শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

বলিলাম, হাঁ।

রাজলক্ষ্মী কহিল, তুমি না মানতে পার, কিন্তু তবুও এ সত্য। তা নইলে আমাদের দেশের এই পুতুলখেলার বিয়েই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিবাহ-বন্ধন হতে পারত না। এ-সমস্তই ত ওই সজীব মন্ত্রের জোরে! সেই ঋষিদের কৃপায়! অবশ্য, অনাচার আর পাপ কোথায় নেই? সে সর্বত্রই আছে। কিন্তু আমাদের এ দেশের মত সতীত্বই কি তুমি আর কোথাও দেখাতে পারো?

বলিলাম, না। কারণ, এ তাহার যুক্তি নয়—বিশ্বাস।

ইতিহাসের প্রশ্ন হইলে তাহাকে দেখাইতে পারিতাম, এই পৃথিবীতে সজীব মন্ত্রহীন আরও দেশ আছে যেথায় সতীত্বের আদর্শ আজও এমনিই উচ্চ। অভয়ার উল্লেখ করিয়া বলিতে পারিতাম, এই যদি, তবে তোমাদের জীবন্ত মন্ত্র নর-নারী উভয়কেই এক আদর্শে বাঁধিতে পারে না কেন? কিন্তু এ-সকলের প্রয়োজন ছিল না। আমি জানিতাম তাহার চিত্তের ধারাটা কিছুদিন হইতেই কোন্‌ দিক দিয়া বহিতেছে।

দুষ্কৃতির বেদনা সে ভাল করিয়াই জানে। যাহাকে সমস্ত অন্তর দিয়া ভালবাসিয়াছে, তাহাকে কলুষিত না করিয়া কেমন করিয়া যে সে এ জীবনে লাভ করিবে তাহার কিছুই সে ভাবিয়া পায় না। তাহার দুর্বশ হৃদয় ও প্রবুদ্ধ ধর্মবৃত্তি—এই দুই প্রতিকূলগামী প্রচণ্ড প্রবাহ যে কেমন করিয়া কোন্‌ সঙ্গমে সম্মিলিত হইয়া এই দুঃখের জীবনে তাহার তীর্থের মত সুপবিত্র হইয়া উঠিবে সে তাহার কোন কিনারাই দেখিতে পায় না। কিন্তু আমি পাই। নিজেকে নিঃশেষে দান করিয়া পর্যন্ত অপরের গোপন আক্ষেপ প্রতিনিয়তই আমার চোখে পড়ে। বেশ স্পষ্ট নয় বটে, কিন্তু যেন দেখিতে পাই তাহার যে দুর্মদ কামনা এতদিন অত্যুগ্র নেশার মত তাহার সমস্ত মনটাকে উতলা-উন্মত্ত করিয়া রাখিয়াছিল, সে যেন আজ স্থির হইয়া তাহার সৌভাগ্যের, তাহার প্রাপ্তিটার হিসাব দেখিতে চাহিতেছে। এই হিসাবের অঙ্কগুলায় কি আছে জানিনা, কিন্তু শূন্য ছাড়া যদি আর কিছুই আজ আর সে না দেখিতে পায় ত, কেমন করিয়া কোথায় গিয়া যে আবার আমি নিজের এই শতচ্ছিন্ন জীবন-জালের গ্রন্থি বাঁধিতে বসিব, এ চিন্তা আমার মধ্যে বহুবার আনাগোনা করিয়া গিয়াছে। ভাবিয়া কিছুই পাই নাই, কেবল এই কথাটাই নিশ্চয় জানিয়া আছি যে, চিরদিন যে পথে চলিয়াছি, প্রয়োজন হয় ত আবার সেই পথেই যাত্রা শুরু করিব। নিজের সুখ ও সুবিধা লইয়া কাহারও সমস্যা জটিল করিয়া তুলিব না।

কিন্তু পরমাশ্চর্য এই যে, যে মন্ত্রের সজীবতার আলোচনায় আমাদের মধ্যে একমুহূর্তে বিপ্লব বহিয়া গেল, তাহার প্রসঙ্গ লইয়া পাশের বাড়িতেই যে তখন মল্লযুদ্ধ বাধিয়া গিয়াছিল, এ সংবাদ দু’জনের কেহই জানিতাম না।

অকস্মাৎ পাঁচ-সাতজন গোটা-দুই আলো লইয়া অত্যন্ত সোরগোল করিয়া একেবারে প্রাঙ্গণের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল এবং ব্যাকুলকণ্ঠে ডাক দিল, হুজুর! বাবুমশায়!

আমি ব্যস্ত হইয়া বাহিরে আসিলাম, রাজলক্ষ্মীও সবিস্ময়ে উঠিয়া আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। নালিশটা তাহারা সকলেই একসঙ্গে এবং সমস্বরে করিতে চায়। রতনের পুনঃ পুনঃ বকুনি সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত কেহই চুপ করিতে পারিল না। যাহা হউক, ব্যাপারটা বুঝা গেল। কন্যাসম্প্রদান বন্ধ হইয়া আছে, কারণ মন্ত্র ভুল হইতেছে বলিয়া বরপক্ষীয় পুরোহিত কন্যাপক্ষীয় পুরোহিতের ফুল-জল প্রভৃতি টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়াছে এবং তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়াছে। বাস্তবিক, এ কি অত্যাচার! পুরোহিতসম্প্রদায় অনেক কীর্তিই করিয়া থাকে, কিন্তু তাই বলিয়া ভিন্ন গ্রাম হইতে আসিয়া জোর করিয়া আর একজন সমব্যবসায়ীর ফুল-জল প্রভৃতি ফেলিয়া দেওয়া, এবং শারীরিক বলপ্রয়োগে তাহার মুখ চাপিয়া স্বাধীন ও সজীব মন্ত্রোচ্চারণের বাধা দেওয়া—এমন অত্যাচার ত কখনও শুনি নাই।

রাজলক্ষ্মী কি যে বলিবে হঠাৎ ভাবিয়া পাইল না; কিন্তু রতন ঘরের মধ্যে কি করিতেছিল, সে বাহিরে আসিয়া মস্ত একটা ধমক দিয়া কহিল, তোদের আবার পুরুত কি রে? এখানে, অর্থাৎ জমিদারিতে আসিয়া পর্যন্ত সে ‘তুমি’ বলিবার যোগ্য কাহাকেও পায় নাই, কহিল, ডোম-ডোকালির আবার বিয়ে, তাদের আবার পুরুত! এ কি আমাদের বামুন-কায়েত-নবশাক পেয়েচিস যে বিয়ে দিতে আসবে বামুনঠাকুর? এই বলিয়া সে বারবার আমার ও রাজলক্ষ্মীর মুখের প্রতি সগর্বে চাহিতে লাগিল। এখানে মনে করিয়া দেওয়া আবশ্যক যে রতন জাতিতে নাপিত।

মধু ডোম নিজে আসিতে পারে নাই, কন্যাসম্প্রদানে বসিয়াছে, কিন্তু তাহার সম্বন্ধী আসিয়াছিল। সে ব্যক্তি যাহা বলিতে লাগিল তাহাতে যদিচ বুঝা গেল ইহাদের ব্রাহ্মণ নাই, নিজেরা নিজেদের পুরোহিত, তথাপি রাখাল পণ্ডিত তাহাদের ব্রাহ্মণেরই সামিল। কারণ, তাহার গলায় পৈতা আছে এবং সে তাহাদের দশকর্ম করায়। এমন কি, সে তাহাদের ছোঁয়া জল পর্যন্ত খায় না। সুতরাং এত বড় সাত্ত্বিকতার পরেও আর প্রতিবাদ চলে না। অতএব, আসল ও খাঁটি ব্রাহ্মণের সহিত অতঃপর যদি কোন প্রভেদ থাকে ত সে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।

সে যাহা হউক, ইহাদের ব্যাকুলতায় ও অদূরে বিবাহবাটীর প্রবল চিৎকারশব্দে আমাকে যাইতে হইল। রাজলক্ষ্মীকে কহিলাম, তুমিও চল না, বাড়িতে একলা কি করবে!

রাজলক্ষ্মী প্রথমে মাথা নাড়িল, কিন্তু শেষে কৌতূহল নিবারণ করিতে পারিল না। চল, বলিয়া আমার সঙ্গ লইল। আসিয়া দেখিলাম, মধুর সম্বন্ধী অত্যুক্তি করে নাই। বিবাদ তুমুল হইয়া উঠিবার উপক্রম করিয়াছে। একদিকে বরপক্ষীয় প্রায় ত্রিশ-বত্রিশজন এবং অন্যদিকে কন্যাপক্ষীয়ও প্রায় ততগুলি। মাঝখানে প্রবল ও স্থূলকায় শিবু পণ্ডিত দুর্বল ও ক্ষীণজীবী রাখাল পণ্ডিতের হাত চাপিয়া ধরিয়া আছে। আমাদের দেখিয়া সে ছাড়িয়া দিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।

আমরা সসম্মানে একটা মাদুরের উপর আসন গ্রহণ করিয়া শিবু পণ্ডিতকে এই অতর্কিতে আক্রমণের হেতু জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, হুজুর, মন্তরের ‘ম’ জানে না এই ব্যাটা, আবার নিজেকে বলে পণ্ডিত! বিবাহটাই আজ ভেস্তে দিত।

0 Shares