শেষ প্রশ্ন

যদি আসতাম, সত্যিই কি স্থান দিতে?

সত্যি ত আর আসেন নি? সে যাক, কিন্তু হরেন্দ্রর আশ্রমে ত কষ্টের সীমা নেই,—সেই ওদের সাধনা—কিন্তু অত কষ্ট আপনার সইল কি করে?

জানিনে কি করে সইল, কিন্তু আজ আমার ও-কথা মনেও হয় না। এখন ওদেরই আমি একজন। হয়ত, এই আমার সমস্ত ভবিষ্যতের জীবন। এতদিন চুপ করেও ছিলাম না। লোক পাঠিয়ে স্থানে স্থানে আশ্রম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেচি—তিন-চারটি আশ্রমের আশাও পেয়েচি—ইচ্ছে আছে নিজে একবার বার হব।

এ পরামর্শ আপনাকে দিলে কে? হরেন্দ্র বোধ হয়?

অজিত কহিল, যদি দিয়েও থাকেন নিষ্পাপ হয়েই দিয়েছেন। দেশের সর্বনাশ যারা চোখে দেখেচে—এর দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর দুঃখ, এর ধর্মহীনতার গভীর গ্লানি, এর দৌর্বল্যের একান্ত ভীরুতা—

কমল বাধা দিয়া বলিল, হরেন্দ্র এ-সব দেখেছেন অস্বীকার করিনে, কিন্তু আপনার ত শুধু শোনা কথা। নিজের চোখে কোন কিছু দেখবার ত আজও সুযোগ পাননি?

কিন্তু এ সবই ত সত্যি?

সত্যি নয় তা বলিনে, কিন্তু তার প্রতিকারের উপায় কি এই আশ্রম-প্রতিষ্ঠা?

নয় কেন? ভারতবর্ষ বলতে ত শুধু উত্তরে হিমালয় এবং অপর তিনদিকে সমুদ্র-ঘেরা কতকটা ভূখণ্ড মাত্র নয়? এর প্রাচীন সভ্যতা, এর ধর্মের বিশিষ্টতা, এর নীতির পবিত্রতা, এর ন্যায়-নিষ্ঠার মহিমা,—এই ত ভারত, তাই ত এর নাম দেবভূমি,—একে নিরতিশয় হীনতা থেকে বাঁচাবার তপস্যা ছাড়া আর কি কোন পথ আছে? ব্রহ্মচর্যব্রতধারী নিষ্কলুষ ছেলেদের—জীবনে সার্থক হবার—ধন্য হবার—

কমল বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, আপনার খাওয়া হয়েছে, হাত-মুখ ধুয়ে ও-ঘরে চলুন,—আর না।

তুমি খাবে না?

আমি কি দু’বেলা খাই যে আজ খাব? উঠুন।

কিন্তু আশ্রমে আমাকে ত ফিরে যেতে হবে।

না হবে না, ও-ঘরে চলুন। অনেক কথা আমার শোনবার আছে।

আচ্ছা চলো। কিন্তু বাইরে থাকবার আমাদের বিধি নেই, যত রাত্রিই হোক আশ্রমে আমাকে ফিরতেই হবে।

কমল বলিল, সে বিধি দীক্ষিত আশ্রমবাসীদের, আপনার জন্যে নয়।

কিন্তু লোকে বলবে কি?

লোকের উল্লেখে কোনদিনই কমলের ধৈর্য থাকে না, কহিল, লোকেরা আপনাকে শুধু নিন্দেই করবে, রক্ষে করতে পারবে না। যে পারবে তার কাছে আপনার ভয় নেই,—তাদের চেয়ে আমি ঢের বেশি আপনার। সেদিন সঙ্গে যেতে আমাকে ডেকেছিলেন—কিন্তু পারিনি, আজ আর না পারলে আমার চলবে না। চলুন ও-ঘরে, আমাকে ভয় নেই। পুরুষের ভোগের বস্তু যারা আমি তাদের জাত নই। উঠুন।

এ ঘরে আনিয়া কমল সম্পূর্ণ নূতন শয্যা-বস্তু দিয়া খাটের উপর পরিপাটি করিয়া বিছানা করিয়া দিল এবং নিজের জন্য মেঝের উপর যেমন-তেমন গোছের আর একটা পাতিয়া রাখিয়া কহিল, আসচি। মিনিট-দশেকের বেশী দেরি হবে না, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়বেন না যেন।

না।

তা হলে ঠেলে তুলে দেব।

তার দরকার হবে না কমল, ঘুম আমার চোখ থেকে উবে গেছে।

আচ্ছা, সে পরীক্ষা পরে হবে,—এই বলিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। রান্নার পাত্রগুলি যথাস্থানে তুলিয়া রাখা, উচ্ছিষ্ট বাসন বারান্দায় বাহির করিয়া দেওয়া, দাসী বহুক্ষণ চলিয়া গেছে,—নীচে সিঁড়ির কবাট বন্ধ করা—গৃহস্থালীর এমনি সব ছোটখাটো কাজ তখনো বাকী, সে-সব সারিয়া তবে তাহার ছুটি।

কমলের সযত্ন-রচিত শুভ্র সুন্দর শয্যাটির ‘পরে বসিয়া একাকী ঘরের মধ্যে হঠাৎ তাহার দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল। বিশেষ কোন গভীর হেতু যে ছিল তাহা নয়, শুধু মনের মধ্যে একটা ভালো-লাগার তৃপ্তি। হয়ত একটু কৌতূহল মিশানো, কিন্তু আগ্রহের উত্তাপ নাই—শুধু একটি শান্ত আনন্দের মধুর স্পর্শ যেন নিঃশব্দে সর্বাঙ্গ পরিব্যাপ্ত করিয়াছে।

অজিত ধনীর সন্তান, আজন্ম বিলাসের মধ্যেই প্রতিপালিত; কিন্তু হরেন্দ্রর ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ভর্তি হওয়া অবধি দৈন্য ও আত্ম-নিগ্রহের সুদুর্গম পথে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের মর্মোপলব্ধির একাগ্র সাধনা এদিক হইতে দৃষ্টি তাহার অপসারিত করিয়াছিল। হঠাৎ চোখে পড়িল হলুদ রঙের সূতা দিয়া তৈরি বালিশের অড়ের চারিধারে ছোট্ট গুটি-কয়েক চন্দ্রমল্লিকা ফুল। বিছানার চাদরের যে কোণটি ঝুলিয়া আছে তাহাতে সাদা রেশম দিয়া বোনা কোন একটি অজানা লতার একটুখানি ছবি। এইটুকু শিল্পকর্ম,—সামান্যই ব্যাপার। কত লোকের ঘরেই ত আছে। অবসরকালে কমল নিজের হাতে সেলাই করিয়াছে। দেখিয়া অজিত মুগ্ধ হইয়া গেল। হাতে করিয়া সেইটি নাড়াচাড়া করিতেছিল, কমল বাহিরের কাজ সারিয়া ঘরে আসিয়া দাঁড়াইতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, বাঃ—বেশ ত!

কমল একটু আশ্চর্য হইল—কি বেশ? ঐ লতাটুকু?

হাঁ আর এই হলদে রঙের ফুলগুলি। তুমি নিজে করেচ, না?

কমল হাসিমুখে বলিল, চমৎকার প্রশ্ন। নিজে নয় ত কি কারিগর ডেকে তৈরি করিয়েছি? আপনার চাই ঐ-রকম?

না না না—আমার চাইনে। আমি কি করব?

তাহার এই ব্যাকুল ও সলজ্জ প্রত্যাখ্যানে কমল হাসিয়া কহিল, আশ্রমে নিয়ে গিয়ে শোবেন। কেউ জিজ্ঞেসা করলে বলবেন, কমল রাত জেগে তৈরি করে দিয়েচে।

দ্যুৎ!

দ্যুৎ কেন? নিজের জন্য এ-সব জিনিস কেউ তৈরি করে না, করে আর-একজনের জন্য। কষ্ট করে ঐ ফুলগুলি যে সেলাই করেছিলাম সে কি আপনি শোবো বলে? একদিন একজন আসবেই,—শুধু তারই জন্যে এ-সব তোলা ছিল। সকালে যখন চলে যাবেন, সমস্ত আপনার সঙ্গে দেব।

এবার অজিত নিজেও হাসিল, কহিল, আচ্ছা কমল, আমি কি এতই বোকা?

কেন?

তুমি আমাকেই মনে করে এ-সব তৈরি করেছিলে এও বিশ্বাস করব?

কেন করবেন না?

করব না সত্যি নয় বলে।

কিন্তু সত্যি বললে বিশ্বাস করবেন বলুন?

নিশ্চয় করব। তোমার পরিহাসের কোন সীমা নেই—কোথাও বাধে না। সেই মোটরে বেড়াবার কথা মনে হলে আমার লজ্জার অবধি থাকে না। সে আলাদা। কিন্তু যা পরিহাস নয়, সে যে তুমি কোন কিছুর জন্যেই মিথ্যে বলতে পারো না, এ আমি জানি।

0 Shares