শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

রাখাল মুখ ভ্যাঙাইয়া প্রতিবাদ করিয়া বলিল, হাঁ দিত। পাঁচখানা গাঁয়ে ছাদ্দ, বিয়ে নিত্যি দিচ্ছি, আর আমি জানিনে মন্তর!

মনে ভাবিলাম, এখানেও সেই মন্ত্র! কিন্তু বাটীতে রাজলক্ষ্মীর কাছে না হয় মৌন থাকিয়াই তর্কের জবাব দিয়াছি, কিন্তু এখানে যদি যথার্থ-ই মধ্যস্থতা করিতে হয় ত বিপদে পড়িতে হইবে। অবশেষে বহু বাদবিতণ্ডায় স্থির হইল যে, রাখালই মন্ত্র পাঠ করাইবে, কিন্তু ভুল যদি কোথাও হয় ত শিবুকে আসন ছাড়িয়া দিতে হইবে। রাখাল রাজি হইয়া পুরোহিতের আসন গ্রহণ করিল এবং কন্যার পিতার হাতে কয়েকটা ফুল এবং বর-কন্যার দুই হাত একত্র করিয়া দিয়া যে বৈদিক মন্ত্রপাঠ করিল তাহা আমার আজও মনে আছে। এগুলি সজীব কিনা জানি না, এবং মন্ত্র-সম্বন্ধে কোন জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও সন্দেহ হয়, বেদে ঠিক এই কথাগুলিই ঋষিরা সৃষ্টি করিয়া যান নাই।

রাখাল পণ্ডিত বরকে বলিলেন, বল, মধু ডোমায় কন্যায় নমঃ।

বর আবৃত্তি করিল, মধু ডোমায় কন্যায় নমঃ।

রাখাল কন্যাকে বলিলেন, বল, ভগবতী ডোমায় পুত্রায় নমঃ।

বালিকা কন্যার উচ্চারণে পাছে ত্রুটি হয় এইজন্য মধু তাহার হইয়া উচ্চারণ করিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে শিবু পণ্ডিত দু হাত তুলিয়া বজ্রগর্জনে সকলকে চমকিত করিয়া বলিয়া উঠিল, ও মন্তরই নয়। বিয়েই হ’ল না।

পিছনে একটা টান পাইয়া ফিরিয়া দেখি রাজলক্ষ্মী মুখের মধ্যে আঁচল গুঁজিয়া প্রাণপণে হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতেছে, এবং উপস্থিত সমস্ত লোকই একান্ত উদ্‌গ্রীব হইয়া উঠিয়াছে।

রাখাল পণ্ডিত লজ্জিতমুখে কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু তাহার কথা কেহ কানেই লইল না; সকলেই সমস্বরে শিবুকে অনুনয় করিতে লাগিল, পণ্ডিতমশাই, মন্তরটি আপনিই বলিয়ে দিন, নইলে এ বিয়েই হবে না—সব নষ্ট হয়ে যাবে। সিকি দক্ষিণে ওঁকে দিয়ে আপনিই বারো আনা নেবেন পণ্ডিতমশাই।

শিবু পণ্ডিত তখন ঔদার্য দেখাইয়া কহিলেন, রাখালের দোষ নেই, আসল মন্তর আমি ছাড়া এ অঞ্চলে আর কেউ জানেই না। বেশি দক্ষিণে আমি চাইনে; আমি এইখানে থেকেই মন্ত্রপাঠ করচি, রাখাল ওদের পড়াক। এই বলিয়া সেই শাস্ত্রজ্ঞ পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করিতে লাগিলেন এবং পরাজিত রাখাল নিরীহ ভালমানুষটির মত বর-কন্যাকে আবৃত্তি করাইতে লাগিল।

শিবু কহিলেন, বল, মধু ডোমায় কন্যায় ভুজ্যপত্রং নমঃ।

বর আবৃত্তি করিল, মধু ডোমায় কন্যায় ভুজ্যপত্রং নমঃ।

শিবু কহিলেন, মধু, এবার তুমি বল, ভগবতী ডোমায় পুত্রায় সম্প্রদানং নমঃ।

সকন্যা মধু ইহাই আবৃত্তি করিল। সকলেই নীরব, স্থির। ভাবে বোধ হইল শিবুর মত শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি ইতিপূর্বে এ অঞ্চলে পদার্পণ করে নাই।

শিবু বরের হাতে ফুল দিয়া কহিলেন, বিপিন, তুমি বল, যতদিন জীবনং ততদিন ভাত-কাপড় প্রদানং স্বাহা।

বিপিন থামিয়া থামিয়া বহু দুঃখে বহু সময়ে এই মন্ত্র উচ্চারণ করিল।

শিবু কহিলেন, বর-কন্যা দু’জনেই বল, যুগল মিলনং নমঃ।

বর এবং কন্যার হইয়া মধু ইহা আবৃত্তি করিল। ইহার পরে বিরাট হরিধ্বনিসহকারে বর-কন্যাকে বাটীর মধ্যে বহন করিয়া লইয়া যাওয়া হইল। আমার চতুষ্পার্শ্বে একটা গুঞ্জনরোল উঠিল—সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিতে লাগিল যে, হাঁ, একজন শাস্ত্রজানা লোক বটে! মন্তর পড়ালে বটে! রাখাল পণ্ডিত এতকাল আমাদের কেবল ঠকিয়েই খাচ্ছিল।

সমস্তক্ষণ আমি গম্ভীর হইয়াই ছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত এই অসীম গাম্ভীর্য বজায় রাখিয়াই রাজলক্ষ্মীর হাত ধরিয়া বাটী ফিরিয়া আসিলাম। ওখানে কি করিয়া যে সে আপনাকে সংবরণ করিয়া বসিয়াছিল আমি জানি না, কিন্তু ঘরে আসিয়া হাসির প্রবাহে তাহার যেন দম বন্ধ হইবার জো হইল। বিছানায় লুটাইয়া পড়িয়া সে কেবলই বলিতে লাগিল, হাঁ, একজন মহামহোপাধ্যায় বটে! রাখাল এতদিন এদের কেবল ঠকিয়েই খাচ্ছিল।

প্রথমটা আমিও হাসি রাখিতে পারিলাম না; তাহার পরে কহিলাম, মহামহোপাধ্যায় দু’জনেই। অথচ, এমনি করেই ত এতকাল এদের মেয়ের মা এবং মেয়ের ঠাকুরমার বিয়ে হয়েচে। রাখালের যাই হোক, শিবু পণ্ডিতের মন্ত্রগুলোও ঠিক ঋষিরুবাচ বলে মনে হল না, কিন্তু তবু ত এদের কোন মন্ত্রই বিফল হয়নি। এদের বিবাহ-বন্ধন ত আজও তেমনি দৃঢ় তেমনি অটুট আছে!

রাজলক্ষ্মী হাসি চাপিয়া সহসা সোজা হইয়া উঠিয়া বসিল এবং একদৃষ্টে চুপ করিয়া আমার মুখের পানে চাহিয়া কত কি যেন ভাবিতে লাগিল।

পরিচ্ছেদ – ছয়

সকালে উঠিয়া শুনিলাম কুশারীমহাশয় মধ্যাহ্ন-ভোজনের নিমন্ত্রণ করিয়া গিয়াছেন। ঠিক এই আশঙ্কাই করিতেছিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি একা নাকি?

রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিল, না, আমিও আছি।

যাবে?

যাব বৈ কি।

তাহার এই নিঃসঙ্কোচ উত্তর শুনিয়া অবাক হইয়া গেলাম। খাওয়া বস্তুটা যে হিন্দু ধর্মের কি, এবং সমাজের কতখানি ইহার উপর নির্ভর করে, রাজলক্ষ্মী তাহা জানে—এবং কত বড় নিষ্ঠার সহিত ইহাকে মানিয়া চলে আমিও তাহা জানি, অথচ এই তাহার জবাব। কুশারীমহাশয় সম্বন্ধে বেশি-কিছু জানি না, তবে বাহির হইতে তাঁহাকে যতটা দেখা গিয়াছে, মনে হইয়াছে তিনি আচারপরায়ণ ব্রাহ্মণ; এবং ইহাও নিশ্চিত যে, রাজলক্ষ্মীর ইতিহাস তিনি অবগত নহেন, কেবল মনিব বলিয়াই আমন্ত্রণ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু রাজলক্ষ্মী যে আজ সেখানে গিয়া, কি করিয়া কি করিবে আমি ত ভাবিয়া পাইলাম না। অথচ, আমার প্রশ্নটা বুঝিয়াও সে যখন কিছুই কহিল না, তখন ইহারই নিহিত-কুণ্ঠা আমাকেও নির্বাক্‌ করিয়া রাখিল।

যথাসময়ে গো-যান আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি প্রস্তুত হইয়া বাহিরে আসিয়া দেখিলাম রাজলক্ষ্মী গাড়ির কাছে দাঁড়াইয়া।

কহিলাম, যাবে না?

সে কহিল, যাবার জন্যেই ত দাঁড়িয়ে আছি। এই বলিয়া সে গাড়ির ভিতরে গিয়া বসিল।

রতন সঙ্গে যাইবে, সে আমার পিছনে ছিল। ঠাকুরানীর সাজসজ্জা দেখিয়া সে যে নিরতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল, তাহার মুখ দেখিয়া তাহা বুঝিলাম। আমিও আশ্চর্য হইয়াছিলাম; কিন্তু সেও যেমন প্রকাশ করিল না, আমিও তেমনি নীরব হইয়া রহিলাম। বাড়িতে সে কোনকালেই বেশি গহনা পরে না, কিছুদিন হইতে তাহাও কমিতেছিল। কিন্তু আজ দেখা গেল, গায়ে তাহার কিছুই প্রায় নাই। যে হারটা সচরাচর তাহার গলায় থাকে সেইটি এবং হাতে একজোড়া বালা। ঠিক মনে নাই, তবুও যেন মনে হইল, কাল রাত্রি পর্যন্ত যে চুড়ি-কয়গাছি দেখিয়াছিলাম সেগুলিও যেন সে আজ ইচ্ছা করিয়াই খুলিয়া ফেলিয়াছে। পরনের কাপড়খানিও নিতান্ত সাধারণ, বোধ হয় সকালে স্নান করিয়া যাহা পরিয়াছিল তাহাই।

0 Shares