রাজলক্ষ্মী গম্ভীর হইয়া বলিল, যাবেই ত ভাই। আমাদের ঠিক একরকম না হয়ে কি
কোন উপায় আছে পদ্মা।
ও মা! তুমি আমারও নাম জানো যে দেখচি। নতুনগোঁসাই বলেছে বুঝি?
বলেছে বলেই ত তোমাদের দেখতে এলুম, বললুম, সেখানে একলা যাবে কেন,
আমাকেও সঙ্গে নাও। তোমার কাছে ত আমার ভয় নেই—একসঙ্গে দেখলে কেউ কলঙ্কও
রটাবে না। আর রটালেই বা কি, নীলকণ্ঠর গলাতেই বিষ লেগে থাকবে, উদরস্থ হবে না।
আমি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না, মেয়েদের এ যে কি রকম ঠাট্টা সে তারাই
জানে। রাগিয়া বলিলাম, কেন ছেলেমানুষের সঙ্গে মিথ্যে তামাশা কোরচ বলো ত?
রাজলক্ষ্মী ভালোমানুষের মত বলিল, সত্যি তামাশাটা কি তুমিই না হয় বলে দাও! যা
জানি সরল মনে বলচি, তোমার রাগ কেন?
তাহার গাম্ভীর্য দেখিয়া রাগিয়াও হাসিয়া ফেলিলাম,—সরল মনে বলচি! কমললতা,
এত বড় শয়তান ফাজিল তুমি সংসারে দুটি খুঁজে পাবে না। এর কি একটা মতলব আছে,
কখনো এর কথায় সহজে বিশ্বাস ক’রো না।
রাজলক্ষ্মী কহিল, কেন নিন্দে কর গোঁসাই। তা হ’লে আমার সম্বন্ধে নিশ্চয় তোমার
মনেই কোন মতলব আছে?
আছেই ত।
কিন্তু আমার নেই। আমি নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক।
হাঁ, যুধিষ্ঠির!
কমললতাও হাসিল, কিন্তু সে উহার বলার ভঙ্গিতে। বোধ হয়, ঠিক কিছু বুঝিতে পারিল
না, শুধু গোলমালে পড়িল। কারণ সেদিনও আমি ত কোন রমণীর সম্বন্ধেই নিজের কোন
আভাস দিই নাই। আর দিবই বা কি করিয়া। দিবার সেদিন ছিলই বা কি!
কমললতা জিজ্ঞাসা করিল, ভাই তোমার নামটা কি?
আমার নাম রাজলক্ষ্মী। উনি গোড়ার কথাটা ছেড়ে দিয়ে বলেন শুধু লক্ষ্মী। আমি বলি,
ওগো, হাঁগো। আজকাল বলচেন নতুনগোঁসাই বলে ডাকতে। বলেন, তবু স্বস্তি পাবো।
পদ্মা হঠাৎ হাততালি দিয়া উঠিল—আমি বুঝেচি।
কমললতা তাহাকে ধমক দিল—পোড়ারমুখীর ভারী বুদ্ধি! কি বুঝেচিস্ বল্ ত?
নিশ্চয় বুঝেচি। বলব?
বলতে হবে না, যা। বলিয়াই সে সস্নেহে রাজলক্ষ্মীর একটা হাত ধরিয়া কহিল, কিন্তু
কথায় কথায় বেলা বাড়ছে ভাই, রোদ্দুরে মুখখানি শুকিয়ে উঠেচে। খেয়ে কিছু আসোনি
জানি—চল, হাত-পা ধুয়ে ঠাকুর প্রণাম করবে, তারপরে সবাই মিলে তাঁর প্রসাদ পাব।
তুমিও এসো গোঁসাই। এই বলিয়া সে তাহাকে মন্দিরের দিকে টানিয়া লইয়া গেল।
এইবার মনে মনে প্রমাদ গণিলাম। কারণ, এখন আসিবে প্রসাদ গ্রহণের আহ্বান।খাওয়া-
ছোঁওয়ার বিষয়টা রাজলক্ষ্মীর জীবনে এমন করিয়াই গাঁথা যে, এ সম্বন্ধে সত্যাসত্যর প্রশ্নই
অবৈধ। এ শুধু বিশ্বাস নয়—এ তাহার স্বভাব। এছাড়া সে বাঁচে না। জীবনের এই একান্ত
প্রয়োজনের সহজ ও সক্রিয় সজীবতা কতদিন কত সঙ্কট হইতে তাহাকে রক্ষা করিয়াছে
সে কথা কাহারো জানিবার উপায় নাই। নিজে সে বলিবে না—জানিয়াও লাভ নাই। আমি
শুধু জানি, যে রাজলক্ষ্মীকে একদিন না চাহিয়াই দৈবাৎ পাইয়াছি, আজ সে আমার সকল
পাওয়ার বড়। কিন্তু সে কথা এখন থাক।
তাহার যতকিছু কঠোরতা সে কেবল নিজেকে লইয়া, অথচ অপরের প্রতি জুলুম ছিল
না। বরঞ্চ হাসিয়া বলিত, কাজ কি বাপু অত কষ্ট করার! একালে অত বাছতে গেলে
মানুষের প্রাণ বাঁচে না। আমি যে কিছুই মানি না সে জানে। শুধু তাহার চোখের উপর
ভয়ঙ্কর একটা-কিছু না ঘটিলেই সে খুশি। আমার পরোক্ষ অনাচারের কাহিনীতে কখনো বা
সে দুই কান চাপা দিয়া আত্মরক্ষা করে, কখনো বা গালে হাত দিয়া অবাক হইয়া বলে,
আমার অদৃষ্টে কেন তুমি এমন হ’লে! তোমাকে নিয়ে আমার যে সব গেল!
কিন্তু আজিকার ব্যাপারটা ঠিক এরূপ নয়। এই নির্জন মঠে যে-কয়টি প্রাণী শান্তিতে
বাস করে তাহারা দীক্ষিত বৈষ্ণব-ধর্মাবলম্বী। ইহাদের জাতিভেদ নাই, পূর্বাশ্রমের কথা
ইহারা কেহ মনেও করে না। তাই অতিথি কেহ আসিলে ঠাকুরের প্রসাদ নিঃসঙ্কোচে-শ্রদ্ধায়
বিতরণ করা এবং প্রত্যাখ্যান করিয়াও আজো কেহ ইহাদের অপমানিত করে নাই। কিন্তু
এই অপ্রীতিকর কার্যই আজ যদি অনাহূত আসিয়া আমাদের দ্বারাই সংঘটিত হয় ত
পরিতাপের অবধি রহিবে না। বিশেষ করিয়া আমার নিজের। জানি, কমললতা মুখে কিছুই
বলিবে না, তাহাকে বলিতেও দিবে না—হয়ত বা শুদ্ধমাত্র একটিবার আমার প্রতি চাহিয়াই
মাথা নিচু করিয়া অন্যত্র সরিয়া যাইবে। এই নির্বাক অভিযোগের জবাব যে কি, এইখানে
দাঁড়াইয়া মনে মনে আমি ইহাই ভাবিতেছিলাম।
এমনি সময়ে পদ্মা আসিয়া বলিল, এসো নতুনগোঁসাই, দিদিরা তোমাকে ডাকচে। হাতমুখ ধুয়েছো?
না।
তবে এস আমি জল দিই। প্রসাদ দেওয়া হচ্চে।
প্রসাদটা কি হ’লো আজ?
আজ হ’লো ঠাকুরের অন্নভোগ।
মনে মনে বলিলাম, তবে ত সংবাদ আরও ভালো। জিজ্ঞাসা করিলাম, প্রসাদ কোথায় দিলে?
পদ্মা বলিল, ঠাকুরঘরের বারান্দায়। বাবাজীমশায়ের সঙ্গে তুমি বসবে, আমরা মেয়েরা খাব পরে। আজ আমাদের পরিবেশন করবে রাজলক্ষ্মীদিদি নিজে।
সে খাবে না?
না। সে ত আমাদের মত বোষ্টম নয়—বামুনের মেয়ে। আমাদের ছোঁয়া খেলে তার পাপ হয়।
তোমার কমললতাদিদি রাগ করলে না?
রাগ করবে কেন, বরঞ্চ হাসতে লাগল। রাজলক্ষ্মীদিদিকে বললে, পরজন্মে আমরা দু’বোনে গিয়ে জন্মাব এক মায়ের পেটে। আমি জন্মাব আগে, আর তুমি আসবে পরে। তখন মায়ের হাতে দু’বোনে একপাতায় বসে খাব। তখন কিন্তু জাত যাবে বললে মা তোমার কান মলে দেবে।
শুনিয়া খুশি হইয়া ভাবিলাম, এইবার ঠিক হইয়াছে। রাজলক্ষ্মী কখনো কথায় তাহার সমকক্ষ পায় নাই।
জিজ্ঞাসা করিলাম, কি জবাব দিলে সে?
পদ্মা কহিল, রাজলক্ষ্মীদিদিও শুনে হাসতে লাগল, বললে, মা কেন দিদি, তখন বড় বোন হয়ে তুমিই দেবে আমার কান মলে, ছোটর আস্পর্ধা কিছুতেই সইবে না।
প্রত্যুত্তর শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলাম, শুধু প্রার্থনা করিলাম ইহার নিহিত অর্থ কমললতা যেন না বুঝিতে পারিয়া থাকে।