শ্রীকান্ত – চতুর্থ পর্ব

আমি এ আশঙ্কা করি নাই, নিরুত্তরে শুনিতে লাগিলাম।

মনে হইল রতন কিছুদিন হইতেই ক্রোধে ও ক্ষোভে ফুলিতেছে। কহিল, মা যখন দেন দু’হাতে ঢেলে দেন। বঙ্কুকেও দিয়েচেন। তাই ও ভেবেচে নেঙড়ানো মৌচাকের আর দাম কি, বড়জোর এখন জ্বালানোই চলে। তাই ওর এত অগ্রাহ্য। মুখ্যু জানে না যে, আজও মায়ের একখানা গয়না বিক্রি করলে অমন পাঁচখানা বাড়ি তৈরি হয়।

আমিও জানিতাম না। হাসিয়া বলিলাম, তাই নাকি ? কিন্তু সে-সব আছে কোথায়?

রতন হাসিল, কহিল, আছে তাঁরই কাছে। মা অত বোকা নন। এক আপনার পায়েই সমস্ত উজোড় করে দিয়ে তিনি ভিখিরী হতে পারেন, কিন্তু আর কারও জন্যে নয়। বঙ্কু জানে না যে, আপনি বেঁচে থাকতে মায়ের আশ্রয়ের অভাব নেই, আর রতন বেঁচে থাকতে তাঁর চাকরের ভাবনা হবে না। সেদিন কাশী থেকে আপনার অমনি করে চলে আসা যে মা’র বুকে কি শেল বিঁধেচে, বঙ্কুবাবু তার কি খবর রাখে ? গুরুঠাকুরই বা তার সন্ধান পাবে কোথায় ?

কিন্তু আমাকে যে তিনি নিজেই বিদায় করেচেন, এ খবর ত তুমি জান রতন?

রতন জিভ কাটিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল। এতটা বিনয় কখনো তাহার পূর্বে দেখি নাই। বলিল, আমরা চাকরবাকর বাবু, এসব কথা আমাদের কানেও শুনতে নাই। ও মিথ্যে।

রতন আড়মোড়া ভাঙ্গিয়া একটু গড়াইয়া লইতে প্রস্থান করিল। বোধ করি কাল আটটার পূর্বে আর তার দেহটা ‘ধাতে’ আসিবে না।

দুটো বড় খবর পাওয়া গেল। একটা এই যে, বঙ্কু বড় হইয়াছে। পাটনায় যখন তাহাকে প্রথম দেখি তখন বয়স তাহার ষোল-সতেরো। এখন একুশ বৎসরের যুবক। উপরন্তু এই পাঁচ-ছয় বৎসরের ব্যবধানে সে লেখাপড়া শিখিয়া মানুষ হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং শৈশবের এই সকৃতজ্ঞ স্নেহ যদি আজ যৌবনের আত্মসম্মানবোধে সামঞ্জস্য রাখিতে না পারে, বিস্ময়ের কি আছে?

দ্বিতীয় সংবাদ—না বঙ্কু, না গুরুদেব, রাজলক্ষ্মীর গভীরতম বেদনার কোনও সন্ধান আজও তাঁহাদের জানা নাই।

মনের মধ্যে এই কথা-দুটাই বহুক্ষণ ধরিয়া নড়িয়া বেড়াইতে লাগিল।

সযত্ন-অঙ্কিত শিলমোহরের গালার ছাপগুলো দেখিয়া লইয়া চিঠি খুলিলাম।

তাহার হাতের লেখা বেশি দেখিবার সুযোগ ঘটে নাই, কিন্তু স্মরণ হইল হস্তাক্ষর দুষ্পাঠ্য না হইলেও ভাল নয়। কিন্তু এই পত্রখানি সে অত্যন্ত সাবধানে লিখিয়াছে, বোধ হয়, তাহার ভয়, বিরক্ত হইয়া আমি না ফেলিয়া রাখি। যেন আগাগোড়া সবটুকুই সহজে পড়িতে পারি।

আচার-আচরণে রাজলক্ষ্মী সে যুগের মানুষ। প্রণয়-নিবেদন আতিশয্য ত দূরের কথা, ‘ভালবাসি’ এমন কথাও কখনো সুমুখে উচ্চারণ করিয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না। সে লিখিয়াছে চিঠি—আমার প্রার্থনার অনুকূলে অনুমতি দিয়া। তবু কি-জানি কি আছে, পড়িতে কেমন যেন ভয়-ভয় করিতে লাগিল। তাহার বাল্যকালের কথা মনে পড়িল। সেদিন তাহার পড়াশুনা সাঙ্গ হইয়াছিল গুরুমহাশয়ের পাঠশালায়। পরবর্তীকালে ঘরে বসিয়া হয়ত সামান্য কিছু বিদ্যাচর্চা করিয়া থাকিবে। অতএব, ভাষার ইন্দ্রজাল, শব্দের ঝঙ্কার, পদবিন্যাসের মাধুরী তাহার পত্রের মধ্যে আশা করা অন্যায়। সর্বদা প্রচলিত সামান্য গোটাকয়েক কথায় মনের ভাব ব্যক্ত করা ছাড়া আর সে কি করিবে? একটা অনুমতি দিয়া মামুলি শুভকামনা করিয়া দু ছত্র লেখা—এই ত? কিন্তু খাম খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিয়া কিছুক্ষণের জন্য বাহিরের কিছুই আর মনে রহিল না। পত্র দীর্ঘ নয়, কিন্তু ভাষা ও ভঙ্গি যত সহজ ও সরল ভাবিয়াছিলাম তাহাও নয়। আমার আবেদনের উত্তর সে এইরূপ দিয়াছে—

৺কাশীধাম

প্রণামান্তে সেবিকার নিবেদন—

তোমার চিঠিখানা এইবার নিয়ে এক শ’ বার পড়লুম। তবু ভেবে পেলুম না তুমি ক্ষেপেচ না আমি ক্ষেপেচি। ভেবেচো, বুঝি হঠাৎ তোমাকে আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলুম? কুড়িয়ে তোমাকে পাইনি, পেয়েছিলুম অনেক তপস্যায়, অনেক আরাধনায়। তাই, বিদায় দেবার কর্তা তুমি নও, আমাকে ত্যাগ করার মালিকানা স্বত্বাধিকার তোমার হাতে নেই।

ফুলের বদলে বন থেকে তুলে বঁইচির মালা গেঁথে কোন্‌ শৈশবে তোমাকে বরণ করেছিলুম সে তোমার মনে নেই। কাঁটায় হাত বয়ে রক্ত ঝরে পড়তো, রাঙ্গামালার সে রাঙ্গা-রং তুমি চিনতে পারনি, বালিকার পূজার অর্ঘ্য সেদিন তোমার গলায় তোমার বুকের ‘পরে রক্তরেখায় যে লেখা এঁকে দিত সে তোমার চোখে পড়েনি, কিন্তু যাঁর চোখে সংসারের কিছুই বাদ পড়ে না আমার সে নিবেদন তাঁর পাদপদ্মে গিয়ে পৌঁছেছিল।

তার পরে এলো দুর্যোগের রাত, কালো মেঘে দিলে আমার আকাশের জ্যোৎস্না ঢেকে। কিন্তু সে সত্যিই আমি না আর কেউ, এ জীবনে যথার্থই ও-সব ঘটেছিল, না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেচি, ভাবতে গিয়ে অনেক সময়ে ভয় হয় বুঝি-বা আমি পাগল হয়ে যাব। তখন সমস্ত ভুলে যাঁকে ধ্যান করতে বসি তাঁর নাম বলা চলে না। কাউকে বলতেও নেই। তাঁর ক্ষমাই আমার জগদীশ্বরের ক্ষমা। এতে ভুল নেই, সন্দেহ নেই, এখানে আমি নির্ভয়।

হাঁ, বলছিলুম, তার পরে, এলো আমার দুর্দিনের রাত্রি, কলঙ্কে দিলে দু’চোখের সকল আলো নিবিয়ে। কিন্তু সেই কি মানুষের সমস্ত পরিচয়? সেই অখণ্ড গ্লানির নিরবকাশ আবরণের বাইরে তার কি আর কিছুই বাকী নেই?

আছে। অব্যাহত অপরাধের মাঝে মাঝে তাকে আমি বার বার দেখতে পেয়েচি। তাই যদি না হ’তো, বিগত দিনের রাক্ষসটা যদি আমার অনাগতর সমস্ত মঙ্গলকে নিঃশেষে গিলে খেতো, তবে তোমাকে ফিরে পেতুম কি করে? আমার হাতে এনে আবার তোমাকে দিয়ে যেতো কে?

আমার চেয়ে তুমি চার-পাঁচ বছরের বড়, তবু তোমাকে যা মানায় আমাকে তা সাজে না। বাঙ্গালী-ঘরের মেয়ে আমি, জীবনের সাতাশটা বছর পার করে দিয়ে আজ যৌবনের দাবি আর করিনে। আমাকে তুমি ভুল বুঝো না—যত অধমই হই, ও-কথা যদি ঘুণাক্ষরেও তোমার মনে আসে তার বাড়া লজ্জা আমার নেই। বঙ্কু বেঁচে থাক, সে বড় হয়েছে, তার বৌ এসেছে—তোমার বিয়ের পরে তাদের সুমুখে বার হবো আমি কোন্‌ মুখে? এ অসম্মান সইব কি করে?

0 Shares