মশাই!
থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম, আজ্ঞা করুন।
আপনি এখানে কবে এসেছেন শুনতে পারি কি?
পারেন। এসেছি কাল বৈকালে।
রাত্রিতে আখড়াতে ছিলেন বুঝি?
হাঁ, ছিলাম।
ওঃ!
মিনিটখানেক নীরবে কাটিল। পা বাড়াইবার চেষ্টা করিতে লোকটা বলিল, আপনি ত বোষ্টম নয়, ভদ্রলোক—আখড়ার মধ্যে আপনাকে থাকতে দিলে যে?
বলিলাম, সে খবর তাঁরাই জানেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করবেন।
ওঃ! কমলিলতা থাকতে বললে বুঝি?
হাঁ।
ওঃ! জানেন ওর আসল নাম কি? ঊষাঙ্গিনী। বাড়ি সিলেটে, কিন্তু দেখায় যেন ও কলকাতার মেয়েমানুষ! আমার বাড়িও সিলেটে। গাঁয়ের নাম মামুদপুর। শুনবেন ওর স্বভাব-চরিত্র?
বলিলাম, না। কিন্তু লোকটার ভাবগতিক দেখিয়া এবার সত্যি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। প্রশ্ন করিলাম, কমললতার সঙ্গে আপনার কি কোন সম্বন্ধ আছে?
আছে না?
কি সেটা?
লোকটা ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করিয়া হঠাৎ গর্জন করিয়া উঠিল, কেন, মিথ্যে নাকি? ও আমার পরিবার হয়। ওর বাপ নিজে থেকে আমাদের কণ্ঠিবদল করিয়েছিল। তার সাক্ষী আছে।
কেন জানি না আমার বিশ্বাস হইল না। জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা কি জাত?
আমরা দ্বাদশ-তিলি।
আর কমললতারা?
প্রত্যুত্তরে লোকটা তাহার সেই মোটা ভ্রূ-জোড়া ঘৃণায় কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ওরা শুঁড়ি, ওদের জলে আমরা পা ধুইনে। একবার ডেকে দিতে পারেন?
না। আখড়ায় সবাই যেতে পারে, ইচ্ছে হলে আপনিও পারেন।
লোকটা রাগ করিয়া বলিল, যাব মশাই, যাব, দারোগাকে দু পয়সা খাইয়ে রেখেচি, পেয়াদা সঙ্গে করে একবারে ঝুঁটি ধরে টেনে বার করে আনব। বাবাজীর বাবাও রাখতে পারবে না। শালা রাস্কেল কোথাকার!
আর বাক্যব্যয় না করিয়া চলিতে লাগিলাম। লোকটা পিছন হইতে কর্কশকণ্ঠে কহিল, তাতে আপনার কি হ’ল? গিয়ে একবার ডেকে দিলে কি শরীর ক্ষয়ে যেত নাকি? ওঃ—ভদ্দরলোক!
আর ফিরিয়া চাহিতে ভরসা হইল না। পাছে রাগ সামলাইতে না পারি এবং এই অতি দুর্বল লোকটার গায়ে হাত দিয়া ফেলি এই ভয়ে একটু দ্রুতপদেই প্রস্থান করিলাম। মনে হইতে লাগিল বৈষ্ণবীর পলাইবার হেতুটা বোধ হয় এইখানেই কোথায় জড়িত।
মনটা বিগড়াইয়াছিল, ঠাকুরঘরে নিজেও গেলাম না, কেহ ডাকিতেও আসিল না। ঘরের মধ্যে একখানি জলচৌকির উপরে গুটিকয়েক বৈষ্ণব গ্রন্থাবলী সযত্নে সাজানো ছিল, তাহারি একখানা হাতে করিয়া প্রদীপটা শিয়রের কাছে আনিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িলাম। বৈষ্ণব-ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য নয়, শুধু সময় কাটাইবার জন্য। ক্ষোভের সহিত একটা কথা বার বার মনে হইতেছিল, কমললতা সেই যে গিয়াছে আর আসে নাই। ঠাকুরের সন্ধ্যারতি যথারীতি আরম্ভ হইল, তাহার মধুর কণ্ঠ বার বার কানে আসিতে লাগিল এবং ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবল সেই কথাটাই মনে হইতে লাগিল কমললতা সেই অবধি কোন তত্ত্বই আমার লয় নাই। আর সেই ভ্রূ-ওয়ালা লোকটা! কোন সত্যই কি তাহার অভিযোগের মধ্যে নাই?
আরও একটা কথা। গহর কৈ? সেও ত আজ আমার খোঁজ লইল না। ভাবিয়াছিলাম দিনকয়েক এখানেই কাটাইব,— পুঁটুর বিবাহের দিনটি পর্যন্ত—কিন্তু সে আর হয় না। হয়ত কালই কলিকাতায় রওনা হইয়া পড়িব।
ক্রমশঃ আরতি ও কীর্তন সমাপ্ত হইল। কল্যকার সেই বৈষ্ণবী আসিয়া আজও বহু যত্নে প্রসাদ রাখিয়া গেল, কিন্তু যেজন্য পথ চাহিয়াছিলাম তাহার দেখা মিলিল না। বাহিরে লোকজনের কথাবার্তা, আনাগোনার পায়ের শব্দ ক্রমশঃ শান্ত হইয়া আসিল, তাহার আসিবার কোন সম্ভাবনা আর নাই জানিয়া আহার করিয়া হাতমুখ ধুইয়া দীপ নিবাইয়া শুইয়া পড়িলাম।
বোধ করি তখন অনেক রাত্রি, কানে গেল,—নতুনগোঁসাই?
জাগিয়া উঠিয়া বসিলাম। অন্ধকারে ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া কমললতা; আস্তে আস্তে বলিল, আসিনি বলে মনে মনে বোধ হয় অনেক দুঃখ করেছো—না গোঁসাই?
বলিলাম, হাঁ, করেচি।
বৈষ্ণবী মুহূর্তকাল নীরব হইয়া রহিল, তার পরে বলিল, বনের মধ্যে ও লোকটা তোমাকে কি বলছিল?
তুমি দেখেছিলে নাকি?
হাঁ।
বলছিল সে তোমার স্বামী—অর্থাৎ তোমাদের সামাজিক আচারমতে তুমি তার কণ্ঠিবদল-করা পরিবার।
তুমি বিশ্বাস করেছো?
না, করিনি।
বৈষ্ণবী আবার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, সে আমার স্বভাব-চরিত্রের ইঙ্গিত করেনি?
করেছে।
আমার জাত?
হাঁ, তাও।
বৈষ্ণবী একটুখানি থামিয়া বলিল, শুন্বে আমার ছেলেবেলার ইতিহাস? কিন্তু হয়ত তোমার ঘৃণা হবে।
বলিলাম, তবে থাক, ও আমি শুনতে চাইনে।
কেন?
বলিলাম, তাতে লাভ কি কমললতা? তোমাকে আমার ভারী ভালো লেগেছে। কিন্তু কাল চলে যাবো, হয়ত আর কখনো আমাদের দেখাও হবে না। নিরর্থক আমার সেই ভালোলাগাটুকু নষ্ট করে ফেলে ফল কি হবে বলো ত?
বৈষ্ণবী এবার অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া সে কি করিতেছে ভাবিয়া পাইলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি ভাবচ?
ভাবচি, কাল তোমাকে যেতে দেব না।
তবে, কবে যেতে দেবে?
যেতে কোনদিনই দেব না। কিন্তু অনেক রাত হ’লো, ঘুমোও। মশারিটা ভালো করে গোঁজা আছে ত?
কি জানি, আছে বোধ হয়।
বৈষ্ণবী হাসিয়া কহিল, আছে বোধ হয়? বাঃ—বেশ ত! এই বলিয়া সে কাছে আসিয়া অন্ধকারেই হাত বাড়াইয়া বিছানার সকল দিক পরীক্ষা করিয়া বলিল, ঘুমোও গোঁসাই—আমি চললুম। এই বলিয়া সে পা-টিপিয়া বাহির হইয়া গেল এবং বাহির হইতে অত্যন্ত সাবধানে দরজা বন্ধ করিয়া দিল।
পরিচ্ছেদ – সাত
আজ আমাকে বৈষ্ণবী বার বার করিয়া শপথ করাইয়া লইল তাহার পূর্ব-বিবরণ শুনিয়া আমি ঘৃণা করিব কি না।
বলিলাম, শুনতে আমি চাইনে, কিন্তু শুনলেও ঘৃণা করব না।
বৈষ্ণবী প্রশ্ন করিল, কিন্তু করবে না কেন? সে শুনলে মেয়েপুরুষে সবাই ত ঘৃণা করে!
বলিলাম, তুমি কি বলবে আমি জানিনে কিন্তু তবুও আন্দাজ করতে পারি। সে শুনলে মেয়েরাই যে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে সে জানি এবং তার কারণও জানি, কিন্তু তোমাকে বলতে আমি চাইনে। পুরুষেরাও করে, কিন্তু অনেক সময়ে সে ছলনা, অনেক সময়ে আত্মবঞ্চনা। তুমি যা বলবে তার চেয়েও অনেক কুশ্রী কথা আমি তোমাদের নিজের মুখেও শুনেচি, চোখেও দেখেছি। কিন্তু তবুও ঘৃণা হয় না।