শ্রীকান্ত – চতুর্থ পর্ব

গিয়া দেখিলাম প্রার্থনা আমার মঞ্জুর হইয়াছে, কমললতা সে কথায় কান দেয় নাই। বরঞ্চ এই অমিলটুকু মানিয়া লইয়াই ইতিমধ্যে দু’জনের ভারি একটি মিল হইয়া গেছে।

বিকালের গাড়িতে বড়গোঁসাই দ্বারিকাদাস ফিরিয়া আসিলেন, তাঁহার সঙ্গে আসিল আরও জনকয়েক বাবাজী। সর্বাঙ্গের ছাপছোপের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য দেখিয়া সন্দেহ রহিল না যে ইহারাও অবহেলার নয়। আমাকে দেখিয়া বড়গোঁসাই খুশি হইলেন, কিন্তু পার্ষদগণ গ্রাহ্য করিল না। না করিবারই কথা, কারণ, শুনা গেল—ইহাদের একজন নামজাদা কীর্তনীয়া এবং আর একজন মৃদঙ্গের ওস্তাদ।

প্রসাদ পাওয়া সমাপ্ত করিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। সেই মরা নদী ও সেই বনবাদাড়। বেণু ও বেতসকুঞ্জ চারিদিকে —গায়ের চামড়া বাঁচান দায়। আসন্ন সূর্যাস্তকালে তটপ্রান্তে বসিয়া কিঞ্চিৎ প্রকৃতির শোভা নিরীক্ষণ করিব সঙ্কল্প করিলাম, কিন্তু কাছাকাছি কোথাও বোধ করি কচুজাতীয় ‘আঁধারমানিক’ ফুল ফুটিয়াছে। তাহার বীভৎস মাংসপচা গন্ধে তিষ্ঠতে দিল না। মনে মনে ভাবিলাম, কবিরা ফুল এত ভালবাসেন, কেহ এটাকে লইয়া গিয়া তাঁহাদের উপহার দিয়া আসে না কেন?

সন্ধ্যার প্রাক্কালে প্রত্যাবর্তন করিলাম, গিয়া দেখি, সেখানে সমারোহ ব্যাপার। ঠাকুর ও ঠাকুরঘর সাজান হইতেছে, আরতির পরে কীর্তনের বৈঠক বসিবে।

পদ্মা কহিল, নতুনগোঁসাই, কীর্তন শুনতে তুমি ভালোবাস, আজ মনোহর দাস বাবাজীর গান শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। কি চমৎকার!

বস্তুতঃ বৈষ্ণব কবিদের পদাবলীর মত মধুর বস্তু আমার আর নাই, বলিলাম, সত্যিই বড় ভালোবাসি পদ্মা। ছেলেবেলায় দু-চার ক্রোশের মধ্যে কোথাও কীর্তন হবে শুনলে আমি ছুটে যেতাম, কিছুতে ঘরে থাকতে পারতাম না। বুঝি-না-বুঝি তবু শেষ পর্যন্ত বসে থাকতাম। কমললতা, তুমি গাইবে না আজ?

কমললতা বলিল, না গোঁসাই, আজ না। আমার ত তেমন শিক্ষা নেই, ওঁদের সামনে গাইতে লজ্জা করে। তা ছাড়া সেই অসুখটা থেকে গলা তেমনই ধরে আছে, এখনো সারেনি।

বলিলাম, লক্ষ্মী কিন্তু তোমার গান শুনতেই এসেচে। ও ভাবে আমি বুঝি বাড়িয়ে বলেছি।

কমললতা সলজ্জে কহিল, বাড়িয়ে নিশ্চয়ই বলেছো গোঁসাই। তারপরে স্মিতহাস্যে রাজলক্ষ্মীকে বলিল, তুমি কিছু মনে ক’রো না ভাই, সামান্য যা জানি তোমাকে আর একদিন শোনাব।

রাজলক্ষ্মী প্রসন্নমুখে কহিল, আচ্ছা দিদি, তোমার যেদিন ইচ্ছে হবে আমাকে ডেকে পাঠিয়ো, আমি নিজে এসে তোমার গান শুনে যাব। আমাকে বলিল, তুমি কীর্তন শুনতে এত ভালোবাস, কই আমাকে ত সে কথা কখনো বলোনি?

উত্তর দিলাম, কেন বোলব তোমাকে? গঙ্গামাটিতে অসুখে যখন শয্যাগত, দুপুরবেলাটা কাটত শুকনো শূন্য মাঠের পানে চেয়ে, দুর্ভর সন্ধ্যা কিছুতে একলা কাটতে চাইত না—

রাজলক্ষ্মী চট করিয়া আমার মুখে হাত চাপা দিয়া ফেলিল, কহিল, আর যদি বলো পায়ে মাথা খুঁড়ে মরব। তারপর নিজেই অপ্রতিভ হইয়া হাত সরাইয়া বলিল, কমললতাদিদি, বলে এসো ত ভাই তোমার বড়গোঁসাইজীকে, আজ বাবাজীমশায়ের কীর্তনের পরে আমি ঠাকুরদের গান শোনাব।

কমললতা সন্দিগ্ধকণ্ঠে বলিল, কিন্তু বাবাজীরা বড় খুঁতখুঁতে ভাই।

রাজলক্ষ্মী কহিল, তা হোক গে, ভগবানের নাম ত হবে। বিগ্রহমূর্তিগুলিকে হাত দিয়া দেখাইয়া হাসিয়া বলিল, ওঁরা হয়ত খুশি হবেন, বাবাজীদের জন্যেও তত ভাবিনে দিদি, কিন্তু আমার এই দুর্বাসা ঠাকুরটি প্রসন্ন হলে বাঁচি।

বলিলাম, হ’লে কিন্তু বকশিশ পাবে।

রাজলক্ষ্মী সভয়ে বলিল, রক্ষে করো গোঁসাই, সকলের সম্মুখে যেন বকশিশ দিতে এসো না। তোমার অসাধ্য কাজ নেই।

শুনিয়া বৈষ্ণবীরা হাসিতে লাগিল, পদ্মা খুশি হইলেই হাততালি দেয়, বলিল, আ—মি—বু—ঝে—চি।

কমললতা তাহার প্রতি সস্নেহে চাহিয়া সহাস্যে কহিল, দূর হ পোড়ামুখী—চুপ কর। রাজলক্ষ্মীকে কহিল, নিয়ে যাও ত ভাই ওকে, কি জানি হঠাৎ কি একটা বলে বসবে।

ঠাকুরের সন্ধ্যারতির পরে কীর্তনের আসর বসিল। আজ আলো জ্বলিল অনেকগুলা। মুরারিপুর আখড়া বৈষ্ণবসমাজে নিতান্ত অখ্যাত নয়, নানা স্থান হইতে কীর্তনীয়া বৈরাগীর দল আসিয়া জুটিলে এরূপ আয়োজন প্রায়ই হয়। মঠে সর্বপ্রকার বাদ্যযন্ত্রই মজুত আছে, দেখিলাম সেগুলা হাজির করা হইয়াছে। একদিকে বসিয়া বৈষ্ণবীগণ—সকলেই পরিচিত, অন্যদিকে উপবিষ্ট অজ্ঞাতকুলশীল অনেকগুলি বৈরাগী মূর্তি—নানা বয়স ও নানা চেহারার। মাঝখানে সমাসীন বিখ্যাত মনোহর দাস ও তাঁহার মদৃঙ্গবাদক। আমার ঘরের অধুনা দখলীকার একজন ছোকরা বাবাজী দিতেছে হারমোনিয়ামে সুর। এটা প্রচার হইয়াছে যে, কে একজন সম্ভ্রান্তগৃহের মহিলা আসিয়াছেন কলিকাতা হইতে—তিনিই গাহিবেন গান। তিনি যুবতী, তিনি রূপসী, তিনি বিত্তশালিনী। তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছে দাসদাসী, আসিয়াছে বহুবিধ খাদ্যসম্ভার, আর আসিয়াছে কে এক নতুনগোঁসাই—সে নাকি এই দেশেরই এক ভবঘুরে।

মনোহর দাসের কীর্তনের ভূমিকা ও গৌরচন্দ্রিকার মাঝামাঝি একসময়ে রাজলক্ষ্মী আসিয়া কমললতার কাছে বসিল। হঠাৎ বাবাজীমশায়ের গলাটা একটু কাঁপিয়াই সামলাইয়া গেল এবং মৃদঙ্গের বোলটা যে কাটিল না সে নিতান্তই একটা দৈবাতের লীলা। শুধু দ্বারিকাদাস দেয়ালে ঠেস দিয়া যেমন চোখ বুজিয়া ছিলেন তেমনি রহিলেন, কি জানি, হয়ত জানিতেই পারিলেন না কে আসিল আর কে আসিল না।

রাজলক্ষ্মী পরিয়া আসিয়াছে একখানা নীলাম্বরী শাড়ি, তাহারি সরু জরির পাড়ের সঙ্গে এক হইয়া মিশিয়াছে গায়ের নীল রঙের জামা। আর সব তেমনি আছে। কেবল সকালের উড়েপাণ্ডার পরিকল্পিত কপালের ছাপছোপ এবেলা অনেকখানি মুছিয়াছে—অবশিষ্ট যা আছে সে যেন আশ্বিনের ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ, নীল আকাশে কখন মিলাইল বলিয়া। অতি শিষ্টশান্ত মানুষ, আমার প্রতি কটাক্ষেও চাহিল না—যেন চেনেই না। তবু যে কেন একটুখানি হাসি চাপিয়া লইল, সে সেই জানে। কিংবা আমারও ভুল হইতে পারে—অসম্ভব নয়।

0 Shares