শেষ প্রশ্ন

বলিলেন, কমল, তোমার বাবা য়ুরোপিয়ান, তবু তুমি কখনো সে দেশে যাওনি। কিন্তু তাদের মধ্যে আমার বহুদিন কেটেছে, তাদের অনেক-কিছু চোখে দেখেচি। অনেক ভালবাসার বিবাহ-উৎসবে যখন ডাক পড়েচে, আনন্দের সঙ্গে যোগ দিয়েছি, আবার সে বিবাহ যখন অনাদরে উপেক্ষায় অনাচারে অত্যাচারে ভেঙ্গেচে তখনও চোখ মুছেচি। তুমি গেলেও ঠিক এমনি দেখতে পেতে।

কমল মুখ তুলিয়া বলিল, না গিয়েও দেখতে পাই আশুবাবু। ভাঙ্গার নজির সে দেশে প্রত্যহ পুঞ্জিত হয়ে উঠচে, উঠবারই কথা,—এও যেমন সত্যি, ওর থেকে তার স্বরূপ বুঝতে যাওয়াও তেমনি ভুল। ওটা বিচারের পদ্ধতিই নয় আশুবাবু।

আশুবাবু নিজের ভ্রম বুঝিয়া কিছু অপ্রতিভ হইলেন, এমন করিয়া ইহার সহিত তর্ক চলে না; বলিলেন, সে যাক, কিন্তু আমাদের এই দেশটার পানে একবার ভাল করে চেয়ে দেখ দিকি যে প্রথা আবহমানকাল ধরে চলে আসচে তার সৃষ্টিকর্তাদের দূরদর্শিতা! এখানে দায়িত্ব পাত্র-পাত্রীদের পরে নেই, আছে বাপ-মা গুরুজনদের পরে। তাই বিচারবুদ্ধি এখানে আকুল-অসংযমে ঘুলিয়ে ওঠে না, একটা শান্ত অবিচলিত মঙ্গল তাদের চির-জীবনের সঙ্গী হয়ে যায়।

কমল কহিল, কিন্তু মণি ত মঙ্গলের হিসেব করতে বসেনি, আশুবাবু, সে চেয়েছে ভালবাসা। একটার হিসেব গুরুজনের সুযুক্তি দিয়ে মেলে, কিন্তু অন্যটার হিসেব হৃদয়ের দেবতা ছাড়া আর কেউ জানে না। কিন্তু তর্ক করে আপনাকে আমি মিথ্যে উত্ত্যক্ত করছি; যার ঘরে পশ্চিমের জানালা ছাড়া আর সকল দিকই বন্ধ, সে সূর্যের প্রত্যুষের আবির্ভাব দেখতে পায় না, দেখতে পায় শুধু তার প্রদোষের অবসান। কিন্তু সেই চেহারা আর রঙের সাদৃশ্য মিলিয়ে তর্ক করতে থাকলে শুধু কথাই বাড়বে, মীমাংসায় পৌঁছুবে না। আমার কিন্তু রাত হয়ে যাচ্চে, আজ আসি।

নীলিমা বরাবর চুপ করিয়াই ছিল, এতক্ষণের এত কথার মধ্যে একটি কথাও যোগ করে নাই। এখন কহিল, আমিও সব কথা তোমার স্পষ্ট বুঝতে পারিনি কমল, কিন্তু এটুকু অনুভব করচি যে, ঘরের অন্যান্য জানালাগুলোও খুলে দেওয়া চাই। এ ত চোখের দোষ নয়, দোষ বন্ধ বাতায়নের। নইলে যে-দিকটা খোলা আছে সেদিকে দাঁড়িয়ে আমরণ চেয়ে থাকলেও এ-ছাড়া কোন-কিছুই কোনদিন চোখে পড়বে না।

কমল উঠিয়া দাঁড়াইতে আশুবাবু ব্যাকুলকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, যেয়ো না কমল, আর একটুখানি বসো। মুখে অন্ন নেই, চোখে ঘুম নেই,—অবিশ্রাম বুকের ভেতরটায় যে কি করচে সে তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না। তবু আর একবার চেষ্টা করে দেখি তোমার কথাগুলো যদি সত্যিই বুঝতে পারি। তুমি কি যথার্থই বলচ আমি চুপ করে থাকি, আর এই কুশ্রী ব্যাপারটা হয়ে যাক?

কমল বলিল, মণি যদি তাঁকে ভালবেসে থাকে আমি তা কুশ্রী বলতে পারিনে।

কিন্তু এইটেই যে তোমাকে একশো বার বোঝাতে চাচ্চি কমল, এ মোহ, এ ভালবাসা নয়, এ ভুল তার ভাঙ্গবেই।

কমল কহিল, শুধু ভুলই যে ভাঙ্গে তা নয়, আশুবাবু, সত্যিকার ভালবাসাও সংসারে এমনি ভেঙ্গে পড়ে। তাই, অধিকাংশ ভালবাসার বিবাহই হয়ে যায় ক্ষণস্থায়ী। এই জন্যেই ও-দেশের এত দুর্নাম, এত বিবাহ ছিন্ন করার মামলা।

শুনিয়া আশুবাবু সহসা যেন একটা আলো দেখিতে পাইলেন, উচ্ছ্বসিত আগ্রহে কহিয়া উঠিলেন, তাই বল, কমল, তাই বল। এ যে আমি স্বচক্ষে অনেক দেখে এসেচি।

নীলিমা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।

আশুবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু আমাদের এ দেশের বিবাহ-প্রথা? তাকে তুমি কি বলো? সে যে সমস্ত জীবনে ভাঙ্গে না কমল?

কমল কহিল, ভাঙ্গবার কথাও নয় আশুবাবু। সে ত অনভিজ্ঞ যৌবনের ক্ষ্যাপামি নয়, বহুদর্শী গুরুজনের হিসেব-করা কারবার। স্বপ্নের মূলধন নয়,—চোখ চেয়ে, পাকা-লোকের যাচাই-বাছাই করা খাঁটি জিনিস। আঁকের মধ্যে মারাত্মক গলদ না থাকলে তাতে সহজে ফাটল ধরে না। এদেশ-ওদেশ সব দেশেই সে ভারী মজবুত, সারাজীবন বজ্রের মত টিকে থাকে।

আশুবাবু নিশ্বাস ফেলিয়া স্থির হইয়া রহিলেন, মুখে তাঁর উত্তর যোগাইল না।

নীলিমা নিঃশব্দে চাহিয়াই ছিল, ধীরে ধীরে প্রশ্ন করিল, কমল, তোমার কথাই যদি সত্যি হয়, সত্যিকার ভালবাসাও যদি ভুলের মতই সহজে ভেঙ্গে পড়ে, মানুষে তবে দাঁড়াবে কিসে? তার আশা করবার বাকী থাকবে কি?

কমল বলিল, যে স্বর্গবাসের মিয়াদ ফুরুলো, থাকবে তারই একান্ত মধুর স্মৃতি, আর তারই পাশে ব্যথার সমুদ্র। আশুবাবুর শান্তি ও সুখের সীমা ছিল না, কিন্তু তার বেশী ওঁর পুঁজি নেই। ভাগ্য যাঁকে ঐটুকুমাত্র দিয়েই বিদায় করেছে আমরা তাঁকে ক্ষমা করা ছাড়া আর কি করিতে পারি দিদি?

একটুখানি থামিয়া বলিল, লোকে বাইরে থেকে হঠাৎ ভাবে—বুঝি সব গেলো। বন্ধুজনের ভয়ের অন্ত থাকে না, দু’হাত দিয়ে পথ আগলাতে চায়, নিশ্চয় জানে তার হিসেবের বাইরে বুঝি সবই শূন্য। শূন্য নয় দিদি। সব গিয়েও যা হাতে থাকে মাণিক্যের মত তা হাতের মুঠোর মধ্যেই ধরে। বস্তু-বাহুল্যে পথ-জুড়ে তা দিয়ে শোভাযাত্রা করা যায় না বলেই দর্শকের দল হতাশ হয়ে ধিক্কার দিয়ে ঘরে ফেরে,—বলে ঐ ত সর্বনাশ।

নীলিমা বলিল, বলার হেতু আছে কমল। মণি-মাণিক্য সকলের জন্যে নয়, সাধারণের জন্যেও নয়। আপাদমস্তক সোনা-রূপোর গয়না না পেলে যাদের মন ওঠে না, তারা তোমার ঐ একফোঁটা হীরে-মানিকের কদর বুঝবে না। যাদের অনেক চাই, তারা গেরোর ওপর অনেক গেরো লাগিয়েই তবে নিশ্চিন্ত হতে পারে। অনেক ভার, অনেক আয়োজন, অনেক জায়গা দিয়েই তবে জিনিসের দামের আন্দাজ তারা পায়। পশ্চিমের দরজা খুলে সূর্যোদয় দেখানোর চেষ্টা বৃথা হবে কমল, এ আলোচনা বন্ধ থাক।

আশুবাবুর মুখ দিয়া আবার একটা দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া আসিল, আস্তে আস্তে বলিলেন, বৃথা হবে কেন নীলিমা, বৃথা নয়। বেশ, চুপ করেই না হয় থাকবো।

নীলিমা কহিল, না, সে আপনি করবেন না। সত্যি কি শুধু কমলের চিন্তাতেই আছে, আর পিতার শুভবুদ্ধিতে নেই? এমন হতেই পারে না। ওর পক্ষে যা সত্যি, মণির পক্ষে তা সত্যি না-ও হতে পারে। দুশ্চরিত্র স্বামীকে পরিত্যাগ করার মধ্যে যত সত্যিই থাক, বেলার স্বামী-ত্যাগের মধ্যে একবিন্দু সত্যি নেই, আমি জোর করে বলতে পারি। সত্য স্বামীকে ত্যাগ করার মধ্যেও নেই, স্বামীর দাসীবৃত্তি করার মধ্যেও নেই, ও-দুটো শুধু ডাইনে-বাঁয়ের পথ, গন্তব্য স্থানটা আপনি খুঁজে নিতে হয়, তর্ক করে তার ঠিকানা মেলে না।

0 Shares