শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

রাজলক্ষ্মীর মুখ দিয়া কেবল একটা সুগভীর নিশ্বাস পড়িল; গৃহিণীর সেই দিনের সমস্ত বেদনা ও অপমানের স্মৃতি উদ্বেল হইয়া তাঁহার কণ্ঠরোধ করিয়া দিল, এবং আমার হাতের ডাল-ভাত শুকাইয়া একেবারে চামড়া হইয়া উঠিল।

কর্তার খড়মের শব্দ শুনা গেল, তাঁহার মধ্যাহ্ন-ভোজন সমাধা হইয়াছে। আশা করি তাঁহার মৌনব্রত অক্ষুণ্ণ-অটুট থাকিয়া তাঁহার সাত্ত্বিক আহারের আজ কোন বিঘ্ন ঘটায় নাই, কিন্তু এদিকের ব্যাপারটা জানিতেন বলিয়াই বোধ করি আমার তত্ত্ব লইতে আর আসিলেন না। গৃহিণী চোখ মুছিয়া, নাক ঝাড়িয়া, গলা পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, তার পর গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় লোকের মুখে মুখে কি দুর্নাম, কি কেলেঙ্কারি বাবা—সে আর তোমাদের কি বলব! কর্তা বললেন, দু’দিন যাক, দুঃখের জ্বালায় তারা আপনিই ফিরবে। আমি বললাম, তাকে চেনো না, সে ভাঙ্গবে কিন্তু নুইবে না। আর তাই হ’ল। একটার পর একটা করে আজ আট মাস কেটে গেল, কিন্তু তাকে হেঁট করতে পারলে না। কর্তা ভেবে ভেবে আর আড়ালে কেঁদে কেঁদে যেন কাঠ হয়ে উঠতে লাগলেন। ছেলেটা ছিল তাঁর প্রাণ, আর ঠাকুরপোকে ভালবাসতেন ছেলের চেয়ে বেশি। আর সহ্য করতে না পেরে লোক দিয়ে বলে পাঠালেন, তাঁতিদের যাতে কষ্ট না হয় তিনি করবেন; কিন্তু সর্বনাশী জবাব দিলে, যা তাদের ন্যায্য পাওনা সমস্ত মিটিয়ে দিলেই তবে ঘরে ফিরব। তার এক ছটাক কোথাও বাকি থাকতে যাব না। অর্থাৎ তার মানে, নিজেদের অবধারিত মৃত্যু।

আমি গেলাসের জলে হাতখানা একবার ডুবাইয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এখন তাঁদের কি করে চলে?

কুশারীগৃহিণী কাতর হইয়া বলিলেন, এর জবাব আর আমাকে দিতে ব’লো না বাবা। এ আলোচনা কেউ করতে এলে আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাই,—মনে হয় বুঝিবা আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই আট মাস এ-বাড়িতে মাছ আসে না, দুধ-ঘির কড়া চড়ে না। সমস্ত বাড়িটার ওপর কে যেন এক মর্মান্তিক অভিশাপ রেখে চলে গেছে। এই বলিয়া তিনি চুপ করিলেন, এবং বহুক্ষণ ধরিয়া তিনজনেই আমরা স্তব্ধ হইয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিলাম।

ঘণ্টাখানেক পরে আমরা আবার যখন গাড়িতে গিয়া বসিলাম, কুশারীগৃহিণী সজলকণ্ঠে রাজলক্ষ্মীর কানে কানে বলিলেন, মা, তারা তোমারই প্রজা। আমার শ্বশুরের দরুন যে জমিটুকুর ওপর তাদের নির্ভর সেটুকু তোমার গঙ্গামাটিতেই।

রাজলক্ষ্মী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আচ্ছা।

গাড়ি ছাড়িয়া দিতে তিনি পুনশ্চ বলিয়া উঠিলেন, মা, তোমার বাড়ি থেকেই চোখে পড়ে। নালার এ-দিকে যে ভাঙা পোড়ো ঘরটা দেখা যায়, সেইটে।

রাজলক্ষ্মী তেমনি নাথা নাড়িয়া জানাইল, আচ্ছা।

গাড়ি মন্থরগতিতে অগ্রসর হইল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমি কোন কথাই কহিলাম না। চাহিয়া দেখিলাম, রাজলক্ষ্মী অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছে। তাহার ধ্যান ভঙ্গ করিয়া কহিলাম, লক্ষ্মী, যার লোভ নেই, যে চায় না, তাকে সাহায্য করতে যাওয়ার মত বিড়ম্বনা আর নেই।

রাজলক্ষ্মী আমার মুখের প্রতি চাহিয়া অল্প একটুখানি হাসিয়া বলিল, সে আমি জানি। তোমার কাছে আমার আর কিছুই না হোক এ শিক্ষা হয়েচে!

পরিচ্ছেদ – সাত

আপনাকে আপনি বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাই, যে কয়টি নারী-চরিত্র আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিয়াছে, তাহার একটি সেই কুশারীমহাশয়ের বিদ্রোহী ভ্রাতৃজায়া। এই সুদীর্ঘ জীবনে সুনন্দাকে আমি আজও ভুলি নাই। মানুষকে এত শীঘ্র এবং এত সহজে রাজলক্ষ্মী আপনার করিয়া লইতে পারে যে, সুনন্দা যে একদিন আমাকে দাদা বলিয়া ডাকিয়াছিল তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছু নাই। না হইলে এই আশ্চর্য মেয়েটিকে জানিবার সুযোগ আমার কখনও ঘটিত না। অধ্যাপক যদু তর্কালঙ্কারের ভাঙ্গাচোরা দু-তিনখানা ঘর আমাদের বাড়ির পশ্চিমে মাঠের এক প্রান্তে চাহিলেই সোজা চোখে পড়ে—এখানে আসিয়া পর্যন্তই পড়িয়াছে, কেবল এক বিদ্রোহিণী যে ওইখানে তার স্বামী-পুত্র লইয়া বাসা বাঁধিয়াছে ইহাই জানিতাম না। বাঁশের পুল পার হইয়া একটা কঠিন অনুর্বর মাঠের উপর দিয়া মিনিট-দশেকের পথ; মাঝখানে গাছপালা প্রায় কিছুই নাই, অনেকদূর পর্যন্ত বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। আজ সকালে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া জানালার মধ্য দিয়া যখন ওই জীর্ণ শ্রীহীন ঘরগুলি চোখে পড়িল তখন অনেকক্ষণ পর্যন্ত একপ্রকার অভূতপূর্ব ব্যথা ও আগ্রহের সহিত চাহিয়া রহিলাম; এবং যে বস্তু অনেকদিন অনেক উপলক্ষে দেখিয়াও বার বার ভুলিয়াছি, সেই কথাই মনে পড়িল যে, সংসারে কোন-কিছুরই কেবলমাত্র বাহিরটা দেখিয়া কিছুই বলিবার জো নাই। কে বলিবে ওই পোড়ো বাড়িটা শিয়াল-কুকুরের আশ্রয়স্থল নহে! কে অনুমান করিবে ওই কয়খানা ভাঙ্গা ঘরের মধ্যে কুমার-রঘু-শকুন্তলা-মেঘদূতের অধ্যাপনা চলে; হয়ত স্মৃতি ও ন্যায়ের মীমাংসা ও বিচার লইয়া ছাত্র-পরিবৃত এক নবীন অধ্যাপক মগ্ন হইয়া থাকেন। কে জানিবে উহারই মধ্যে এই বাঙ্গলাদেশের এক তরুণী নারী ধর্ম ও ন্যায়ের মর্যাদা রাখিতে স্বেচ্ছায় অশেষ দুঃখ বহন করিতেছে !

দক্ষিণের জানালা দিয়া বাটীর মধ্যে দৃষ্টি পড়ায় মনে হইল উঠানের উপর কি যেন একটা হইতেছে—রতন আপত্তি করিতেছে এবং রাজলক্ষ্মী তাহা খণ্ডন করিতেছে, সুতরাং কণ্ঠস্বরটা তাহারই কিছু প্রবল। আমি উঠিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইতেই সে কিছু অপ্রতিভ হইয়া গেল; কহিল, ঘুম ভেঙ্গে গেল বুঝি? যাবেই ত। রতন, তুই গলাটা একটু খাটো কর বাবা, নইলে আমি ত আর পারিনে।

এই প্রকার অনুযোগ এবং অভিযোগে কেবল রতনই একা নয়, বাড়িসুদ্ধ সকলেই আমরা অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিলাম। অতএব সেও চুপ করিয়া রহিল, আমিও তেমনি কথা কহিলাম না।

দেখিলাম একটা বড় চাঙ্গারিতে চাল-ডাল-ঘি-তেল প্রভৃতি এবং আর-একটা ছোট পাত্রে এতজ্জাতীয় নানাবিধ ভোজ্যবস্তু সজ্জিত হইয়াছে। মনে হইল, এইগুলির পরিমাণ ও তাহাদিগকে বহন করিবার শক্তিসামর্থ্য-প্রসঙ্গেই রতন প্রতিবাদ করিতেছিল। ঠিক তাই। রাজলক্ষ্মী আমাকে মধ্যস্থ মানিয়া বলিল, শোন এর কথা! এই ক’টা চাল-ডাল বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না! এ যে আমি নিয়ে যেতে পারি রতন। এই বলিয়া সে হেঁট হইয়া স্বচ্ছন্দে বড় ঝুড়িটা তুলিয়া ধরিল।

0 Shares