শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

আমি সম্মত হইলাম, রাজলক্ষ্মী নিজেও একটু হাসিয়া সানাইয়ের শব্দটা আন্দাজ করিয়া বলিল, ওই বুঝি তোমার বাড়ি মধু? আচ্ছা, যদি সময় পাই ত আমিও গিয়ে একবার দেখে আসব। রতনের প্রতি চাহিয়া কহিল, বড় তোরঙ্গটা খুলে দেখ ত রে, আমার নতুন শাড়িগুলো আনা হয়েচে কি না। যা মেয়েটিকে একখানা দিয়ে আয়। মিষ্টি বুঝি এদেশে কিছু পাওয়া যায় না? বাতাসা মেলে? আচ্ছা, তাই বেশ। অমনি তাও কিছু কিনে দিয়ে আসিস রতন। হাঁ মধু, তোমার মেয়ের বয়স কত? পাত্তরের বাড়ি কোথায়? লোক কতগুলি খাবে? এ গাঁয়ে ক’ঘর তোমরা আছ?

জমিদারগৃহিণীর একসঙ্গে এতগুলি প্রশ্নের উত্তরে মধু সসম্ভ্রমে এবং সবিনয়ে যাহা কহিল তাহাতে বুঝা গেল তাহার কন্যার বয়স বছর-নয়েকের মধ্যেই, পাত্র যুবাপুরুষ—ত্রিশ-চল্লিশের বেশি হইবে না—বাড়ি ক্রোশ-পাঁচেক উত্তরে কি একটা গ্রামে—সে একটা তাহাদের বড় সমাজ, সেখানে জাতীয় ব্যবসা কেহ করে না—সকলেরই চাষবাস পেশা—মেয়ে বেশ সুখেই থাকিবে, তবে ভয় শুধু এই রাত্রিটার জন্য। কারণ বরযাত্রীর সংখ্যা কত হইবে এবং তাহারা কোথায় কি ফ্যাসাদ বাধাইয়া দিবে, তাহা আজ প্রভাত না হওয়া পর্যন্ত কোনমতেই অনুমান করিবার জো নাই। তাহারা সকলেই সমৃদ্ধ ব্যক্তি; কি করিয়া যে মানমর্যাদা বজায় রাখিয়া শুভকর্ম সম্পন্ন হইবে এই ভয়েই মধু কাঁটা হইয়া আছে। এই-সকল সবিস্তারে নিবেদন করিয়া সে পরিশেষে সকাতরে জানাইল যে, তাহার চিঁড়া গুড় এবং দধি সংগ্রহ হইয়াছে, এমন কি শেষকালে খান-দুই করিয়া বড় বাতাসাও পাতে দিতে পারিবে; কিন্তু তথাপি যদি কোন গোলযোগ হয় ত তাহাদের রক্ষা করিতে হইবে।

রাজলক্ষ্মী সকৌতুকে ভরসা দিয়া কহিল, গোলযোগ কিছু হবে না মধু, তোমার মেয়ের বিয়ে নির্বিঘ্নে হবে, আমি আশীর্বাদ করচি। খাবার জিনিস এত জোগাড় করেচ, তোমার বেয়াইয়ের দল খেয়ে খুশি হয়ে বাড়ি যাবে।

মধু ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া সঙ্গের লোক-দুইটিকে লইয়া প্রস্থান করিল। কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল, এই আশীর্বচনের উপর বরাত দিয়া সে বিশেষ কোন সান্ত্বনা লাভ করিল না; আজ রাত্রির জন্য কন্যার পিতার মনের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ জাগিয়া রহিল।

শুভকর্মে পায়ের ধূলা দিব বলিয়া মধুকে আশা দিয়াছিলাম, কিন্তু সত্য সত্যই যাইতে হইবে এরূপ সম্ভাবনা বোধ করি আমাদের কাহারও মনে ছিল না। সন্ধ্যার কিছু পরে প্রদীপের সম্মুখে বসিয়া রাজলক্ষ্মী তাহার আয়-ব্যয়ের একটা খসড়া পড়িয়া শুনাইতেছিল, আমি বিছানায় শুইয়া মুদ্রিতনেত্রে কতক বা শুনিতেছিলাম, কতক বা শুনিতেছিলাম না, কিন্তু অদূরে বিবাহ বাটীর কলরোল কিছুক্ষণ হইতে যেন কিঞ্চিৎ অসাধারণ রকমের প্রখর হইয়া কানে বাজিতেছিল। সহসা রাজলক্ষ্মী মুখ তুলিয়া সহাস্যে কহিল, ডোমের বাড়ির বিয়ে, মারামারি এর একটা অঙ্গ নয় ত?

বলিলাম, উঁচুজাতের নকল যদি করে থাকে ত বিচিত্র নয়। সে-সব কথা তোমার মনে আছে ত?

রাজলক্ষ্মী কহিল, হুঁ। তারপর ক্ষণকাল কান খাড়া করিয়া থাকিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বাস্তবিক, এ পোড়া দেশে যা ক’রে আমরা মেয়েদের বিলিয়ে দিই, তাতে ইতর-ভদ্র সবাই সমান। ওরা চলে গেলে আমি খোঁজ নিয়ে শুনলাম, ওই যে কাল সকালে ঐ ন’বছরের মেয়েটাকে কোন্‌ অপরিচিত সংসারে টেনে নিয়ে যাবে, আর কখনও হয়ত আসতে পর্যন্ত দেবে না। এদের নিয়মই এই। বাপ ছ’গণ্ডা টাকায় মেয়েটাকে আজ বিক্রি করে দেবে। ‘একবার পাঠিয়ে দাও’ এ কথা মুখে আনবারও জো থাকবে না। আহা! মেয়েটা সেখানে কতই না কাঁদবে—বিয়ের সে কি জানে বল?

এ-সকল দুর্ঘটনা ত জন্মকাল হইতেই দেখিয়া আসিতেছি, একরকম সহিয়াও গিয়াছে, আর ক্ষোভ প্রকাশ করিতে প্রবৃত্তি হয় না। সুতরাং প্রত্যুত্তরে কেবল মৌন হইয়াই রহিলাম।

জবাব না পাইয়া সে কহিল, আমাদের দেশে ছোট-বড় সব জাতের মধ্যেই বিয়েটা কেবল বিয়েই নয়—এটা ধর্ম, তাই যা, নইলে—

ভাবিলাম বলি, একে যদি ধর্ম বলিয়াই বুঝিয়াছ ত এত নালিশ কিসের? আর যে ধর্মকর্মে মন প্রসন্ন না হইয়া গ্লানির ভারে অন্তর কালো হইয়া উঠিতে থাকে তাহাকে ধর্ম বলিয়া গ্রহণ করাই যায় বা কিরূপে?

কিন্তু আমার বলিবার পূর্বেই রাজলক্ষ্মী নিজেই পুনশ্চ কহিল, কিন্তু এ-সব বিধিব্যবস্থা করে গেছেন যাঁরা তাঁরা ছিলেন ত্রিকালদর্শী ঋষি; শাস্ত্রবাক্য মিথ্যাও নয়, অমঙ্গলেরও নয়, আমরা কি-ই বা জানি, আর কতটুকুই বা বুঝি!

ব্যস! যাহা বলিতে চাহিয়াছিলাম তাহা আর বলা হইল না। এ সংসারে যাহা কিছু ভাবিবার বস্তু ছিল, সমস্তই ত্রিকালজ্ঞ ঋষিরা অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিন কালের জন্য বহুপূর্বেই ভাবিয়া স্থির করিয়া দিয়া গিয়াছেন, দুনিয়ায় নূতন করিয়া চিন্তা করিবার কোথাও কিছু বাকি নাই। এ কথা রাজলক্ষ্মীর মুখে এই নূতন শুনিলাম না, আরও অনেকের মুখে অনেকবার শুনিয়াছি এবং বরাবরই চুপ করিয়া গিয়াছি। আমি জানি ইহার জবাব দিতে গেলেই আলোচনাটা প্রথমে উষ্ণ এবং পরক্ষণেই ব্যক্তিগত কলহে নিরতিশয় তিক্ত হইয়া উঠে। ত্রিকালদর্শীদের আমি তাচ্ছিল্য করিতেছি না, রাজলক্ষ্মীর মত আমিও তাঁহাদের অতিশয় ভক্তি করি; শুধু এই কথাটাই ভাবি, তাঁহারা দয়া করিয়া যদি শুধু কেবল আমাদের এই ইংরাজী-আমলটার জন্য ভাবিয়া না যাইতেন, তাহা হইলে তাঁহারাও অনেক দুরূহ চিন্তার দায় হইতে অব্যাহতি পাইতেন, আমরাও হয়ত সত্য সত্যই আজ বাঁচিতে পারিতাম।

আমি পূর্বেই বলিয়াছি, রাজলক্ষ্মী আমার মনের কথাগুলো যেন দর্পণের মত স্পষ্ট দেখিতে পাইত। কেমন করিয়া পাইত জানি না, কিন্তু এখন এই অস্পষ্ট দীপালোকে আমার মুখের চেহারাটার প্রতি দৃষ্টিপাত করে নাই, তবুও যেন আমার নিভৃত চিন্তার ঠিক দ্বারপ্রান্তেই আঘাত করিল। কহিল, তুমি ভাবচ এটা নিতান্তই বাড়াবাড়ি—ভবিষ্যতের বিধিব্যবস্থা কেউ পূর্বাহ্নেই নির্দেশ করে দিতে পারে না। কিন্তু আমি বলচি, পারে। আমার গুরুদেবের শ্রীমুখে শুনেচি, এ কাজ তাঁরা না পারলে সজীব মন্ত্রগুলোকেও কখনো দেখতে পেতেন না। বলি, এটা ত মানো, আমাদের শাস্ত্রীয় মন্ত্রগুলির প্রাণ আছে? তারা জীবন্ত?

0 Shares