শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

এতক্ষণে বুঝিলাম ইনিই যদুনাথ কুশারী। অধ্যাপক মানুষ, প্রিয়তমার মেজাজের উল্লেখে নিজের মেজাজ হারাইয়া ফেলিলেন; হাঃ হাঃ করিয়া উচ্চহাস্যে ঘর ভরিয়া প্রসন্নচিত্তে বলিলেন, না মা, রাগী হবে কেন, নিতান্তই সোজা মানুষ। আমরা দরিদ্র, আপনি গেলে ত তার উপযুক্ত সম্মান করতে পারব না, তিনিই আসবেন। একটু সময় পেলে আমিই তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।

রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিল, তর্কালঙ্কারমশাই, আপনার ছাত্র ক’টি?

কুশারী বলিলেন, পাঁচটি। এদেশে বেশি ছাত্র ত পাবার জো নেই—অধ্যাপনা কেবল নামমাত্র।

সব ক’টিকেই খেতে-পরতে দিতে হয়?

না। বিজয় ত দাদার ওখানে থাকে, একটির বাড়ি গ্রামের মধ্যেই, কেবল তিনটি ছাত্র আমার কাছে থাকে।

রাজলক্ষ্মী একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া অপূর্ব স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, এই দুঃসময়ে এ ত সহজ নয় তর্কালঙ্কারমশাই!

ঠিক এই কণ্ঠস্বরের প্রয়োজন ছিল। না হইলে অভিমানী অধ্যাপকের উত্তপ্ত হইয়া উঠার কিছুমাত্র বাধা ছিল না। অথচ এবার তাঁহার মনটা একেবারে ও-দিক দিয়াই গেল না! অতি সহজেই গৃহের দুঃখ-দৈন্য স্বীকার করিয়া ফেলিলেন; বলিলেন, কি করে যে চলে সে কেবল আমরা দুটি প্রাণীই জানি। কিন্তু তবু ত ভগবানের উদয়াস্ত আটকে থাকে না মা! তা ছাড়া উপায়ই বা কি? অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ত ব্রাহ্মণেরই কাজ। আচার্যদেবের কাছে যা পেয়েচি, সে ত কেবল ন্যস্ত ধন—আর একদিন সে ত ফিরিয়ে দিতেই হবে মা! একটু স্থির থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, একদিন এই ভার ছিল দেশের ভূস্বামীর উপর, কিন্তু এখন দিন কাল সমস্তই বদলে গেছে। সে অধিকারও তাঁদের নেই, সে দায়িত্বও গেছে। প্রজার রক্তশোষণ করা ছাড়া আর তাঁদের কোন করণীয় নেই। তাঁদের ভূস্বামী বলে মনে করতেই এখন ঘৃণা বোধ হয়। রাজলক্ষ্মী হাসিয়া বলিল, কিন্তু ওদের মধ্যে কেউ যদি কোন প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় তাতে যেন আবার বাধা দেবেন না।

কুশারী লজ্জা পাইয়া নিজেও হাসিলেন; কহিলেন, বিমনা হয়ে আপনার কথাটা আমি মনেই করিনি। কিন্তু বাধা দেব কেন? সত্যিই ত এ আপনাদেরই কর্তব্য।

রাজলক্ষ্মী কহিল, আমরা পুজো-আচ্চা করি, কিন্তু একটা মন্তরও হয়ত শুদ্ধ আবৃত্তি করতে পারিনে—এও কিন্তু আপনার কর্তব্য, তা স্মরণ করিয়ে দিচ্চি।

কুশারী হাসিয়া বলিলেন, তাই হবে মা! এই বলিয়া তিনি বেলার দিকে চাহিয়া উঠিয়া পড়িলেন। রাজলক্ষ্মী তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিল, যাইবার সময় আমিও কোনমতে একটা নমস্কার সারিয়া লইলাম।

তিনি চলিয়া গেলে রাজলক্ষ্মী কহিল, আজ তোমাকে একটু সকাল সকাল নাওয়া খাওয়া সেরে নিতে হবে।

কেন বল ত?

দুপুরবেলা একবার সুনন্দার বাড়িতে যেতে হবে।

একটু বিস্মিত হইয়া কহিলাম, কিন্তু আমাকে কেন? তোমার বাহন রতন আছে ত?

রাজলক্ষ্মী মাথা নাড়িয়া বলিল, ও বাহনে আর কুলোবে না, তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে আর কোথাও আমি একপাও নড়চি নে।

বলিলাম, আচ্ছা, তাই হবে।

পরিচ্ছেদ – আট

পূর্বেই বলিয়াছি, একদিন সুনন্দা আমাকে দাদা বলিয়া ডাকিয়াছিল, তাহাকে পরমাত্মীয়ের মত কাছে পাইয়াছিলাম। ইহার সমস্ত বিবরণ বিস্তৃত করিয়া না বলিলেও কথাটাকে প্রত্যয় না করিবার বিশেষ কোন হেতু নাই। কিন্তু আমাদের প্রথম পরিচয়ের ইতিহাসটা বিশ্বাস করান শক্ত হইবে হয়ত। অনেকেই মনে করিবেন ইহা অদ্ভুত; হয়ত, অনেকেই মাথা নাড়িয়া কহিবেন, এ-সকল কেবল গল্পেই চলে। তাঁহারা বলিবেন, আমরাও বাঙ্গালী, বাঙ্গলাদেশেরই মানুষ, কিন্তু সাধারণ গৃহস্থঘরে এমন হয় তাহা ত কখনো দেখি নাই! তা বটে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে শুধু ইহাই বলিতে পারি, আমিও এ দেশেরই মানুষ এবং একটির অধিক সুনন্দা এ দেশে আমারও চোখে পড়ে নাই। তত্রাচ ইহা সত্য।

রাজলক্ষ্মী ভিতরে প্রবেশ করিল। আমি তাহাদের ভাঙ্গা প্রাচীরের ধারে দাঁড়াইয়া কোথায় একটু ছায়া আছে খোঁজ করিতেছি, একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছোকরা আসিয়া কহিল, আসুন, ভেতরে আসুন।

তর্কালঙ্কারমশাই কোথায়? বিশ্রাম করচেন বোধ হয়?

আজ্ঞে না, তিনি হাটে গেছেন। মা আছেন, আসুন। বলিয়া সে অগ্রবর্তী হইল, এবং যথেষ্ট দ্বিধাভরেই আমি তাহার অনুসরণ করিলাম। একদা কোনকালে হয়ত এ বাটীর সদর দরজা কোথাও ছিল, কিন্তু সম্প্রতি তাহার চিহ্ন পর্যন্ত বিলুপ্ত। অতএব ভূতপূর্ব একটা ঢেঁকিশালার পথে অন্তঃপুরে প্রবেশ করায় নিশ্চয়ই ইহার মর্যাদা লঙ্ঘন করি নাই। প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইয়া সুনন্দাকে দেখিলাম। উনিশ-কুড়ি বছরের শ্যামবর্ণ একটি মেয়ে এই বাড়িটির মতই একেবারে আভরণবর্জিত। সম্মুখের অপরিসর বারান্দার একধারে মুড়ি ভাজিতেছিল,—বোধ হয় রাজলক্ষ্মীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই উঠিয়া দাঁড়াইয়া,—আমাকে জীর্ণ একখানি কম্বলের আসন পাতিয়া দিয়া নমস্কার করিল। কহিল, বসুন। ছেলেটিকে বলিল, অজয়, উনুনে আগুন আছে, একটু তামাক সেজে দাও বাবা। রাজলক্ষ্মী বিনা আসনে পূর্বে উপবিষ্ট হইয়াছিল, তাহার প্রতি চাহিয়া ঈষৎ সলজ্জ হাস্যে কহিল, আপনাকে কিন্তু পান দিতে পারব না, পান আমাদের বাড়িতে নেই।

আমরা কে, অজয় বোধ হয় তাহা জানিতে পারিয়াছিল। সে তাহার গুরুপত্নীর কথায় সহসা অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, নেই? তাহলে পান বুঝি আজ হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে মা?

সুনন্দা তাহার মুখের দিকে একমুহূর্ত মুখ টিপিয়া চাহিয়া থাকিয়া, কহিল, ওটা হঠাৎ আজ ফুরিয়ে গেছে, না কেবল হঠাৎ একদিনই ছিল অজয়? এই বলিয়া সহসা খিল্‌খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিয়া রাজলক্ষ্মীকে বলিল, ও- রবিবারে ছোট মোহন্তঠাকুরের আসবার কথায় এক পয়সার পান কেনা হয়েছিল—সে প্রায় দিন দশেকের কথা। এই! এতেই আমার অজয় একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেছে, পান হঠাৎ ফুরাল কি করে? এই বলিয়া সে আবার হাসিতে লাগিল। অজয় মহা অপ্রতিভ হইয়া বলিতে লাগিল, বাঃ—এই বুঝি! তা বেশ ত, হলই বা ফুরোলই বা—

0 Shares