদস্তির সঙ্গে পেরে উঠিনে বলে। আজ আমি যদি বলি, কমল, এখন থেকে তোমার সমস্ত ভার নিলাম, এ উঞ্ছবৃত্তি আর ক’রো না, তুমি তখনি হয়ত এমনি কটু কথা বলে উঠবে যে আমার মুখ দিয়ে আর দ্বিতীয় বাক্য বার হবে না।

কমল জিজ্ঞাসা করিল, এ কথা কি বলেছিলেন কোনদিন?

মনে হয় যেন বলেছিলাম।

আর আমি শুনিনি সে কথা?

না।

তা হলে শোনবার মত করে বলেন নি। হয়ত, মনের মধ্যে শুধু ইচ্ছে হয়েই ছিল—মুখ দিয়ে তা প্রকাশ পায়নি।

আচ্ছা, ধর আজই যদি বলি?

তা হলে আমিও যদি বলি,—না।

অজিত হাতের গ্রাস নামাইয়া রাখিয়া কহিল, এই ত! তোমাকে একটা দিনও আমরা বুঝতে পারলাম না। যেদিন তাজের সুমুখে প্রথম দেখি সেদিনও যেমন তোমার কথা বুঝিনি, আজও তেমনি আমাদের সকলের কাছে তুমি রহস্যই রয়ে গেলে। এইমাত্র নিজেই বললে আমার ভার নিন—আবার তখনি বললে, না।

কমল হাসিয়া কহিল, এমনি ধারা একটা ‘না’ আপনি বলুন ত দেখি? বলুন ত যা খেয়েছেন আর কোনদিন খাবেন না,—কেমন আপনার কথা থাকে।

অজিত কহিল, থাকবে কি করে? না খাইয়ে তুমি ত ছেড়ে দেবে না।

কিন্তু এবার কমল আর হাসিল না। শান্তভাবে বলিল, আমার ভার নেবার সময় আজও আপনার আসেনি। যেদিন আসবে, সেদিন আমার মুখ দিয়ে ‘না’ বেরুবে না। রাত হয়ে যাচ্ছে, আপনি খেয়ে নিন।

নিই। সেদিন কখনো আসবে কিনা বলে দিতে পার?

কমল মাথা নাড়িয়া কহিল, সে আমি পারিনে। জবাব আপনাকে নিজেই একদিন খুঁজে নিতে হবে।

সে শক্তি আমার নেই। একদিন অনেক খুঁজেচি কিন্তু পাইনি। জবাব তোমার কাছে পাব, এই আশা করে আজ থেকে আমি হাত পেতে থাকব।

এই বলিয়া অজিত নিঃশব্দে খাইতে লাগিল। খানিক পরে কমল জিজ্ঞাসা করিল, এত জায়গা থাকতে আপনি হঠাৎ হরেন্দ্রর আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলেন কেন?

অজিত কহিল, কোথাও ত থাকা চাই। তুমি নিজেই ত জানো আগ্রা ছেড়ে আমার যাবার জো ছিল না।

জানি তা হলে?

হাঁ, জানো বৈ কি।

আর তাই যদি সত্যি, সোজা আমার কাছে চলে এলেন না কেন?

0 Shares