শ্রীকান্ত – চতুর্থ পর্ব

কীর্তি? নিজের মুখে কি আর বলব ভাই, আগে শোন, তারপরে হবে কথা।

কোনদিক দিয়াই নিস্তার নাই। ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কতকটা যেন নিজের মনেই বলিলাম, সকাল থেকেই শরীরটা এমন বিশ্রী ঠেকচে যে মনে হচ্ছে ঘুমোতে পেলে—

গহর কানও দিল না, বলিল, পুষ্পক-রথে সীতা যেখানে কাঁদতে কাঁদতে গয়না ফেলে দিচ্চেন, সে জায়গাটা যারা যারা শুনেচে চোখের জল রাখতে পারেনি, শ্রীকান্ত।

চোখের জল যে আমিই রাখিতে পারিব সে সম্ভাবনা কম। বলিলাম, কিন্তু—

গহর কহিল, আমাদের সেই বুড়ো নয়নচাঁদ চক্রবর্তীকে তোর মনে আছে ত, তার জ্বালায় আমি আর পারিনে। যখন-তখন এসে বলবে, গহর, সেইখানটা একবার পড় দেখি, শুনি।

৭৭৯

বলে, বাবা তুই কখনো মোছলমানের ছেলে নোস্‌—তোর গায়ে আসল ব্রহ্মরক্ত স্বচক্ষে দেখতে পাচ্চি।

নয়নচাঁদ নামটা খুব সচরাচর মেলে না, তাই মনে পড়িল। বাড়ি গহরদের গ্রামেই। জিজ্ঞাসা করিলাম, সেই চক্কোত্তি বুড়ো ত? যার সঙ্গে তোমার বাবার লাঠালাঠি মালি-মোকদ্দমা চলছিল?

গহর বলিল, হাঁ কিন্তু বাবার সঙ্গে পারবে কেন—তার জমি, বাগান, পুকুর, মায় বাস্তুসমেত বাবা দেনার দায়ে নিলেম করে নিয়েছিল; আমি কিন্তু তার পুকুর আর ভিটেটা ফিরিয়ে দিয়েচি। ভারী গরীব—দিনরাত চোখের জল ফেলত, সে কি আর ভাল শ্রীকান্ত!

ভাল ত নয়ই। চক্রবর্তীর কাব্য-প্রীতিতে এমনি কিছু-একটা আন্দাজ করিতেছিলাম, বলিলাম, এখন চোখের জল ফেলা থেমেচে ত?

গহর কহিল, লোকটি কিন্তু সত্যিই ভালোমানুষ। দেনার জ্বালায় একসময়ে যা করেছিল অমন অনেকেই করে। ওর বাড়ির পাশেই বিঘে-দেড়েকের একটা আমবাগান আছে, তার প্রত্যেক গাছটাই চক্কোত্তির নিজের হাতে পোঁতা। নাতি-নাতনী অনেকগুলি, কিনে খাবার পয়সা নেই—তা ছাড়া আমার কেই-বা আছে, কেই-বা খাবে।

সে ঠিক। ওটাও ফিরিয়ে দাও গে।

দেওয়াই উচিত শ্রীকান্ত। চোখের সামনে আম পাকে, ছেলেপুলেগুলোর নিঃশ্বাস পড়ে—আমার ভারি দুঃখ হয় ভাই। আমের সময় আমার বাগানগুলো ত সব ব্যাপারীদের জমা করেই দিই—ও বাগানটা আর বিক্রি করিনে, বলি, চক্কোত্তিমশাই, তোমার নাতিরা যেন পেড়ে খায়। কি বলিস রে, ভালো না?

নিশ্চয়ই ভালো। মনে মনে বলিলাম, বৈকুণ্ঠের খাতার জয় হোক, তাহার কল্যাণে গরীব নয়নচাঁদ যদি যৎকিঞ্চিৎ গুছাইয়া লইতে পারে, হানি কি? তাছাড়া গহর কবি। কবি-মানুষের অত বিষয়-সম্পত্তি কিসের জন্য, যদি রসগ্রাহী রসিক সুজনদের ভোগেই না লাগে?

চৈত্রের প্রায় মাঝামাঝি। গাড়ির কপাটটা গহর অকস্মাৎ শেষ পর্যন্ত ঠেলিয়া দিয়া বাহিরে মাথা বাড়াইয়া বলিল, দক্ষিণে বাতাসটা টের পাচ্ছিস শ্রীকান্ত?

পাচ্চি।

গহর কহিল, বসন্তকে ডাক দিয়ে কবি বলেচেন, ‟আজ দখিন দুয়ার খোলা—”

কাঁচা মেঠো রাস্তা, এক ঝাপটা মলয়ানিল রাস্তার শুকনো ধূলা আর রাস্তায় রাখিল না, সমস্ত মাথায় মুখে মাখাইয়া দিয়া গেল। বিরক্ত হইয়া বলিলাম, কবি বসন্তকে ডাকেন নি, তিনি বলেচেন এ সময়ে যমের দক্ষিণ-দোর খোলা—সুতরাং গাড়ির দরজা বন্ধ না করলে হয়ত সে-ই এসে হাজির হবে।

গহর হাসিয়া কহিল, গিয়ে একবার দেখবি চল্‌। দুটো বাতাবি লেবুর গাছে ফুল ফুটেচে, আধক্রোশ থেকে গন্ধ পাওয়া যায়। সুমুখের জামগাছটা মাধবী ফুলে ভরে গেছে, তার একটা ডালে মালতীর লতা ফুল এখনো ফোটেনি, কিন্তু থোপা থোপা কুঁড়ি। আমাদের চারিদিকেই ত আমের বাগান, এবার মৌলে মৌলে গাছ ছেয়ে গেলে, কাল সকালে দেখিস মৌমাছির মেলা। কত

দোয়েল, কত বুলবুলি, আর কত কোকিলের গান। এখন জ্যোৎস্না রাত কিনা, তাই রাত্রিতেও কোকিলদের ডাকাডাকি থামে না। বাইরের ঘরের দক্ষিণের জানালাটা যদি খুলে রাখিস তোর দু’চোখে আর পলক পড়বে না। এবার কিন্তু সহজে ছেড়ে দিচ্চিনে ভাই, তা আগে থেকেই বলে রাখচি। তা ছাড়া খাবার ভাবনাও নেই, চক্কোত্তিমশাই একবার খবর পেলে হয়, তোরে গুরুর আদর করবে।

তাহার আমন্ত্রণের অকপট আন্তরিকতায় মুগ্ধ হইলাম। কতকাল পরে দেখা কিন্তু ঠিক সেদিনের সে গহর—এতটুকু বদলায় নাই—তেমনি ছেলেমানুষ—তেমনি বন্ধু-সম্মিলনে তাহার অকৃত্রিম উল্লাসের ঘটা।

গহররা মুসলমান ফকির-সম্প্রদায়ের লোক। শুনিয়াছি তাহার পিতামহ বাউল, রামপ্রসাদী ও অন্যান্য গান গাহিয়া ভিক্ষা করিত। তাহার একটা পোষা শালিক পাখির অলৌকিক সঙ্গীত-পারদর্শিতার কাহিনী তখনকার দিনে এদিকে প্রসিদ্ধ ছিল। গহরের পিতা কিন্তু পৈতৃক বৃত্তি ত্যাগ করিয়া তেজারতি ও পাটের ব্যবসায়ে অর্থোপার্জন করিয়া ছেলের জন্য সম্পত্তি খরিদ করিয়া রাখিয়া গিয়াছে, অথচ ছেলে পাইল না বাপের বিষয়বুদ্ধি, পাইয়াছে ঠাকুর্দার কাব্য ও সঙ্গীতের অনুরাগ। সুতরাং, পিতার বহুশ্রমার্জিত জমিজমা চাষ-আবাদের শেষ পরিণাম যে কি দাঁড়াইবে তাহা শঙ্কা ও সন্দেহের বিষয়।

সে যাই হোক, বাড়িটা তাহাদের দেখিয়াছিলাম ছেলেবেলায়। ভালো মনে নাই। এখন হয়ত তাহা রূপান্তরিত হইয়াছে কবির বাণী-সাধনার তপোবনে। আর একবার চোখে দেখিবার আগ্রহ জন্মিল।

তাহাদের গ্রামের পথ আমাদের পরিচিত, তাহার দুর্গমতার চেহারাও মনে পড়ে, কিন্তু অল্প কিছুক্ষণেই জানা গেল শৈশবের সেই মনে-পড়ার সঙ্গে আজকের চোখে-দেখার একেবারে কোন তুলনাই হয় না। বাদশাহী আমলের রাজবর্ত্ম—অতিশয় সনাতন। ইট-পাথরের পরিকল্পনা এদিকের জন্য নয়, সে দুরাশা কেহ করে না, কিন্তু সংস্কারের সম্ভাবনাও লোকের মন হইতে বহুকাল পূর্বে মুছিয়া গিয়াছে। গ্রামের লোকে জানে অনুযোগ-অভিযোগ বিফল—তাহাদের জন্য কোনদিনই রাজকোষে অর্থ নাই—তাহারা জানে পুরুষানুক্রমে পথের জন্য শুধু ‘পথকর’ যোগাইতে হয়, কিন্তু সে-পথ যে কোথায় এবং কাহার জন্য এ-সকল চিন্তা করাও তাহাদের কাছে বাহুল্য।

সেই পথের বহুকাল-সঞ্চিত স্তূপীকৃত ধূলাবালির বাধা ঠেলিয়া গাড়ি আমাদের কেবলমাত্র চাবুকের জোরেই অগ্রসর হইতেছিল, এমনি সময়ে গহর অকস্মাৎ উচ্চ-কোলাহলে ডাক দিয়া উঠিল, গাড়োয়ান, আর না, আর না—থামো, থামো —একদম রোকো।

0 Shares