শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

আশ্চর্য হয়ে বললাম, শোন কথা একবার! কানাই বসাকের সমস্ত সম্পত্তি দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেলে ইনি কিনে নিয়েচেন। নিজের কেনা বিষয় কে কবে পরকে ছেড়ে দেয় ছোটবৌ?

ছোটবৌ বললে, কিন্তু বট্‌ঠাকুর এত টাকা পেলেন কোথায়?

রাগ করে জবাব দিলাম, সে কথা জিজ্ঞেস কর্‌ গে যা তোর বট্‌ঠাকুরকে—বিষয় যে কিনেচে। এই বলে আহ্নিক করতে চলে গেলাম।

রাজলক্ষ্মী কহিল, সত্যিই ত। যে বিষয় নীলাম হয়ে গেছে তা ফিরিয়ে দিতেই বা ছোটবৌ বলে কি করে?

কুশারীগৃহিণী কহিলেন, বল ত বাছা! কিন্তু এ কথা বলা সত্ত্বেও তাঁহার মুখের উপর লজ্জার যেন একটা কালো ছায়া পড়িল। কহিলেন, তবে ঠিক নিলাম হয়েই ত বিক্রি হয়নি কিনা তাই। আমরা হলাম তাদের পুরুত-বংশ। কানাই বসাক মৃত্যুকালে এঁর উপরেই সমস্ত ভার দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন ত আর ইনি জানতেন না, সেই সঙ্গে একরাশ দেনাও রেখে গিয়েছিল!

তাঁহার কথা শুনিয়া রাজলক্ষ্মী ও আমি উভয়েই কেমন যেন স্তব্ধ হইয়া গেলাম। কি যেন একটা নোংরা জিনিস আমার মনের ভিতরটা একমুহূর্তেই একেবারে মলিন করিয়া দিয়া গেল। কুশারীগৃহিণী বোধ করি ইহা লক্ষ্য করিলেন না। বলিলেন, জপ-আহ্নিক সমস্ত সেরে ঘণ্টা-দুই পরে ফিরে এসে দেখি সুনন্দা সেইখানে ঠিক তেমনি স্থির হয়ে বসে আছে, কোথাও একটা পা পর্যন্ত বাড়ায় নি। কর্তা কাছারি সেরে এখুনি এসে পড়বেন; ঠাকুরপো বিনুকে নিয়ে খামার দেখতে গেছে, তারও ফিরতে দেরি নেই। বিজয় নাইতে গেছে, এখুনি এসে ঠাকুরপুজোয় বসবে। রাগের পরিসীমা রইল না; বললাম, তুই কি রান্নাঘরে আজ ঢুকবি নে? ওই বজ্জাত তাঁতিবেটীর ছেঁড়া কথা নিয়েই সারাদিন বসে থাকবি?

সুনন্দা মুখ তুলে বললে, না দিদি, যে বিষয় আমাদের নয়, সে যদি তোমরা ফিরিয়ে না দাও ত আমি রান্নাঘরে ঢুকব না। ওই নাবালক ছেলেটার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে আমার স্বামী-পুত্রকে খাওয়াতে পারব না, ঠাকুরের ভোগ রেঁধেও দিতে পারব না। এই বলে সে তার নিজের ঘরে চলে গেল। সুনন্দাকে আমি চিনতাম। সে যে মিথ্যা কথা বলে না, সে যে তার অধ্যাপক সন্ন্যাসী বাপের কাছে ছেলেবেলা থেকে অনেক শাস্ত্র পড়েচে, তাও জানতাম; কিন্তু সে যে মেয়েমানুষ হয়েও এমন পাষাণ-কঠিন হতে পারবে তাই কেবল তখনো জানতাম না। আমি তাড়াতাড়ি ভাত রাঁধতে গেলাম। পুরুষেরা সব বাড়ি ফিরে এলেন। কর্তার খাবার সময় সুনন্দা দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। আমি দূর থেকে হাত জোড় করে বললাম, সুনন্দা, একটু ক্ষমা দে, ওঁর খাওয়াটা হয়ে যাক। সে এটুকু অনুরোধও রাখলে না। গণ্ডূষ করে খেতে বসছিলেন, জিজ্ঞেস করলে, তাঁতিদের সম্পত্তি কি আপনি টাকা দিয়ে নিয়েছিলেন? ঠাকুর ত কিছুই রেখে যাননি, এ ত আপনাদের মুখেই অনেকবার শুনেচি। তবে এত টাকা পেলেন কোথায়?

যে কখনো কথা কয় না তার মুখে এই প্রশ্ন শুনে কর্তা প্রথমে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন, তার পর বললেন, এ-সব কথার মানে কি বৌমা?

সুনন্দা উত্তর দিলে, এর মানে যদি কেউ জানে ত সে আপনি। আজ তাঁতিবৌ তার ছেলে নিয়ে এসেছিল। তার সমস্ত কথার পুনরাবৃত্তি করা আপনার কাছে বাহুল্য—কিছুই আপনার অজানা নেই। এ বিষয় যার তাকে যদি ফিরিয়ে না দেন ত আমি বেঁচে থেকে এই মহাপাপের একটা অন্নও আমার স্বামী-পুত্রকে খেতে দিতে পারব না।

আমার মনে হ’ল বাবা, হয় আমি স্বপ্ন দেখচি, নাহয় সুনন্দাকে ভূতে পেয়েছে। যে ভাশুরকে সে দেবতার বেশি ভক্তি করে তাঁকেই এই কথা! উনিও খানিকক্ষণ বজ্রাহতের মত বসে রইলেন; তার পরে জ্বলে উঠে বললেন, বিষয় পাপের হোক, পুণ্যের হোক, সে আমার—তোমার স্বামী-পুত্রের নয়। তোমাদের না পোষায় তোমরা আর কোথাও যেতে পার। কিন্তু বৌমা, তোমাকে আমি এতকাল সর্বগুণময়ী বলেই জানতাম, কখনো এমন ভাবিনি। এই বলে তিনি আসন ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। সেদিন সমস্তদিন আর কারও মুখে ভাত-জল গেল না। কেঁদে গিয়ে ঠাকুরপোর কাছে পড়লাম, বললাম, ঠাকুরপো, তোমাকে যে আমি কোলে করে মানুষ করেছি—তার এই প্রতিফল! ঠাকুরপোর চোখ-দুটো জলে ভরে গেল, বললে, বৌঠান, তুমি আমার মা, দাদাও আমার পিতৃতুল্য। কিন্তু তোমাদের বড় যে, সে ধর্ম। আমারও বিশ্বাস সুনন্দা একটা কথাও অন্যায় বলেনি। শ্বশুরমহাশয় সন্ন্যাস-গ্রহণের দিন তাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, মা, ধর্মকে যদি সত্যিই চাও, তিনিই তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। আমি তাকে এতটুকু বয়স থেকে চিনি বৌঠান, সে কখ্‌খনো ভুল করেনি।

হায়রে পোড়া কপাল! তাকেও যে পোড়ারমুখী ভেতরে ভেতরে এত বশ করে রেখেছিল, আজ আমার তায় চোখ খুলল। সেদিন ভাদ্রসংক্রান্তি, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন—থেকে থেকে ঝরঝর করে জল পড়চে, কিন্তু হতভাগী একটা রাত্তিরের জন্যেও আমাদের মুখ রাখলে না, ছেলের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

আমার শ্বশুরের কালের একঘর প্রজা মরেহেজে বছর-দুই হ’ল চলে গেছে, তাদেরই ভাঙ্গা ঘর একখানি তখনও কোনমতে দাঁড়িয়ে ছিল; শিয়াল-কুকুর-সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে তাতেই গিয়ে সেই দুর্দিনে আশ্রয় নিলে। উঠোনের জল-কাদা মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ে কেঁদে উঠলাম, সর্বনাশী, এই যদি তোর মনে ছিল, এ সংসারে ঢুকেছিলি কেন? বিনুকে পর্যন্ত যে নিয়ে চললি, তুই কি শ্বশুরকুলের নামটা পর্যন্ত পৃথিবীতে থাকতে দিবিনে প্রতিজ্ঞা করেচিস? কিন্তু কোন উত্তর দিলে না। বললাম, খাবি কি? জবাব দিলে, ঠাকুর যে তিন বিঘে ব্রহ্মোত্তর রেখে গেচেন, তার অর্ধেকটাও ত আমাদের। কথা শুনে মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে হ’ল। বললাম, হতভাগী, তাতে যে একটা দিনও চলবে না। তোরা নাহয় না খেয়ে মরতে পারিস, কিন্তু আমার বিনু? বললে, একবার কানাই বসাকের ছেলের কথা ভেবে দেখ দিদি। তার মত একবেলা এক সন্ধ্যে খেয়েও যদি বিনু বাঁচে, ত সেই ঢের।

তারা চলে গেল। সমস্ত বাড়িটা যেন হাহাকার করে কাঁদতে লাগল। সে রাত্রিতে আলো জ্বলল না, হাঁড়ি চড়ল না। কর্তা অনেক রাত্রে ফিরে এসে সমস্ত রাত ওই খুঁটিটা ঠেস দিয়ে বসে কাটালেন। হয়ত বিনু আমার ঘুমোয় নি, হয়ত বাছা আমার ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করচে। ভোর না হতেই রাখালকে দিয়ে গরু-বাছুর পাঠিয়ে দিলাম, কিন্তু রাক্ষুসী ফিরিয়ে দিয়ে তারই হাতে বলে পাঠালে, বিনুকে আমি দুধ খাওয়াতে চাইনে, দুধ না খেয়ে বেঁচে থাকবার শিক্ষা দিতে চাই।

0 Shares