শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

পরিচ্ছেদ – পাঁচ

সাধুজী ত স্বচ্ছন্দে চলিয়া গেলেন। তাঁহার বিরহব্যথাটা রতনের কিরূপ বাজিল অবশ্য জিজ্ঞাসা করা হয় নাই, সম্ভবতঃ মারাত্মক তেমন কিছু হইবে না; কিন্তু একজন ত দেখিলাম কাঁদিয়া গিয়া ঘরে ঢুকিলেন এবং তৃতীয় ব্যক্তি রহিলাম আমি। লোকটার সহিত পুরাপুরি চব্বিশ ঘণ্টাও ঘনিষ্ঠতা হইতে পায় নাই; তথাপি আমারও মনে হইতে লাগিল, আমাদের এই অনারব্ধ সংসারের মাঝখানে তিনি যেন মস্ত বড় একটা ছিদ্র করিয়া দিয়া গেলেন। এই অনিষ্টটি আপনা হইতেই সারিয়া উঠিবে কিংবা নিজেই তিনি আবার একদিন অকস্মাৎ তাঁহার প্রচন্ড ঔষধের বাক্সটা ঘাড়ে করিয়া ইহা মেরামত করিতে সশরীরে ফিরিয়া আসিবেন, বিদায়কালে কিছুই বলিয়া গেলেন না। অথচ আমার নিজের খুব যে বেশি উদ্বেগ ছিল তাও নয়। নানা কারণে এবং বিশেষ করিয়া কিছুকাল হইতে জ্বরে ভুগিয়া দেহ ও মনের এমনই একটা নিস্তেজ নিরালম্ব ভাব আসিয়া পড়িয়াছিল যে, একমাত্র রাজলক্ষ্মীর হাতেই সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণ করিয়া সংসারের যাবতীয় ভাল-মন্দর দায় হইতে অব্যাহতি লইয়াছিলাম। সুতরাং কিছুর জন্যই স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করিবার আমার আবশ্যকও ছিল না, শক্তিও ছিল না। তবুও মানুষের মনের চঞ্চলতার যেন বিরাম নাই। বাহিরের ঘরে একটা তাকিয়া ঠেস দিয়া একাকী বসিয়া আছি, কত কি যে এলোমেলো ভাবনা আনাগোনা করিতেছে তাহার সংখ্যা নাই, সম্মুখের প্রাঙ্গণতলে আলোর দীপ্তি ধীরে ধীরে ম্লান হইয়া আসন্ন রাত্রির ইঙ্গিতে অন্যমনস্ক মনটাকে মাঝে মাঝে এক-একটা চমক দিয়া যাইতেছে, মনে হইতেছে এ জীবনে যত রাত্রি আসিয়াছে গিয়াছে তাহাদের সহিত আজিকার এই অনাগত নিশার অপরিজ্ঞাত মূর্তি যেন কোন অদৃষ্টপূর্ব নারীর অবগুণ্ঠিতা মুখের মত রহস্যময়। অথচ, এই অপরিচিতার কেমন প্রকৃতি কেমন প্রথা কিছুই না জানিয়া একেবারে ইহার শেষ পর্যন্ত পৌঁছিতেই হইবে, মধ্যপথে আর ইহার কোন বিচারই চলিবে না। আবার পরক্ষণেই যেন অক্ষম চিন্তার সমস্ত শৃঙ্খলই এক নিমিষে ভাঙ্গিয়া বিপর্যস্ত হইয়া যাইতেছে। এমনি যখন মনের অবস্থা, সেই সময় পাশের দ্বারটা খুলিয়া রাজলক্ষ্মী প্রবেশ করিল। তাহার চোখ-দুটো সামান্য একটু রাঙ্গা, একটু যেন ফুলা-ফুলা। ধীরে ধীরে আমার কাছে আসিয়া বসিয়া বলিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

কহিলাম, আশ্চর্য কি! যে ভার, যে শ্রান্তি তুমি বয়ে বেড়াচ্চ, আর কেউ হলে ত ভেঙ্গেই পড়ত, আর আমি হলে ত দিনরাতের মধ্যে চোখ খুলতেই পারতুম না, কুম্ভকর্ণের নিদ্রা দিতুম।

রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিল, কিন্তু কুম্ভকর্ণের ম্যালেরিয়া ছিল না। যাই হোক তুমি ত দিনের বেলায় ঘুমোও নি?

বলিলাম, না, কিন্তু এখন ঘুম পাচ্চে, হয়ত একটু ঘুমোব। কারণ, কুম্ভকর্ণের যে ম্যালেরিয়া ছিল না এমন কথাও বাল্মীকি মুনি কোথাও লিখে যাননি।

সে ব্যস্ত হইয়া বলিল, ঘুমোবে এই অবেলায়! রক্ষে কর তুমি, জ্বর কি তা হলে আর কোথাও বাকি থাকবে? সে-সব হবে না,—আচ্ছা, যাবার সময় আনন্দ কি আর কিছু তোমাকে বলে গেল?

প্রশ্ন করিলাম, কি রকম কথা তুমি আশা কর?

রাজলক্ষ্মী কহিল, এই যেমন কোথায় কোথায় যাবে; কিংবা—

এই কিংবাটাই আসল প্রশ্ন। কহিলাম, কোথায় কোথায় যাবেন তার একপ্রকার আভাস দিয়ে গেছেন, কিন্তু এই কিংবাটার সম্বন্ধে কিছুই বলে যাননি। আমি ত তাঁর ফিরে আসার বিশেষ কোন সম্ভাবনা দেখিনে।

রাজলক্ষ্মী চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু আমি কৌতূহল সংবরণ করিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা এই লোকটিকে কি তুমি বাস্তবিক চিনেচ? আমাকে যেমন একদিন চিনতে পেরেছিলে?

সে আমার মুখের পানে ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, না।

কহিলাম, সত্যি বল, কখনো কোনদিন কি দেখনি?

এবার রাজলক্ষ্মী হাসিমুখে বলিল, তোমার কাছে আমি সত্য করতে পারব না। অনেক সময় আমার বড় ভুল হয়। তখন অপরিচিত লোককেই মনে হয় কোথায় যেন তাকে দেখেচি, তার মুখ যেন আমার অত্যন্ত চেনা, কেবল কোথায় দেখেচি সেইটিই মনে করতে পারিনে। আনন্দকেও হয়ত কখনো দেখে থাকব।

কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আজ আনন্দ চলে গেল বটে, কিন্তু যদি সে কখনো ফিরে আসে ত তার বাপ-মায়ের কাছে আবার একদিন তাকে ফিরিয়ে দেব এ তোমাকে আমি নিশ্চয় বলচি।

আমি বলিলাম, তাতে তোমার গরজ কি?

সে কহিল, অমন ছেলে চিরদিন ভেসে বেড়াবে একথা ভাবলেও যেন আমার বুকে শূল বেঁধে। আচ্ছা, তুমি নিজেও ত সংসার ছেড়েছিলে—সন্ন্যাসী হওয়ার মধ্যে কি সত্যিকার আনন্দ কিছু আছে?

কহিলাম, আমি সত্যিকার সন্ন্যাসী হইনি, তাই ওর ভেতরকার সত্যি খবরটি তোমাকে দিতে পারব না। যদি কোনদিন সে ফিরে আসে এ সংবাদ তাকেই জিজ্ঞাসা কোরো।

রাজলক্ষ্মী প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, বাড়িতে থেকে কি ধর্মলাভ হয় না? সংসার না ছাড়লে কি ভগবান পাওয়া যায় না?

প্রশ্ন শুনিয়া আমি করজোড়ে বলিলাম, এর কোনটার জন্যেই আমি ব্যাকুল নই লক্ষ্মী, এ-সব ঘোরতর প্রশ্ন আমাকে তুমি কোরো না, আবার আমার জ্বর আসতে পারে।

রাজলক্ষ্মী হাসিল, তারপর করুণকণ্ঠে কহিল, কিন্তু মনে হয় সংসারে আনন্দর ত সমস্তই আছে, তবু সে ধর্মের জন্য এই বয়সেই সব ছেড়ে দিয়ে এসেচে; কিন্তু তুমি ত তা পারনি?

বলিলাম, না, এবং ভবিষ্যতেও পারব মনে হয় না।

রাজলক্ষ্মী কহিল, কেন মনে হয় না?

কহিলাম, তার প্রধান কারণ যাকে ছাড়তে হবে সেই সংসারটা যে আমার কোথায় এবং কি প্রকার তা আমার জানা নেই, এবং যার জন্যে ছাড়তে হবে সেই পরমাত্মার প্রতিও আমার লেশমাত্র লোভ নেই। এতদিন তাঁর অভাবেই কেটে গেছে এবং বাকি ক’টা দিনও অচল হয়ে থাকবে না এই আমার ভরসা। অন্যপক্ষে তোমার ঐ আনন্দভায়াটিও গেরুয়া সত্ত্বেও যে ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্যেই বেরিয়ে এসেচেন আমার তা বিশ্বাস নয়। তার কারণ, আমিও বারকয়েক সাধু-সঙ্গ করেচি, তাঁদের কেউ আজও ওষুধের বাক্স ঘাড়ে করে বেড়ানকে ভগবৎলাভের উপায় নির্দেশ করে দেননি। তা ছাড়া তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটাও ত চোখে দেখলে!

0 Shares