শেষ প্রশ্ন

আশুবাবু সহসা বলিয়া উঠিলেন, যায়নি কিছুই অজিত, হয়ত শুধু গেছে তার যৌবন—তার মা হবার শক্তিটুকু হারিয়ে।

অজিত তাঁহার প্রতি চাহিয়া বলিল, ঠিক তাই। গল্পটা আপনি পড়েছিলেন?

না।

নইলে ঠিক এই কথাটিই জানলেন কি করে?

আশুবাবু প্রত্যুত্তরে শুধু একটুখানি হাসিলেন, কহিলেন, তুমি তার পরে বল।

অজিত বলিতে লাগিল, তিনি বাড়ি ফিরে শোবার ঘরের মস্ত বড় আরশির সুমুখে আলো জ্বেলে দাঁড়ালেন। বাইরে যাবার পোশাক ছেড়ে রাত্রিবাসের কাপড় পরতে পরতে নিজের ছায়ার পানে চেয়ে আজ এই প্রথম তাঁর চোখের দৃষ্টি যেন একেবারে বদলে গেল। এমন করে ধাক্কা না খেলে হয়তো এখনো চোখে পড়তো না যে, নারীর যা সবচেয়ে বড় সম্পদ,—আপনি যাকে বলছিলেন তার মা হবার শক্তি,—সে শক্তি আজ নিস্তেজ, ম্লান; সে আজ সুনিশ্চিত মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে; এ জীবনে আর তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তার নিশ্চেতন দেহের উপর দিয়ে অবিচ্ছিন্ন জলধারার ন্যায় সে সম্পদ প্রতিদিন ব্যর্থতায় ক্ষয় হয়ে গেছে। কিন্তু এতবড় ঐশ্বর্য যে এমন স্বল্পায়ু, এ বার্তা পৌঁছল তাঁর কাছে আজ শেষ বেলায়।

আশুবাবু নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, এমনিই হয় অজিত, এমনিই হয়। জীবনের অনেক বড় বস্তুকেই চেনা যায় শুধু তাকে হারিয়ে। তার পরে?

অজিত বলিল, তার পরে সেই আরশির সুমুখে দাঁড়িয়ে যৌবনান্ত দেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ আছে। একদিন কি ছিল এবং আজ কি হতে বসেছে। কিন্তু সে বিবরণ আমি বলতেও পারবো না, পড়তেও পারবো না।

নীলিমা পূর্বের মতই ব্যস্ত হইয়া বাধা দিল, না না না, অজিতবাবু, ও থাক। ঐ জায়গাটা বাদ দিয়ে আপনি বলুন।

অজিত কহিল, মহিলাটি বিশ্লেষণের শেষের দিকে বলেছেন, নারীর দৈহিক সৌন্দর্যের মত সুন্দর বস্তুও যেমন সংসারে নেই, এর বিকৃতির মত অসুন্দর বস্তুও হয়ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই।

আশুবাবু বলিলেন, এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি অজিত।

নীলিমা মাথা নাড়িয়া প্রতিবাদ করিল, না, একটুও বাড়াবাড়ি নয়। এ সত্যি।

আশুবাবু বলিলেন, কিন্তু মেয়েটির যা বয়েস, তাকে তো বিকৃতির বয়স বলা চলে না নীলিমা।

নীলিমা কহিল, চলে। কারণ ও তো কেবলমাত্র বছর গুণে মেয়েদের বেঁচে থাকবার হিসেব নয়, এর আয়ুষ্কাল যে অত্যন্ত কম, এ কথা আর যেই ভুলুক, মেয়েদের ভুললে ত চলবে না।

অজিত ঘাড় নাড়িয়া খুশী হইয়া বলিল, ঠিক এই উত্তরটি তিনি নিজে দিয়েছেন। বলেছেন—“আজ থেকে সমাপ্তির শেষ প্রতীক্ষা করে থাকাই হবে অবশিষ্ট জীবনের একটি মাত্র সত্য। এতে সান্ত্বনা নেই, আনন্দ নেই, আশা নেই জানি, তবু তো উপহাসের লজ্জা থেকে বাঁচবো। ঐশ্বর্যের ভগ্নস্তূপ হয়ত আজও কোনো দুর্ভাগার মনোহরণ করতে পারে, কিন্তু সে মুগ্ধতা তার পক্ষেও যেমন বিড়ম্বনা, আমার নিজের পক্ষেও হবে তেমনি মিথ্যে। যে রূপের সত্যকার প্রয়োজন শেষ হয়েছে, তাকেই নানাভাবে, নানা সজ্জায় সাজিয়ে ‘শেষ হয়নি’ বলে ঠকিয়ে বেড়াতে আমি নিজেকেও পারবো না, পরকেও না।”

আর কেহ কিছু কহিল না, শুধু নীলিমা কহিল, সুন্দর। কথাগুলি আমার ভারী সুন্দর লাগলো অজিতবাবু।

সকলের মত হরেন্দ্রও একমনে শুনিতেছিল; সেই মন্তব্যে খুশী হইল না, কহিল, এ আপনার ভাবাতিশয্যের উচ্ছ্বাস বৌদি, খুব ভেবে বলা নয়। উঁচু ডালে শিমুল ফুলও হঠাৎ সুন্দর ঠেকে, তবু ফুলের দরবারে তার নিমন্ত্রণ পৌঁছোয় না। রমণীর দেহ কি এমনিই তুচ্ছ জিনিস যে, এ ছাড়া আর তার কোন প্রয়োজনই নেই?

নীলিমা কহিল, নেই এ কথা তো লেখিকা বলেন নি। দুর্ভাগা মানুষগুলোর প্রয়োজন যে সহজে মেটে না, এ আশঙ্কা তাঁর নিজেরও ছিল। একটুখানি হাসিয়া কহিল, উচ্ছ্বাসের কথা বলছিলে ঠাকুরপো, অক্ষয়বাবু উপস্থিত নেই, তিনি থাকলে বুঝতেন ওর আতিশয্যটা আজকাল কোন্‌ দিকে চেপেছে।

হরেন্দ্র জবাব দিল, আপনি গালাগালি দিতে থাকলেই যে পচে যাবো তাও নয় বৌদি।

শুনিয়া আশুবাবু নিজেও একটু হাসিলেন, কহিলেন, বাস্তবিক হরেন, আমারও মনে হয় গল্পটিতে লেখিকা মেয়েদের রূপের সত্যকার প্রয়োজনকেই ইঙ্গিত করেছেন,—

কিন্তু এই কি ঠিক?

ঠিক নয়, এ কথা জগৎ-সংসারের দিকে চেয়ে মনে করা কঠিন।

হরেন্দ্র উত্তেজিত হইয়া উঠিল, বলিল, জগৎ-সংসারের দিকে চেয়ে যাই কেননা মনে করুন, মানুষের দিকে চেয়ে একে স্বীকার করা আমার পক্ষেও কঠিন। মানুষের প্রয়োজন জীবজগতের সাধারণ প্রয়োজনকে অতিক্রম করে বহুদূরে চলে গেছে,—তাই ত সমস্যা তার এমন বিচিত্র, এত দুরূহ। একে চালুনিতে ছেঁকে বেছে ফেলা যায় না বলেই ত তার মর্যাদা আশুবাবু।

তাও বটে, গল্পের বাকীটা শুনি অজিত!

হরেন্দ্র ক্ষুণ্ণ হইল, বাধা দিয়া কহিল, সে হবে না আশুবাবু। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উত্তরটা এড়িয়ে যেতে আপনাকে আমি দেবো না, হয় আমাকে সত্যিই স্বীকার করুন, না হয় আমার ভুলটা দেখিয়ে দিন। আপনি অনেক দেখেছেন, অনেক পড়েছেন—প্রকাণ্ড পণ্ডিত মানুষ,—আপনার এই অনির্দিষ্ট ঢিলেঢালা কথার ফাঁক দিয়ে যে বৌদি জিতে যাবেন, সে আমার সইবে না। বলুন।

আশুবাবু হাসিমুখে কহিলেন, তুমি ব্রহ্মচারী মানুষ,—রূপের বিচারে হারলে ত তোমার লজ্জা নেই হরেন।

না, সে আমি শুনবো না।

আশুবাবু ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, তোমার কথা অপ্রমাণ করার জন্যে কোমর বেঁধে তর্ক করতে আমার লজ্জা করে। বস্তুতঃ, নারী-রূপের নিগূঢ় অর্থ অপরিস্ফুট থাকে সেই ভাল হরেন। পুনরায় একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিতে লাগিলেন, অজিতের গল্প শুনতে শুনতে আমার বহুকাল পূর্বের একটা দুঃখের কাহিনী মনে পড়ছিল। ছেলেবেলায় আমার এক ইংরেজ বন্ধু ছিলেন; তিনি একটি পোলিশ রমণীকে ভালবেসেছিলেন। মেয়েটি ছিল অপরূপ সুন্দরী; ছাত্রীদের পিয়ানো বাজনা শিখিয়ে জীবিকা-নির্বাহ করতেন। শুধু রূপে নয়, নানা গুণে গুণবতী,—আমরা সবাই তাঁদের শুভকামনা করতাম। নিশ্চিত জানতাম, এঁদের বিবাহে কোথাও কোন বিঘ্ন ঘটবে না।

0 Shares