শেষ প্রশ্ন

কমল বাসায় পৌঁছিয়া দেখিল, সহজে উপরে যাইবার জো নাই, রাশিকৃত বাক্স-তোরঙ্গে সিঁড়ির মুখটা রুদ্ধপ্রায়। বুকের ভিতরটায় ছাঁৎ করিয়া উঠিল। কোনমতে একটু পথ করিয়া উপরে গিয়া শুনিল, পাশের রান্নাঘরে কলরব হইতেছে; উঁকি মারিয়া দেখিল, অজিত হিন্দুস্থানী মেয়েলোকটির সাহায্যে স্টোভে জল চড়াইয়াছে, এবং চা-চিনি প্রভৃতির সন্ধানে ঘরের চতুর্দিকে আতিপাতি করিয়া খুঁজিয়া ফিরিতেছে।

এ কি কাণ্ড?

অজিত চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল,—চা-চিনি কি তুমি লোহার সিন্দুকে বন্ধ করে রাখ না কি? জলটা ফুটে ফুটে যে প্রায় নষ্ট হয়ে এলো।

কিন্তু আমার ঘরের মধ্যে আপনি খুঁজে পাবেন কেন? সরে আসুন, আমি তৈরি করে দিচ্চি।

অজিত সরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল।

কমল কহিল, কিন্তু এ কি ব্যাপার? বাক্স-তোরঙ্গ, পোঁটলা-পুঁটলি, এ-সব কার?

আমার। হরেনবাবু নোটিশ দিয়েছেন।

দিলেও যাবারই নোটিশ দিয়েচেন। এখানে আসবার বুদ্ধি দিলে কে?

এটা নিজের। এতদিন পরের বুদ্ধিতেই দিন কেটেছে, এবার নিজের বুদ্ধি খুঁজে বের করেছি।

কমল কহিল, বেশ করেছেন। কিন্তু ওগুলো কি নীচেই পড়ে থাকবে? চুরি যাবে যে।

শুনিয়া অজিত ব্যস্ত হইয়া উঠিল,—যায়নি ত? একটা চামড়ার বাক্সে অনেকগুলো টাকা আছে।

কমল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, খুব ভাল। এক জাতের মানুষ আছে তারা আশি বচ্ছরে সাবালক হয় না। তাদের মাথার ওপর অভিভাবক একজন চাই-ই। এ ব্যবস্থা ভগবান কৃপা করে করেন। চা থাক, নীচে আসুন। ধরাধরি করে তোলবার চেষ্টা করা যাক।

পরিচ্ছেদ – সাতাইশ

বাড়িয়ালা এইমাত্র পুরা মাসের ভাড়া চুকাইয়া লইয়া গেল। ইতস্ততঃ-বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্রের মাঝখানে, বিশৃঙ্খল কক্ষের একধারে ক্যাম্বিশের ইজিচেয়ারে অজিত চোখ বুজিয়া শুইয়া। মুখ শুষ্ক, দেখিলেই বোধ হয় চিন্তাগ্রস্ত মনের মধ্যে সুখের লেশমাত্র নাই। কমল বাঁধা-ছাঁদা জিনিসগুলার ফর্দ মিলাইয়া কাগজে টুকিয়া রাখিতেছিল। স্থানত্যাগের আসন্নতায় কাজের মধ্যে তাহার চঞ্চলতা নাই,—যেন প্রাত্যহিক নিয়মিত ব্যাপার। কেবল একটুখানি যেন বেশী নীরব।

সান্ধ্যভোজের নিমন্ত্রণ আসিল হরেন্দ্রের নিকট হইতে। লোকের হাতে নয়,—ডাকে। অজিত চিঠিখানি পড়িল। আশুবাবুর বিদায়-উপলক্ষে এই আয়োজন। পরিচিত অনেককেই আহ্বান করা হইয়াছে। নীচের এক কোণে ছোট্ট করিয়া লেখা, কমল, নিশ্চয় এসো ভাই।—নীলিমা।

অজিত সেইটুকু দেখাইয়া প্রশ্ন করিল, যাবে নাকি?

যাবো বৈ কি। নিমন্ত্রণ জিনিসটা তুচ্ছ করতে পারি আমার এত দর নয়। কিন্তু তুমি?

অজিত দ্বিধার স্বরে বলিল, তাই ভাবচি। আজ শরীরটা তেমন—

তবে, কাজ নেই গিয়ে।

অজিতের চোখ তখনো চিঠির ’পরে ছিল। নইলে কমলের ঠোঁটের কোণে কৌতুকহাস্যের রেখাটুকু নিশ্চয় দেখিতে পাইত।

যেমন করিয়াই হোক, বাঙালী-মহলে খবরটা জানাজানি হইয়াছে যে উভয়ে আগ্রা ছাড়িয়া যাইতেছে। কিন্তু কিভাবে ও কোথায়, এ সম্বন্ধে লোকের কৌতূহল এখনো সুনিশ্চিত মীমাংসায় পৌঁছে নাই। অকালের মেঘের মত কেবলি আন্দাজ ও অনুমানে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। অথচ জানা কঠিন ছিল না,—কমলকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানা যাইতে পারিত তাহাদের গম্যস্থানটা আপাততঃ অমৃতসর। কিন্তু এটা কেহ ভরসা করে নাই।

অজিতের বাবা ছিলেন গুরুগোবিন্দের পরম ভক্ত। তাই শিখেদের মহাতীর্থ অমৃতসরে তিনি খালসা কলেজের কাছাকাছি মাঠের মধ্যে একটা বাঙলো-বাড়ি তৈরি করাইয়াছিলেন। সময় ও সুবিধা পাইলেই আসিয়া বাস করিয়া যাইতেন। তাঁহার মৃত্যুর পরে বাড়িটা ভাড়ায় খাটিতেছিল, সম্প্রতি খালি হইয়াছে; এই বাটীতেই দু’জনে কিছুকাল বাস করিবে। মালপত্র যাইবে লরিতে, এবং পরে শেষরাত্রে মোটরে করিয়া উভয়ে রওনা হইবে। সেই প্রথম দিনের স্মৃতি,—এটা কমলের অভিলাষ।

অজিত কহিল, হরেন্দ্রের ওখানে তুমি কি একা যাবে নাকি?

যাই না! আশ্রমের দোর ত তোমার খোলাই রইল, যবে খুশি দেখা করে যেতে পারবে। কিন্তু আমার ত সে আশা নেই,—শেষ দেখা দেখে আসি গে,—কি বল?

অজিত চুপ করিয়া রহিল। স্পষ্টই দেখিতে পাইল, সেথায় নানা ছলে বহু তীক্ষ্ণ ও তিক্ত ইঙ্গিতে ব্যক্ত ও অব্যক্ত ইশারায় আজ শুধু একটিমাত্র দিকেই ছুটিতে থাকিবে, ইহারই সম্মুখে এই একাকিনী রমণীকে পরিত্যাগ করার মত কাপুরুষতা আর কিছু হইতে পারে না। কিন্তু সঙ্গী হইবার সাহস নাই, নিষেধ করাও তেমনি কঠিন।

নূতন গাড়ি কেনা হইয়া আসিয়াছে, সন্ধ্যার কিছু পরে সোফার কমলকে লইয়া চলিয়া গেল।

হরেন্দ্রের বাসায় দ্বিতলের সেই হল-ঘরটায় নূতন দামী কার্পেট বিছাইয়া অতিথিদের স্থান করা হইয়াছে। আলো জ্বলিতেছে অনেকগুলা, কোলাহলও কম হইতেছে না। মাঝখানে আশুবাবু, ও তাঁহাকে ঘিরিয়া জন-কয়েক ভদ্রলোক। বেলা আসিয়াছেন, এবং আরও একটি মহিলা আসিয়াছেন—তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের পত্নী মালিনী। কে-একটি ভদ্রলোক এদিকে পিছন ফিরিয়া তাঁহাদের সঙ্গে গল্প করিতেছেন। নীলিমা নাই, খুব সম্ভব অন্যত্র কাজে নিযুক্ত।

হরেন্দ্র ঘরে ঢুকিল এবং ঘরে ঢুকিয়াই চোখে পড়িল এদিকের দরজার পাশে দাঁড়াইয়া কমল। সবিস্ময়ে কলস্বরে সংবর্ধনা করিল,—কমল যে? কখন এলে? অজিত কৈ?

সকলের দৃষ্টি একাগ্র হইয়া ঝুঁকিয়া পড়িল। কমল দেখিল, যে ব্যক্তি মহিলাদের সহিত আলাপ করিতেছিলেন তিনি আর কেহ নহেন, স্বয়ং অক্ষয়। কিঞ্চিৎ শীর্ণ। ইন্ফ্লুয়েঞ্জা এড়াইয়াছেন। কিন্তু দেশের ম্যালিরিয়াকে পাশ কাটাইতে পারেন নাই। ভালই হইল যে তিনি ফিরিয়াছেন, নইলে শেষ দেখার হয়ত আর সুযোগ ঘটিত না। দুঃখ থাকিয়া যাইত।

কমল বলিল, অজিতবাবু আসেন নি,—শরীরটা ভাল নয়। আমি এসেছি অনেকক্ষণ।

অনেকক্ষণ? ছিলে কোথায়?

নীচে। ছেলেদের ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। দেখছিলাম, ধর্মকে ত ফাঁকি দিলেন, কর্মকেও ঐ সঙ্গে ফাঁকি দিলেন কি না? এই বলিয়া সে হাসিয়া ঘরে আসিয়া বসিল।

0 Shares