শ্রীকান্ত – চতুর্থ পর্ব

প্রশ্ন করিলাম, সেখানে বসবাস করতে চললে না কি?

রাজলক্ষ্মী বলিল, দু’একদিন থাকব না? দেশের বনজঙ্গল, নদীনালা, মাঠঘাট তুমিই একলা দেখে আসবে, আর আমি কি সে-দেশের মেয়ে নই? আমার দেখতে সাধ যায় না?

তা যায় মানি, কিন্তু এত জিনিসপত্র, এত রকমের খাবার-দাবার আয়োজন—

রাজলক্ষ্মী বলিল, ঠাকুরের স্থানে কি শুধুহাতে যেতে বলো? আর তোমাকে ত বইতে হবে না, তোমার ভাবনা কিসের?

ভাবনা যে কত ছিল সে আর বলিব কাহাকে? আর এই ভয়টাই বেশি ছিল যে, বৈষ্ণব-বৈরাগীর ছোঁয়া ঠাকুরের প্রসাদ সে স্বচ্ছন্দে মাথায় তুলিবে, কিন্তু মুখে তুলিবে না। কি জানি সেখানে গিয়া কোন একটা ছলে উপবাস শুরু করিবে, না রাঁধিতে বসিবে বলা কঠিন। কেবল একটা ভরসা ছিল মনটি রাজলক্ষ্মীর সত্যকার ভদ্র মন। অকারণে গায়ে পড়িয়া কাহাকেও ব্যথা দিতে পারে না। যদিবা এ-সব কিছু করে, হাসিমুখে রহস্যে-কৌতুকে এমন করিয়াই করিবে যে আমি ও রতন ছাড়া আর কেহ বুঝিতেও পারিবে না।

রাজলক্ষ্মীর দৈহিক ব্যবস্থায় বাহুল্যভার কোনকালেই নাই, তাহাতে সংযম ও উপবাসে সেই দেহটাকে যেন লঘুতার একটি দীপ্তি দান করিয়াছে। বিশেষ করিয়া তাহার আজিকার সাজসজ্জাটি হইয়াছে বিচিত্র। প্রত্যূষে স্নান করিয়া আসিয়াছে, গঙ্গার ঘাটে উড়েপাণ্ডার সযত্ন-রচিত অলক-তিলক তাহার ললাটে, পরনে তেমনি নানা ফুলে-ফুলে লতায়-পাতায় বিচিত্র খয়ের রঙের বৃন্দাবনী শাড়ি, গায়ে সেই কয়টি অলঙ্কার, মুখের ‘পরে স্নিগ্ধ-প্রসন্নতা—আপন মনে কাজে ব্যাপৃত। কাল গোটা-দুই লম্বা আয়না-লাগানো আলমারি কিনিয়া আনিয়াছে, আজ যাইবার পূর্বে তাড়াতাড়ি করিয়া কি-সব তাহাতে সে গুছাইয়া তুলিতেছিল। কাজের সঙ্গে হাতের বালার হাঙ্গরের চোখ-দুটা মাঝে মাঝে জ্বলিয়া উঠিতেছে, হীরা ও পান্নাবসানো গলার হারের বিভিন্ন বর্ণচ্ছটা পাড়ের ফাঁক দিয়া ঝলকিয়া উঠিতেছে, তাহার কানের কাছেও কি যেন একটা নীলাভ দ্যুতি, টেবিলে চা খাইতে বসিয়া আমি একদৃষ্টে সেইদিকে চাহিয়া ছিলাম। তাহার একটা দোষ ছিল—বাড়িতে সে জামা অথবা সেমিজ পরিত না। তাই কণ্ঠ ও বাহুর অনেকখানি হয়ত অসতর্ক মুহূর্তে অনাবৃত হইয়া পড়িত, অথচ বলিলে হাসিয়া কহিত, অত পারিনে বাপু। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, দিনরাত বিবিয়ানা আর সয় না। অর্থাৎ জামা-কাপড়ের বেশি বাঁধাবাঁধি শুচিবায়ুগ্রস্তদের অত্যন্ত অস্বস্তিকর।

আলমারির পাল্লা বন্ধ করিয়া হঠাৎ আয়নায় তাহার চোখ পড়িল আমার ‘পরে। তাড়াতাড়ি গায়ের কাপড় সামলাইয়া লইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল, রাগিয়া বলিল, আবার চেয়ে আছ? এভাবে বারে বারে কি আমাকে এত দেখ বলো ত? বলিয়াই হাসিয়া ফেলিল।

আমি হাসিলাম, বলিলাম, ভাবছিলাম বিধাতাকে ফরমাশ দিয়ে না জানি কে তোমাকে গড়িয়েছিল।

রাজলক্ষ্মী কহিল, তুমি। নইলে এমন সৃষ্টিছাড়া পছন্দ আর কার? আমার পাঁচ-ছ’বছর আগে এসেচো, আসবার সময় তাঁকে বায়না দিয়ে এসেছিল—মনে নেই বুঝি?

না, কিন্তু তুমি জানলে কি করে?

চালান দেবার সময় কানে কানে তিনি বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু হ’লো চা খাওয়া? দেরি করলে যে আজও যাওয়া হবে না।

নাই বা হ’লো।

কেন বলো ত?

সেখানে ভিড়ের মধ্যে হয়ত তোমাকে খুঁজে পাব না।

রাজলক্ষ্মী কহিল, আমাকে পাবে। আমিই তোমাকে খুঁজে পেলে বাঁচি।

বলিলাম, সেও ত ভালো নয়।

সে হাসিয়া কহিল, না, সে হবে না। লক্ষ্মীটি চল। শুনেচি নতুনগোঁসাইয়ের সেখানে একটা আলাদা ঘর আছে, আমি গিয়েই তার খিলটা ভেঙ্গে রেখে দেব। ভয় নেই, খুঁজতে হবে না—দাসীকে এমনই পাবে।

তবে চলো।

আমরা মঠে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম তখন ঠাকুরের মধ্যাহ্নকালীন পূজা সেইমাত্র সমাপ্ত হইয়াছে। বিনা আহ্বানে, বিনা সংবাদে এতগুলি প্রাণী অকস্মাৎ গিয়া হাজির, তথাপি কি যে তাহারা খুশি হইল বলিতে পারি না। বড়গোঁসাই আশ্রমে নাই, গুরুদেবকে দেখিতে আবার নবদ্বীপে গিয়াছেন, কিন্তু ইতিমধ্যে জন-দুই বৈরাগী আসিয়া আমারই ঘরে আস্তানা গাড়িয়াছে।

কমললতা, পদ্মা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং আরও অনেকে আসিয়া মহাসমাদরে অভ্যর্থনা করিল; কমললতা গাঢ়স্বরে কহিল, নতুনগোঁসাই, তুমি যে এত শীঘ্র এসে আবার আমাদের দেখা দেবে এ আশা করিনি।

রাজলক্ষ্মী কথা কহিল, যেন কতকালের চেনা। বলিল, কমললতাদিদি, এ ক’দিন শুধু তোমার কথাই ওঁর মুখে, আরও আগে আসতে চেয়েছিলেন, কেবল আমার জন্যেই ঘটে

ওঠেনি। ওটা আমারই দোষে।

কমললতার মুখ ক্ষণকালের জন্যে রাঙ্গা হইয়া উঠিল, পদ্মা ফিক করিয়া হাসিয়া চোখ

ফিরাইয়া লইল।

রাজলক্ষ্মীর বেশভূষা ও চেহারা দেখিয়া সে যে সম্ভ্রান্তঘরের মেয়ে তাহা সবাই

বুঝিয়াছে, শুধু আমার সঙ্গে যে তাহার কি সম্বন্ধ ইহাই তাহারা নিঃসন্দেহে ধরিতে পারে

নাই। পরিচয়ের জন্য সবাই উদ্‌গ্রীব হইয়া উঠিল। রাজলক্ষ্মীর চোখে কিছুই এড়ায় না,

বলিল, কমললতাদিদি, আমাকে চিনতে পারচো না?

কমললতা মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

বৃন্দাবনে দেখনি কখনো?

কমললতাও নির্বোধ নয়, পরিহাসটা সে বুঝিল, হাসিয়া বলিল, মনে ত পড়চে না ভাই।

রাজলক্ষ্মী বলিল, না পড়াই ভালো দিদি। আমি এদেশেরই মেয়ে, কখনো বৃন্দাবনের

ধারেও যাইনি,—বলিয়াই হাসিয়া ফেলিল। লক্ষ্মী, সরস্বতী ও অন্যান্য সকলে চলিয়া গেলে

আমাকে দেখাইয়া কহিল, আমরা দু’জনে এক গাঁয়ে এক গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়তুম—

দুটিতে যেন ভাইবোন এমনি ছিল ভাব। পাড়ার সুবাদে দাদা বলে ডাকতুম—বোনের মত

আমাকে কি ভালোই বাসতেন। গায়ে কখনো হাতটি পর্যন্ত দেননি।

আমার পানে চাহিয়া কহিল, হাঁ গা, বলচি সব সত্যি নয়?

পদ্মা খুশি হইয়া বলিল, তাই তোমাদের ঠিক এক রকম দেখতে। দু’জনেই লম্বা

ছিপছিপে—শুধু তুমি ফর্সা, আর নতুনগোঁসাই কালো, তোমাদের দেখলেই বোঝা যায়।

0 Shares